ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোদির সাক্ষাত পেতে জোর চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৩ মে ২০১৫

মোদির সাক্ষাত পেতে জোর চেষ্টা করছেন খালেদা  জিয়া

শরীফুল ইসলাম ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের আশ্বাস পাচ্ছেন না বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তবে যে কোনভাবে সাক্ষাত পেতে খালেদা জিয়ার পক্ষে দেশ-বিদেশে জোর লবিং চলছে। বিশেষ করে লন্ডন থেকে ছেলে তারেক রহমান বিজেপির কয়েক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। জানা যায়, ৬ জুন ঢাকা সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সফরটি দু’দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সফরেই দু’দেশের মধ্যে বিরাজমান বেশ ক’টি সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হবে। তাই নরেন্দ্র মোদির এ সফর নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে এমনটিই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ কারণেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও চাচ্ছেন মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে যেতে। সেইসঙ্গে এর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত অনুষ্ঠানে না গিয়ে যে ভুল করেছিলেন তা শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে। সূত্র মতে, প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সাক্ষাত করতে না যাওয়ার বিষয়টিকে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ সে দেশের মানুষ ভালভাবে নেননি। তবে খালেদা জিয়া মনে করেছিলেন যেহেতু কংগ্রেস সরকারের সময় এ ঘটনাটি ঘটেছিল তাই বিজেপি সরকার হয়তো এ ঘটনাকে খুব বেশি মনে রাখবে না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে বিএনপি নেতারা টের পাচ্ছেন সে সময় খালেদা জিয়া কি ভুল করেছিলেন। আর এ ভুলের মাসুল আরও অনেকদিন বিএনপিকে গুণতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সেনারগাঁও হোটেলে গিয়ে সাক্ষাত করার কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার। সেদিন ছিল ২০ দলীয় জোটে বিএনপির শরিক দল জামায়াতের হরতাল। হরতালের মধ্যে গাড়িবহর নিয়ে গুলশানের বাসা থেকে সোনারগাঁও হোটেলে গেলে হরতাল ভঙ্গ করা হবে এবং এ জন্য দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত নাখোশ হবে বলে সেদিন খালেদা জিয়া প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে না গিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করেন। তবে খালেদা জিয়ার এ অবস্থানে খোদ বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা নাখোশ হলেও জামায়াতের নেতাকর্মীরা বেজায় খুশি হন। প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাত অনুষ্ঠানে না গিয়ে খালেদা জিয়া যে অসৌজন্যতা দেখিয়েছেন তা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া এ নিয়ে সোচ্চার হয়। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী দেশ এগিয়ে এলেও প্রতিবেশি দেশ ভারত এ বিষয়ে কোন সাড়া দেয়নি। বরং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তখন বরাবরই বলা হয় বাংলাদেশ সরকার সংবিধান অনুসারে নির্বাচন করলে এতে তাদের কোন আপত্তি নেই। প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারতের এ অবস্থানের কারণে বিএনপির কূটনৈতিক মিশন ব্যর্থ হয়। এর ফলে বিএনপি জোটের লাগাতার আন্দোলনসহ নির্বাচন বয়কটের হুমকি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে ফেলে। নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আগের মতই দাপটের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরও বিএনপি বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থনের পাশাপাশি ভারতের সমর্থন আদায় করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কৌশল নেয়। বিশেষ করে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপি সেদেশের সমর্থন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ থেকে সবার আগে নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অপরদিকে লন্ডন থেকে তারেক রহমানও নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির প্রভাবশালী নেতাদের অভিনন্দন জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির যে শপথ অনুষ্ঠান হয় সে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। জানা যায়, প্রণব মুখার্জী শুধু রাষ্ট্রপতি হিসেবেই নন, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তাই কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রণব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেও তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যথার্থ সম্মান বা শ্রদ্ধার জায়গায় রেখেছেন। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে প্রণব মুখার্জীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে দেশাত্ববোধ ও সৌজন্যবোধের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন নরেন্দ্র মোদি। তাই প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের পর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সহজে যে সাক্ষাত পাবেন না এমনটি খালেদা জিয়ায়ও মনে করছেন। তারপরও তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু যে প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে খালেদা জিয়া সাক্ষাত না করার কারণেই বিএনপির প্রতি বিজেপি ক্ষুব্ধ তা নয়। আরও একটি কারণে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার প্রতি বিজেপি ক্ষুব্ধ। আর তা হচ্ছে খালেদা জিয়া বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান কালে ৭ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। পরদিন দেশ-বিদেশের মিডিয়ায়ও এ খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অমিত শাহর পক্ষ থেকে এ খবর ডাহা মিথ্যা বলে জানালে খালেদা জিয়া ও বিএনপি রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে। খালেদা জিয়া ও বিএনপির পক্ষ থেকে অমিত শাহকে নিয়ে এভাবে মিথ্যাচার করার বিষয়টিকে বিজেপি, নরেন্দ্র মোদির সরকার এবং ভারতবাসীরা ভালভাবে নেয়নি। তাই এবার নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে খালেদা জিয়া যখন তার সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়ার চেষ্টা চালান তখনই পূর্বের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। এ কারণেই মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত এখনও অনিশ্চিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে খালেদা জিয়া যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কূটনৈতিকরা এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ ভারত এ বিষয়ে কোন সাড়া দিচ্ছেন না। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় বিএনপি। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়া সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ পেলে বিএনপির রাজনীতির জন্য একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়বে। এতে বিএনপি কূটনৈতিক সফলতাসহ বিভিন্নভাবে লাভবান হবে। এ কারণেই বিভিন্ন মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত পাওয়ার বিষয়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত বছর ঢাকা সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের আনুষ্ঠানিক সিডিউল না পেয়ে বিজেপি সরকারের কাছ থেকে প্রথম ধাক্কাটি খান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। পরে অবশ্য অনেক দেনদরবার করে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ পান। তবে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এভাবে অনুনয় বিনয় করে প্রতিবেশি দেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনাও কম হয়নি। তারপরও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদসহ ক’জন দলীয় নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শমসের মবিন চৌধুরীও এখন চেষ্টা চালাতে পারবেন। এ ছাড়া ল-ন থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে তারেক রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকও চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এখন বিরোধী দলের নেতাও নন। এখন বিরোধী দলের নেতা হচ্ছেন জাতীয় পার্টির নেতা বেগম রওশন এরশাদ। আর সরকার ও বিরোধী দলের বাইরে থাকলে যে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়া সহজ নয় তা খালেদা জিয়াও জানেন। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন হিসেবে তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে আসবেন ৬ জুন। এর ১০ দিন আগে ঢাকায় এসে তিনি কি কি করবেন সে কর্মসূচী চূড়ান্ত হবে। তাই খালেদা জিয়া নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়ার বিষয়ে আর মাত্র কয়েকদিন সময় পাবেন। তবে শুক্রবার বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী মুক্তি পেয়েছেন। মূলত তিনিই বিএনপির পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যক্রম দেখভাল করেন। তার সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন মহলে সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই শমসের মবিন চৌধুরী মনেপ্রাণে চেষ্টা করলে হয়ত শেষ মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের বিষয়ে সুখবর মিলতে পারে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
×