ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মান্নান

উচ্চশিক্ষায় সঙ্কট নেই সমস্যা আছে

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৪ মে ২০১৫

উচ্চশিক্ষায় সঙ্কট নেই সমস্যা আছে

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রসমূহ প্রায়শ সংবাদ শিরোনাম হয় সুযোগের অপ্রতুলতার কারণে নয়, গুণগতমান বজায় রাখতে না পারার কারণে। একাত্তরে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন এই দেশে চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় আর দুটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এই ছয়টিতে আনুমানিক ৩০ হতে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করত। এর সঙ্গে ছিল শ’তিনেক কলেজ, যাতে ৪০ হাজারের মতো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা করার সুযোগ মিলত। গত ৪০ বছরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ বেড়েছে। দেশে এই মুহূর্তে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ১২০টি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে, যেখানে মোট এগারো লাখের মতো ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করার সুযোগ পায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রায় ২২শ’ কলেজে পড়ে ১৯ লাখ শিক্ষার্থী। মোট ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থী এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ালেখা করে। এই বৃদ্ধিটা অনেকাংশে জ্যামিতিক হারে হয়েছে। বলা যেতে পারে, উচ্চশিক্ষার চাহিদা বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে বাড়তে থাকবে। সম্প্রতি ব্রিটেনের বিখ্যাত ইকোনমিস্ট পত্রিকার গবেষণা ইউনিট ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের জন্য শিক্ষার চাহিদার ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে। ইআইইউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এই অঞ্চলে যে হারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার চাহিদা বাড়বে সেই চাহিদা ক্যাম্পাসভিত্তিক সনাতনী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাদের মতে, এর বিকল্প হতে পারে অনলাইনে ডিগ্রী প্রদান। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশেও হতে পারে। তারা আরও বলেছে, বাংলাদেশে যেহেতু ভূমির পরিমাণ কম সেহেতু এখানে ভবন নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাদান কঠিন হবে। তবে ইআইইউর এই সুপারিশ নিকট ভবিষ্যতে আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আর অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে। তদুপরি এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের করাচীতে এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, এটি মূলত অর্থের বিনিময়ে নানা ধরনের ভুয়া বিদেশী অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বিক্রি করত। বাংলাদেশেও ডিগ্রী বিক্রি করার এমন প্রতিষ্ঠান আছে এবং তা অনেকের কাছে বিশেষ করে এক শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তার কাছে বেশ সমাদৃত। এসব ভুয়া ডিগ্রী দিয়ে তারা সরকার থেকে নানা ধরনের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানেই আছে তা নয়, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই আছে। ডিগ্রী যত ওজনদার তার মূল্য তত বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারকে সব সময় শিক্ষাবান্ধব সরকার হিসেবে দেখা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বছরের প্রথম দিনে ৩৪ কোটি বই স্কুল পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দিয়ে বিশ্বে এক নজিরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তাঁর সরকারের আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। বঙ্গবন্ধু সরকারই প্রাইমারী শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে। বর্তমানে দেশের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ১০০ ভাগ বেতন সরকারী কোষাগার থেকে আসে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ছিল শতকরা ২৫ ভাগের মতো, যা বর্তমানে ৭০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগের সম্প্রসারণ ইত্যাদি সাফল্য এই অঞ্চলের অনেক দেশের জন্যই ঈর্ষার কারণ হতে পারে। যদিও শিক্ষার প্রসার, ব্যাপ্তি ও হার বেড়েছে বহুগুণ। একটি জায়গায় গিয়ে এই সাফল্য হোঁচট খেয়েছে। সেটি সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার মান বজায় রাখতে না পারার ব্যর্থতা। কলেজ বলি আর বিশ্ববিদ্যালয়, কোনটিই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না যদি সেখানে শিক্ষার মান বজায় না থাকে। শিক্ষার মান বজায় রাখার প্রাথমিক দায়িত্ব শিক্ষা প্রশাসক আর শিক্ষকদের। শিক্ষাদান একটি কলা ও বিজ্ঞান। এটির দায়িত্বে থাকেন একজন শিক্ষক। ভাল শিক্ষক শিক্ষাক্ষেত্রে না এলে শিক্ষার মান বজায় রাখা কখনও সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হওয়া উচিত জ্ঞান সৃষ্টির উর্বরক্ষেত্র। এই সৃষ্টির জন্য চাই ভাল গবেষক। দুর্ভাগ্যবশত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি তেমন হচ্ছে না। কারণ বর্তমানে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতায় আসার তেমন একটা প্রয়োজন মনে করছেন না। কারণ এই পেশায় এলে তাদের অন্যান্য পেশার চেয়ে সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। এই অভিযোগটি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায়ও অপ্রতুল। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা পৃথক বেতন স্কেল দাবি করে আসছেন। বেশ কয়েকটি সেক্টরে সেই ব্যবস্থা আছে। সম্প্রতি বেতন স্কেলের যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন। সরকারের অনেক নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ইতোপূর্বে ঘোষণা করেছিলেন শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল হবে। তা না হওয়ায় তারা হতাশ হয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পৃথক বেতন স্কেল ছাড়াও আছে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মানের উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ আর গবেষণায় প্রণোদনা, যা বর্তমানে মারাত্মকভাবে অপ্রতুল। অবশ্য বর্তমান সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধির বেশ একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে আছে, যা ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা। সাফল্যের সঙ্গে তা বাস্তবায়ন হলে তার সুফল পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার উন্নতি হয়েছে। শিক্ষায় অর্থ ব্যয় খরচ হিসেবে না দেখে তা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা উচিত। এই একটি কারণে ভারত, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অনেক ওপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ যদি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে চায় তাহলে মানবসম্পদ উন্নয়নে অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। কৃষিতে সুষ্ঠু বিনিয়োগের কারণে আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে উন্নীত হয়েছে। দেশে তরুণ আর যুব বয়সের মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। এদের মানসম্মত মেধাবী মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। আর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে চলছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তার। হতে পারেন তিনি একজন হেডমাস্টার অথবা উপাচার্য। এক্ষেত্রে তা সর্বক্ষেত্রে সঠিকভাবে হচ্ছে না। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বর্তমানে তেমন একটা সঙ্কট নেই, তবে সমস্যা আছে। তবে একটু চেষ্টা করলে তা নিরাময়যোগ্য। লেখক : ইউজিসির চেয়ারম্যান ২৩ মে, ২০১৫
×