ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নভেরা আহমেদ : স্বস্থানচ্যুত বিরল এক প্রতিভা

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৯ মে ২০১৫

নভেরা আহমেদ : স্বস্থানচ্যুত বিরল এক প্রতিভা

মনে হয় তাঁকে একবার দেখেছিলাম। এখনকার অযতেœ পড়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের পূর্বদিকের স্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা গেটটির কাছে। সে সময়ে, প্রায় ৬৫ বছর আগে এই গেটটা ছিল তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক লাইব্রেরী’ ভবন। অতি চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই প্রথমে পরিসর বারান্দা ছিল। সেখানে প্রয়োজনে চেয়ার এনে গ্রন্থাগারিককে পরিষদসহ খোলা বাতাসে সভাও করতে দেখেছি। একটা মাঠও দালানটিকে ঘিরে থাকত। হাতে ঘাস কাটা হতো নিয়মিত। আমরা সেখানেই বসে অনেক সময় কাটিয়েছি। উত্তর দিকে একটা বেড়ার ছাপড়া ছিলÑ সেখানে ক্যান্টিনের অভাব মেটাত ওই ছাপড়ার মালিক। তাঁর নামটা মনে নেই, কিন্তু মধুর মতোই ছাত্রবৎসল ছিলেন তিনি। সিঙ্গারা পাওয়া যেত আর সেইসঙ্গে দুধ চা। সেই বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলে একটা ‘অডিটোরিয়ামে’ যাওয়া যেত। সেখানে ছাত্র থাকাকালে একটিমাত্র সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এখন সেটা নাটঘর হয়ে গ্রন্থাগারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দোতলায় যাওয়ার জন্য একটা মজার সিঁড়ি ছিল, সেখানে কোন চিরাচরিত ‘স্টেপ’ বা থাক ছিল না। ওপরে অফিস, সেখানে আমাদের জন্য ‘প্রবেশ নিষেধ’ হলেও আমরা কয়েকজন ওই স্তরবিহীন সিঁড়িতে ওঠা-নামা করতাম। নিচে রিডিংরুমটা ছিল চমৎকার। খোলা শেলফ, সুন্দর ঝকঝকে টেবিল। এখনও সেই সিঁড়ি আর লম্বা রিডিংরুম আছে, কিন্তু এখনকার দর্শনার্থী যা দেখবেন তাতে ব্যবস্থাপনার অমনোযোগের বিকট উদাহরণ দেখবেন। সে যাই হোক, এই চমৎকার দালানটাকে আমার মতে মহিমান্বিত করে তুলেছিল শ্বেতপাথরে খোদাই করা একঝাঁক ভাস্কর্য। ঘাসের ওপর শান্ত সমাহিতভাবে বসে আছে যারা, তারা সম্ভবত বেশিরভাগই নারী, পুরুষও আছে। সবগুলোর ভঙ্গিই একটা নান্দনিকতা সৃষ্টি করছে। তাকিয়ে থেকেছি অনেকক্ষণ, কিন্তু কিছু কী বুঝেছিলাম? তবে না বুঝলেও মনে হতো প্রতিটি ভাস্কর্য একটা অভিব্যক্তিÑ কোন অব্যক্ত কিছুর প্রকাশ। যেটা বুঝতাম না সেটা হলো সবগুলোর দেহেই একটা বড় গোলাকৃতি শূন্য। তখন হেনরি মুর দেখিনি, তবে বিজ্ঞ বন্ধু একজন বলল, এসব হেনরি মুরের স্টাইলের ভাস্কর্য। তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরীর মাঠে সেই ভাস্কর্যগুলোর (ও দালানের ভেতরে দুটি) শিল্পী ছিলেন ‘নভেরা আহমেদ’। নভেরা নামটার নতুনত্বই আমাকে বিমোহিত করেছিল। সে সময় বর্তমানের ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউট ছিল একটা স্কুল মাত্র। তা হলেও স্কুলটি ছিল নামী-দামী সব শিল্পীতে ভরপুর। তাদের সঙ্গে তেমন পরিচয় না থাকলেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী ও আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। কিন্তু নভেরা আহমেদ ছিলেন দূর নক্ষত্রÑ তাকে স্বচক্ষে দেখিনি। শুনেছি যে, তিনি প্রায় সবসময়েই বিদেশে থাকেন, ইউরোপের শিল্পনগরী প্যারিসে। ১৯৬৪ সালে আমি নিজে বিদেশে চলে গেলাম। কয়েক দফা দেশে ফেরার পরে ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে চাকরি পেয়ে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরলাম। সেই সুন্দর স্থাপত্য-নিদর্শন পাবলিক লাইব্রেরী এখন এই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের একটা অংশÑ দালান আলাদা ছিল বলে একটা করিডর তৈরি করে যোগ সাধন করা হয়েছে। হাল খুবই করুণ, বিশেষ করে আমার চোখে তখনও ষাট দশকের নভেরা আহমেদ পরিবেষ্টিত দালানটাই মনে জেগে ছিল। প্রায় বত্রিশ বছরের ব্যবধানে ফিরে এসে অবাক বিস্ময়ে দেখেছি, নভেরা আহমেদ তখনও আছেন। সেই মজাদার সিঁড়ির পাশের ছোট গোলাকার স্থানে একটা এবং জঙ্গল হয়ে ওঠা চারদিকের মাঠে বড় বড় ঘাস আর কাঁটা ঝোপের আড়ালে কয়েকটা। যতই অযতনে হোক আর সংখ্যায় কমে গেলেও, আমি প্রীত হলাম। ভাবলাম, এবার আমি ম্যানেজমেন্টকে রাজি করিয়ে এই কয়েকটা ভাস্কর্য পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করব। বিধিবাম। কয়েক মাস পরেই লাইব্রেরী কমিটির ফুল মিটিংয়ে উপচার্যের সভাপতিত্বের এজেন্ডায় ‘নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য অপসারণ’ দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। কর্তৃপক্ষের যুক্তি হলো, এই ভাস্কর্যগুলো আর এখানে মানায় না। এগুলো চারুকলা ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা যায়। জনৈক সদস্য বললেন, এসবের যতœ নেয়া হয় না কেন? ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক লোকবলের অভাবের কথা বললেন। আমার দুঃখ লাগল খুব। আমি নতুন আসা পরিকল্পনা গ্রন্থাগারিক হিসেবে বললাম, যতœ নেয়া হয় না বলে এই ভাস্কর্য চারুকলা ভবনে দেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। কারণ ঐতিহাসিকভাবে এই ভাস্কর্যগুলো পূর্বের দালানটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করা উচিত। এসব এখান থেকে সরালে আমরা একটা ঐতিহ্য হারাব। আমি তখন অল্পদিন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি। কোন সদস্যই আমার পক্ষে বললেন না। সবাই চুপ রইলেন। উপাচার্য মূল প্রস্তাব পাস করিয়ে দিলেন। এর কয়েকদিন পরে, অতি দ্রুতই বলব, অনেক ‘কামলা’ লাগিয়ে নভেরা আহমেদকে তাঁর আদি বাসস্থান থেকে সরানো হলো। ভাবলাম, লোকবল নাই বলে যতœ নেয়া হতো না, এখন রাতারাতি লোকবল পাওয়া গেল কোন্ মন্ত্রেÑ নিশ্চয়ই নারী ও শিল্প-সংস্কৃতি বিদ্বেষী লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট ত্রিশ বছর ধরে অযতেœ ফেলে রেখে ভাস্কর্যগুলো সরাতে বলে। তাহলে চার পাশের অযতেœ ফেলে রাখা মাঠও সরিয়ে ফেলা উচিত ছিল। আসলে নভেরা আহমেদ স্থানচ্যুত হয়েছেন বার বার। তার জীবনী লিখবে এমন কেউ কি আছেন? মাঝে মাঝে আনা ইসলামের নাম শুনি, তিনি কি ছোট প্রবন্ধ ছাড়া নভেরার জীবনী লিখবেন? তিনি বা অন্য কেউ গবেষণা করে লিখলে হয়ত দেখা যেত, এই অত্যাশ্চার্য প্রতিভা ও নিরলস শিল্পচর্চায় নিয়োজিত স্বীয়কাল উত্তরিত একজন বাঙালীর প্রথম বড় পরিসরে ভাস্করকর্ম এই উপমহাদেশে একটা বিরল উদাহরণ। অনেকে লেখেন তিনি নারী ভাস্কর। আমি তা মনে করি না। নারীত্ব এখানে বিষয় নয়, তিনি ছিলেন সত্যিকারের শিল্পী। আমার কাছে তিনি শুধুই শিল্পী, বাঙালী বলে আমি গর্ব অনুভব করি। তার জন্য আমি আরও গর্বিত যে, একুশের শহীদ মিনারের থিম সৃষ্টিতে তার বড় অবদান আছে। স্বাধীন বাংলাদেশ তার প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছে। নভেরা পেয়েছেন একুশে পদক। কিন্তু তিনি যেমন স্বস্থানচ্যুত ছিলেন, তেমনি রয়ে গেলেন সারা জীবন। লাইব্রেরী কমিটির মিটিংয়ে আমি যৌক্তিক বক্তব্য রেখেও অন্যদের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালে তাকে আবার স্থানচ্যুত করা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে। হ্যাঁ, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই রইলেন! কিন্তু মাত্র একটা দালান পরে তাকে সরিয়ে ‘কমিটি’ কী অর্জন করেছিল? কিছুই না, বরঞ্চ প্রকট করেছিল কিছু সঙ্কীর্ণতা। নভেরার একটা বিশেষত্ব আমাকে সবসময় ভাবিত করত, তার কোন ছবিতেই তাকে হাসতে দেখিনি। তারপরেও নভেরা নিজেকে সব পঙ্কিলতা, সঙ্কীর্ণতা ও কূপম-ূকতার উর্ধে তুলে রেখেছিলেন। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতি-গবেষক
×