ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ভুলে যাওয়া মুজিব বাহিনী

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৪ মে ২০১৫

একুশ শতক ॥ ভুলে যাওয়া মুজিব বাহিনী

॥ চার ॥ মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বইতে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে বেশকিছু মন্তব্য করেছেন। বিশেষ করে মুজিব বাহিনী গঠন ও তার কার্যক্রম নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হতে পারে। তাঁর মতে, ভুল বোঝাবুঝির জন্য মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েক স্থানে সংঘাত হয়। বিশেষ করে তিনি ২ নম্বর সেক্টরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিএলএফের পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনীর কোন বোঝাপড়া ছিল না। মণি ছিলেন তাজউদ্দীন সরকারের প্রচ-রকম বিরোধী। তাঁর অভিযোগ ছিল, খালেদ তাঁর সেক্টরে বামপন্থী ছাত্রদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিচ্ছেন। দেশের অন্য তিনটি অঞ্চলে এ ধরনের কোন সংঘাত ছিল না। সেসব অঞ্চলে তাঁরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করতেন। দেখা গেছে, অনেক জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান নেতা ছিলেন বিএলএফের কমান্ডার। খুলনা, যশোর, বগুড়া, রংপুরÑ এসব জেলায় বিএলএফের জেলা ও মহকুমা কমান্ডাররা সব মুক্তিযোদ্ধারই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেসব জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোন বিভাজন ছিল না। ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের বাহিনীর সঙ্গে বিএলএফের একটি দলের সংঘর্ষ হয়েছিল। বিষয়টি সুরাহা করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী আইনউদ্দিনের কাছে গেলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের একটা চিঠি দেখান। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমাদের সরকারী বাহিনীর অনুমতি ছাড়া কেউই সশস্ত্র অবস্থায় দেশের ভেতরে যেতে পারবে না। এ ব্যাপারে উবানের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরার কথা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সীমান্তের ভেতরে ২০ মাইল পর্যন্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনী কার্যকর থাকবে এবং বিএলএফ দেশের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালন করবে। দেশের ভেতরে যাতায়াতের জন্য সীমান্তে বিএলএফের সদস্যরা নির্দিষ্ট কয়েকটা করিডর ব্যবহার করবেন। বামপন্থীদের ব্যাপারে প্রবাসী সরকারের উৎকণ্ঠা ছিল। বামপন্থীদের অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থী, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিএলএফের নেতারাও সতর্ক ছিলেন, যাতে বামপন্থীরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র না পায়।’ এই প্রসঙ্গে আমরা জেনারেল উবানের বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারি। উবান লিখেছেন, যুবনেতাগণ : স্যার, আমরা আশা করিনি আপনারা নকশালপন্থী ও মার্ক্সবাদীদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রপাতি দেবেন, যাতে আমরা গত ২৫ বছরে যা অর্জন করেছি তা বরবাদ হয়ে যায়। উবান : আপনারা এসব কী বলছেন? যুবনেতাগণ : আপনি বলতে চান আপনি জানেন না যে, নকশালপন্থীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রপাতি দেয়া হচ্ছে... (একটা জায়গার নাম বলে) জায়গায় এবং ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের নেতাদের প্রথম শ্রেণীর ভারতীয় হোটেলে রাখছেন এবং তাঁদের সঙ্গে গল্প-গুজব করছেন। উবান : আমি এমন আজগুবি কথা আগে শুনিনি। আমি সব সময় ভেবেছি, শত্রুর দালাল আমাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাবে। এখন বলেন, আপনাদের মধ্যে এসব গুজব কারা ছড়াচ্ছে? যুবনেতাগণ : আমরা আমাদের নিজেদের চোখে দেখেছি এবং নিজেদের কানে শুনেছি। আমাদের মন ভেঙ্গে গেছে। দয়া করে খবর নিন এবং আমাদের আপনার সরকারের পলিসি জানান। রাশিয়াপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কথা না হয় বোঝা যায়, তারা পুনর্গঠিত হলে যা কিছু হোক কেবল কাগজে-কলমে বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি? জেনারেল উবান যুবনেতাদের মনোভাব আর এন কাওকে জানালেন। কাও উবানকে অবাক করে দিয়ে বললেন, বাস্তবিকই মওলানা ভাসানীর লোকজন কোন এক স্থানে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করা হচ্ছে না। তাঁরা ভাসানীর লোকদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মস্ত সম্পদ হিসাবে দেখছেন। কাও উবানকে পরামর্শ দিলেন, ‘দয়া করে আপনার যুবনেতাদের বলুন যে, পছন্দ না করলেও এটা তাদের গিলতে হবে। আমরা তাদের সমর্থন দেব শুধু সামগ্রিক প্রকল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, একটা স্বাধীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে নয়।’ উবান যুবনেতাদের বললেন যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এমন সবাইকে সাহায্য করছে তাদের নিজেদের অস্থায়ী সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী। কিছু অবাঞ্ছিত লোক এর সুযোগ নিতে পারে এবং এ কারণে তাদের দ্বিগুণ সতর্ক থাকতে হবে। মহিউদ্দিন আহমেদ মুজিব বাহিনীর ভেতরের অনেক তথ্য দিয়েছেন এবং এর ফলে এই বাহিনীটি সম্পর্কে অনেক ভাল ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আলোচনায় ভাসানীপন্থী বা চীনের প্রতি অনুরক্তদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কিঞ্চিত আভাস থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন ঘরানার অংশগ্রহণ করার বিষয়ে তেমন কোন আলোকপাত নেই। গত ২৩ মার্চ ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায়, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। খবরে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনী গঠনের শুরু থেকে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন। একাত্তরের মে মাসে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ‘সশস্ত্র সংগ্রামে নিজ উদ্যোগে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের’ সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের সাহায্যের ফলে গেরিলা বাহিনী প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পায়। বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রধান স্থান ছিল ভারতের অসম রাজ্যের তেজপুরে। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিবেদন অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে প্রায় ১৭ হাজার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন। এর মধ্যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন প্রায় ১২ হাজার, বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে ছিলেন প্রায় পাঁচ হাজার।” খবরে এই বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। খবরটিতে বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে ঘোষণাপত্র পড়ে শোনান ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। এতে বলা হয়, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্রীয় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া বর্তমানে এক অসম্মানজনক ও অমর্যাদাকর অবস্থায় রয়েছে। এ কার্যক্রম দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তির সংহতিকে দুর্বল করছে। সমাবেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টাম-লীর একমাত্র জীবিত সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে সম্মাননা জানানো হয়। তবে ৯৩ বছর বয়সী এ রাজনীতিক অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বাংলাদেশ বাম রাজনীতির বিকাশ ও মুক্তিযুদ্ধসহ এ অঞ্চলের রাজনীতিতে অবদানের কথা স্মরণ করে মোজাফফর আহমদকে এ সম্মাননা দেয়া হচ্ছে। সমাবেশে প্রবীণ রাজনীতিক অজয় রায়, সিপিবির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, বিশেষ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার শাহ আলমসহ শতাধিক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। পরে একটি মিছিল দোয়েল চত্বর-প্রেসক্লাব ঘুরে পল্টন মোড়ে শেষ হয়।” বস্তুতপক্ষে ৭১ সালে একটি সর্বজনীন মুক্তিযুদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের আলাদা সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার প্রভাব বিস্তার ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নেতৃত্ব এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন যুদ্ধের নয় মাসের আগেই ভিন্নভাবে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করে আসছিল। মুজিব বাহিনী তেমন একটি বাহিনী। স্বাধীনতার এত বছর পরও এই বাহিনীর কোন স্বীকৃতি নেই। এই বাহিনীর কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বেশিরভাগই কোন ধরনের স্বীকৃতি পাননি। অনেকেই সনদপত্রের জন্য আবেদনও করেননি। মুজিব বাহিনীর এই অবস্থার জন্য সবার আগেই বলতে হবে যে, এই বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। প্রথমে এদের বৃহৎ অংশটি জাসদে যোগ দেয়। পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান সবার আগে জাসদকে বিপন্ন করে। এরপর এরশাদ একটি জগাখিচুড়ি অবস্থায় দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে কোন তাল সামলাতে পারেনি। বেগম জিয়া কোনভাবেই মুজিব বাহিনীর প্রতি সদয় হবেন এমনটি ভাবা যায় না। এমনকি বর্তমান সরকারও মুজিব বাহিনীকে তার প্রাপ্য সম্মান প্রদানে আগ্রহী হবে সেটিও মনে করা যায় না। ফলে আমার ধারণা মুজিব বাহিনী নামক এই বাহিনীটি স্বীকৃতিহীন একটি যোদ্ধালীগই হয়ে থাকবে। লীগ বলছি এজন্য যে, দেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে এই বাহিনীটিকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবেই নিজেদের পরিচিত করতে হবে। কারণ ওরা জিয়া-এরশাদের রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মানসিকতায় নেই। আমি যদি বিগত সময়কালের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাব যে, মুজিব বাহিনীর অতি সামান্য অংশই আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির বাইরে তাদের নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল। খুশি হতে পারতাম যদি মুজিব বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হতো। এখনও মুজিব বাহিনীর দুই নেতা তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান বেঁচে আছেন। সিরাজুল আলম খান রাজনীতিতে হারিয়ে গেলেও তোফায়েল অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে রাজনীতিতে আছেন। আমি অন্তত তাঁদের কাছে প্রত্যাশা করি যেন তাঁরা তাঁদের হাতে গড়া বাহিনীর সদস্যদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাটুকু দিয়ে যেতে পারেন। সিরাজুল আলম খানের সেই ক্ষমতা না থাকলেও তোফায়েল আহমেদ উদ্যোগ নিলে সেই কাজটি করতে পারবেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা হাসানুল হক ইনুও এখন সরকারে আছেন। তাঁর দলের মাঝেই মুজিব বাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ আছে। তিনিও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন। ঢাকা, ২২ মে, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: ww w.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×