ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কুমিল্লায় বিলীনের পথে কবি নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৩ মে ২০১৫

কুমিল্লায় বিলীনের পথে কবি নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন

বাংলানিউজ ॥ দীর্ঘ ২৩ বছর পর কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুলের ১৬৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর দু’দিন পরই নজরুলের জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে নগরজুড়ে চলছে সাজসজ্জা আর উৎসবের আমেজ। অথচ যাকে বা যার কর্মকাণ্ড নিয়ে এ আয়োজন যেন তারই কেউ খোঁজ নিচ্ছেন না! নজরুলের জীবন ও সাহিত্য কর্মের বিরাট অধ্যায় জুড়ে রয়েছে কুমিল্লায়। কুমিল্লায় নজরুলের স্মৃতিফলকগুলো তারই সত্যতা প্রমাণ করে। কুমিল্লায় নগরজুড়ে নজরুলের স্মৃতি বহনকারী ১২টি ফলক রয়েছে, যার মধ্যে ১০টিরই বেহাল দশা। এর মধ্যে কয়েকটা স্মৃতিফলক কবে যে তুলে ফেলা দেয়া হয়েছে, তা কেউ খবরই রাখেনি। বেহাল দশায় রয়েছে মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুলের বাসরঘরসহ স্মৃতিফলকগুলো। কুমিল্লায় কবি নজরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। তিনি পাঁটবার কুমিল্লায় এসেছিলেন। নজরুলের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনও ঘটেছিল কুমিল্লাতেই। দুই মহীয়সী নারীর পাণি গ্রহণ করে কুমিল্লার সঙ্গে তার ঘটেছিল চিরায়ত নারীর সংযোগ। ধ্বংসের পথে নজরুলের স্মৃতিফলক ॥ ধূমকেতুর মতো উদ্ভাসিত কবি নজরুল ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচবারে মোট ১১ মাস কাটিয়েছিলেন কুমিল্লায়। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম কুমিল্লায় আসেন তিনি। সে যাত্রায় দৌলতপুর অবস্থান করেন তিন মাস। দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নবেম্বর থেকে ডিসেম্বর, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ২৩ নবেম্বর, পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলে যাওয়ার তারিখ ছিল অজ্ঞাত। নজরুলের প্রেম, বিয়ে-বিচ্ছেদ, গ্রেফতার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতি চর্চাসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী এ কুমিল্লা শহর। নগরীর ঝাউতলা সড়কের শেষপ্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার বেশ কিছু লাইন সম্বলিত ফলক তৈরি করা হয়েছিল; যে কবিতার জন্য কবি ১৯২২ সালের ২৩ নবেম্বর গ্রেফতার হয়েছিলেন। নজরুল যতবারই কুমিল্লায় এসেছেন, প্রতিবারই তিনি উঠেছেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে অর্থাৎ প্রমীলাদের বাড়িতে। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর এ্যাপ্রোচ রেলস্টেশন সড়কটি নজরুলের নামে নামকরণ করে রাখা হয় ‘নজরুল এ্যাভিনিউ’। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয়, বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সঙ্গে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন। সেখানে স্থাপিত নজরুল ফলকটির পাশেই পৌরসভার ডাস্টবিন! প্রমীলাদের বাড়ির পুকুরটি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা। বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। পুকুরপাড় ও রাস্তার পাশের স্মৃতিফলকটি ব্যবসায়ীরা সরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যানিকেতনের সামনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেখানে স্মৃতিফলকের ওপর পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়ার কারণে সেটা আর দেখা যাচ্ছে না। আর সে কারণে স্মৃতিফলকের সামনে প্রায় সময়ই তরমুজ-আম বিক্রেতা ভ্যানে করে দোকান সাজিয়ে বেচাকেনার কাজ করে। কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সঙ্গীত জলসায় অংশ নিয়েছেন। ‘নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। ফলকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিশে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেকেই গান গেয়েছেন। মুরাদনগরেও একই চিত্র ॥ বিয়ের রাতেই নজরুল অজ্ঞাত কারণে দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেক স্মৃতিচিহ্ন। সেই সব স্মৃতিময় গাছ, ঘাট, বাসরঘর, খাট প্রভৃতির সৌন্দর্য মলিন হতে বসেছে। বাসরঘরের খাটে এখন মানুষ ঘুমায়। সেখানে তার ব্যবহার্য সব জিনিসপত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসরঘরটিও আগের অবস্থায় নেই। পুরোটা প্রায় ভঙ্গুর। যে আম গাছের নিচে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন, সেটি মরে গেছে। আলী আকবর খাঁন মেমোরিয়াল ভবনটিও ধ্বংসের শেষপ্রান্তে। এটি সংস্কার ও সংরক্ষণ অতি জরুরী বলে মনে করছেন নজরুলপ্রেমীরা। নজরুল স্মৃতিস্মারক চুরি ॥ নগরীর পার্কের পাশে রাণীরকুঠি সংলগ্ন স্থানে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এ কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় অবস্থিত পাঠাগার থেকে এক মাস আগে নজরুল স্মৃতিস্মারকটি চুরি হয়ে গেছে, যা নজরুলপ্রেমীদের জন্য ঢাকা থেকে আনা হয়েছিল। কুমিল্লা নজরুল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক অশোক বড়ুয়া জানান, কুমিল্লা নগরীতে নজরুলের ১২টি স্মৃতিফলকের বেহাল দশা। সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ নজরুল এ্যাভিনিউ ও রাণীরদীঘির পাড়ে দুটি স্মৃতিফলকের সংস্কার কাজ করছে। বাকি ১০টি ফলকের সংস্কার কাজের জন্য সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কাছে আবেদন করেছি। এই ফলকগুলো দ্রুত সংস্কার করা উচিত। স্মৃতিস্মারক চুরির বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়ে আমরা কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। পুলিশ বিষয়টি দেখছে। কুমিল্লার নজরুলপ্রেমীদের মনে কিছুটা আশার আলোও দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি অবশেষে পূরণ হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার ২৫ মে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। এর আগে ১৯৯২ সালে প্রথম কুমিল্লায় জাতীয়ভাবে নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী একবার উদযাপন করা হয়েছিল।
×