ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাবুকের কত জোর জানতে ইচ্ছে করে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২১ মে ২০১৫

চাবুকের কত জোর জানতে ইচ্ছে করে

আঠারো মে পেরিয়ে সময়ের ঘড়িটা যখন উনিশ মের ঘরে পা রেখে আরও এক ঘণ্টা অতিক্রম করলো তখন বিমানের চাকা বাংলাদেশের ভূমি স্পর্শ করেছে। ক্লান্ত দেহ এবং ক্ষুব্ধ ও বিষণœ মন নিয়ে নামলাম বিমান থেকে। বিষণœ এবং ক্ষুব্ধ হওয়ার সঙ্গত কারণ আছে বলে আমার অন্তত মনে হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে জানলাম, একজন সংসদ সদস্য নাকি জাফর ইকবালকে চাবুক মারার ইচ্ছে পোষণ করেছেন! কী অপরাধ জাফর ইকবালের? মুক্তচিন্তার ধারক ব্লগার অনন্তকে যখন মৌলবাদী জঙ্গীরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করলো তখন তার প্রতিবাদ করেছিলেন জাফর ইকবাল। সজীব ওয়াজেদ জয়কে রয়টার থেকে ব্লগার খুন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক হলেও জাফর ইকবালের প্রতিক্রিয়াটি অসত্য বলা যাবে না বলে আমি মনে করি। যতদূর জানি, ঐ সংসদ সদস্য জাফর ইকবালকে চাবুক মারার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন কোনও প্রকার প্ররোচনা ব্যতিরেকেই। জয়-এর রয়টারের সাক্ষাৎকার প্রকাশের কিছু পরের ঘটনা এবং তার সঙ্গে ঐ সংসদ সদস্যের চাবকানোর খায়েশ ব্যক্ত করার কোনই সম্পর্ক নেই। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তার কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গ এবং নিজস্ব বশংবদ কর্মীদের ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছাপ লাগিয়ে অধিকতর অশ্লীল, কুৎসিত, অরুচিকর, অগ্রহণযোগ্য মিছিল ও সেøাগানের আয়োজন করে এর সঙ্গে জয়-এর বক্তব্য সম্পর্কে জাফর ইকবালের হতাশাকে জুড়ে দিয়ে নিজের অসংবৃত আচরণকে যৌক্তিক প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঐ সংসদ সদস্য সম্ভবত এটা বোঝার মতো বুদ্ধি রাখেন না যে, তাঁর এই পদপ্রাপ্তির পেছনে জাফর ইকবালদের মতো অনেক মুক্ত চেতনাসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তিনি সম্ভবত এটাও বোঝেন না যে, তার ঐ চাবুকের আঘাত আমার মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসংখ্য মানুষের সর্বশরীর রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করেছে। আমার ধারণা এটা বোঝার ক্ষমতাও তাঁর নেই যে, এই উক্তির মাধ্যমে তিনি এ দেশের লক্ষ কোটি তরুণ প্রজন্ম যারা জাফর ইকবালের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশকে চিনতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধুকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধুকন্যার আন্তরিকতার ওপর আস্থা রাখতে শিখেছে, তারা কী প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়েছে! এই জাফর ইকবালই তাদের শিখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, জেলায় জেলায় তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে, চিনিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির স্বরূপ এবং রূপান্তর। তিনি যাঁকে চাবুক মারতে চেয়েছেন সেই জাফর ইকবাল বিদেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর বিদেশে অর্থসম্পদ বৈভবের প্রলোভন উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষিত স্ত্রীকে সঙ্গী করে দেশে এসেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিত্তের হাতছানি অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে সিলেটের শাহ্্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর শিক্ষা এবং জ্ঞান বিতরণের আশ্রয় হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, সুস্থ শিক্ষার জন্য, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য, নতুন প্রজন্মকে সত্য ও ন্যায়ের সাধকে পরিণত করার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন। সিলেটের যে সংসদ সদস্যটি জাফর ইকবালকে চাবুক মারার কথা বলেছেন তিনিও বহুকাল বিদেশেই ছিলেন বলে শুনেছি। তিনি দেশে ফিরেছেন চলতি হাওয়ার পন্থী হিসেবে এবং শেখ হাসিনার বদান্যতায় ও আওয়ামী লীগের হয়তো কারও কল্যাণে সংসদ সদস্য হিসেবে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য। এখানেই জাফর ইকবালের সঙ্গে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পার্থক্য। এখানেই পার্থক্য সুচিন্তার আর স্বার্থচিন্তার। জাফর ইকবালের পিতা ছিলেন শহীদ। একাত্তরে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো কারণ তিনি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদে থেকেও কুণ্ঠাহীনভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সহায়তা করেছিলেন। তাই তাঁর সন্তানদের প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নিঃশর্তভাবে নিষ্ঠাবান। আর যিনি তাঁকে চাবকানোর কথা বলেন তাঁর পিতৃ পরিচয় কি? কী ভূমিকা ছিলো তাঁর একাত্তরে? সেই সাংসদ কি তাঁর পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার জন্যই রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন? এই সংসদ সদস্যটির চাবুক কতখানি শক্ত এবং জোরালো তা জানতে ইচ্ছে করে। কতজনকে চাবকাবেন তিনি? একজনকে, দশ জনকে, একশ’ জন, হাজারজন, লক্ষ জনকে? তিনি হয়তো জানেনই না তিনি যে দলের সংসদ সদস্য সেই দলের প্রধান মানুষটি জাফর ইকবাল সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করেন। আমি জানি না, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিংবা যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উল্লিখিত সংসদ সদস্যের অনুরক্ত কতিপয় অপরিণামদর্শী আঞ্চলিক সদস্যের বালখিল্যের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবেন কি-না কিংবা ঐ সংসদ সদস্য তাঁর আচরণের জন্য তিরস্কৃত হবেন কি-না। তবে কতিপয় সাংসদের কথাবার্তা এবং ভাবভঙ্গিতে একটি জিনিস প্রতীয়মান হয়, তাঁরা বিশেষ পরিস্থিতির কারণে কিংবা কোনও সবিশেষ আনুকূল্যের দরুন যে সংসদ সদস্য হওয়ার ভাগ্য লাভ করেছেন সেটা ভুলেই যান। তারা অতি দক্ষতার সঙ্গে বন্ধুকে শত্রুতে পরিণত করে ফেলেন। দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান কৌশলে কুক্ষিগত করে তারা অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে সংগঠনকে মিত্রহীন, বন্ধুহীন, সঙ্গীহীন এবং সঙ্গিন করে তোলেন। যদি কোন বিশ্লেষক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থানকে বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন কেবলমাত্র গত এক দশকে এই হাইব্রিডদের অসীম কৃপায় তারা কী পরিমাণ মিত্র হারিয়েছে। যাদের সখ্য এই দলটির জন্য অপরিহার্য ছিলো, যাদের পরামর্শ এই দলটির জন্য মূল্যবান ছিলো, যাদের সমর্থন এই দলটির পরিচালনাকে গতিশীল করতে পারতো তাদের অনেকে এখন নিষ্ক্রিয় এবং নীরব হয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে একদল অদৃশ্য ঘুণপোকা। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের দল, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার এবং নেতৃত্বদানের দল। অথচ গত দশ বছরেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি সবচাইতে বেশি বিভক্ত হয়েছে। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা কিংবদন্তিতুল্য সন্দেহ নেই, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে ঈর্ষাউদ্রেগকারী সাফল্য অর্জন করে চলেছে, তাতেও কোনও বিতর্ক নেই। কিন্তু প্রদীপের নিচে যদি থাকে অন্ধকার তাহলে তো অস্তিত্ববিনাশী অপশক্তি বাসা বাঁধবে ওখানেই। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে একজন জাফর ইকবাল কিন্তু একক ব্যক্তি শুধু নয় একটি বিশাল তরুণ প্রজন্মের বাতিঘর। ঐ বাচাল সংসদ সদস্যের মত লোক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু এসেছে এবং গেছে। কিন্তু একজন জাফর ইকবালকে পেতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অতএব সময় থাকতেই এ পাপের স্খালন প্রয়োজন। স্নেহভাজন জাফর ইকবালকে বলি রবীন্দ্রনাথের ‘কনিকা’র দু’টি চরণ স্মরণ করতে। “পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয় পেলে কোনো ছুতা জান না আমার সাথে সূর্যের শত্রুতা?” আসলেই পেঁচার শত্রুতায় সূর্যের কি কিছু যায় আসে? [১৯ মে, ২০১৫]
×