ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

অনন্ত আমরা চুপ থাকব না

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৯ মে ২০১৫

অনন্ত আমরা চুপ থাকব না

প্রকৃতি জগতের বিবর্তনবাদী ব্যাখ্যা বিজ্ঞান-সম্মতভাবে হাজির করে চার্লস ডারউইন চিন্তার জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন, তারই সার্থক উত্তরসূরী ফ্রান্সিসকো জোসে আয়ালা। বলা হয়, বিবর্তনবাদী প্রাণবিজ্ঞানে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছেন তিনি। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রাক্তন ছাত্র অনন্ত বিজয় দাশ ও সিদ্ধার্থ ধর আয়ালার একটি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করে। অনন্ত সমাজকর্ম বিভাগ থেকে মাস্টার্স করার পর সিলেটের একটি স্থানীয় ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র সে নয়। কিন্তু বিবর্তনবাদী প্রাণবিজ্ঞানের জটিল বিষয়াদি অধ্যয়নই শুধু সে করেনি, ইংরেজী থেকে বাংলায় তা অনুবাদ করেছে সিদ্ধার্থের সঙ্গে। ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’ বইটি পাঠক সমাদর পেয়েছিল। ব্লগার রাসেল আল মাসুদ বিডিনিউজ-২৪-এ লিখেছে, সাস্ট ক্যাম্পাসে আয়োজিত বইমেলায় সবার আগে ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’ বইটির সব কপি শেষ হয়ে যায়। এটাকে একটি শুভবার্তা হিসেবেই সে দেখেছিল। বলেছে, ‘বুঝলাম আমার আশপাশের মানুষজন চিন্তাশীলতার দিকে ঝুঁকছে, বিজ্ঞানমনস্কতার দিকে ঝুঁকছে।’ তারপর একেবারে দিনের আলোয় চাপাতির কোপে অনন্ত বিজয় দাশের নিহত হওয়ার পর রাসেল লিখেছে, ‘এটাও একটা মেসেজ। আপনি চুপ থাকুন। আপনি যদি মুখ খোলেন, যদি চিন্তার কথা বলেন, বিজ্ঞানের কথা বলেন, মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলেন, তবে আপনাকেও এই পরিণতি বহন করতে হবে। ... যদি বাঁচতে চান, চুপ থাকুন। দরকার হলে নিজের টুঁটি নিজেই চেপে ধরে চুপ থাকুন। এই দেশে কোন কথা বলা প্রাণীর স্থান নেই।’ রাসেলের লেখার শুরুতে একটা ছবি আছে। প্রথমে চিনতে পারিনি। শান্ত-সমাহিত এক তরুণ ঘুমিয়ে আছে। তার মুখটি শুধু খোলা। নির্মীলিত চোখের ওপর দুটো সবুজ পাতা। প্রকৃতির প্রতীক সবুজ পত্রাবলি। এ ধরিত্রীতে প্রাণ সৃষ্টির আগে সূর্যের আলো-তাপ শুধুই হারিয়ে যেত শূন্যতায়। বাড়াত এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা। সালোক-সংশ্লেষি উদ্ভিদ ও কিছু এক কোষী প্রজাতি সূর্য আলোর সামান্য কিছু শক্তিকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করল। শৃঙ্খলা আনল এই পৃথিবীতে। সে জন্যই মহাবিশ্বের এই গ্রহে প্রাণময়তা। মাতা ধরিত্রীর সেসব শৃঙ্খলা জানতে চেয়েছিল অনন্ত বিজয় দাশ। তাই সমাজকর্ম পড়েও প্রকৃতি বিজ্ঞানের গভীরে সে প্রবেশ করেছিল। মানুষ মানুষকে কেন মেরে ফেলে? কেন প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ করে প্রবুদ্ধ মানুষ? ধর্মের নামে দুনিয়াজুড়ে কেন এত হত্যাকাণ্ড? কাফের আখ্যা মাথায় নিয়ে কেন ইবনে সিনাকে দেশান্তরী হতে হয়? আবার ভিন্ন সময়ে সেই ইবনে সিনাকে মহিমান্বিত করে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। তার নামে বানায় ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেসব কথা জানতে চেয়েছে, জানাতে চেয়েছে অনন্ত। চুপ করে থাকতে বলেছে সমাজ। ‘অদ্ভুত আঁধারে’ যেসব অন্ধ সবচেয়ে বেশি দেখে, তারা চুপ করে থাকতে বলেছে, মৃত্যুভয় দেখিয়েছে। অনন্ত চুপ থাকেনি। যেমন থাকেননি তাঁর পূর্বসূরী হুমায়ুন আজাদ, রাজীব, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর বাবুর মতো অনেকেই। ঘাতকের চাপাতির আঘাতে তাই অনন্তের নিহত হওয়া। প্রকৃতির যে সবুজ থেকে অনন্তের আগমন, বন্ধ চোখের ওপর সেই সবুজ পত্র ধারণ করে অনন্ত ফিরে যাচ্ছে প্রকৃতির অনন্তলোকে। যখন যাওয়ার সময় হয়নি। বড় অসময়ে। গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে, এসব মৃত্যুর কারণ কি শুধু মৌলবাদী জঙ্গীদের চাপাতি? আর কারও কি কোন দায় নেই? রাষ্ট্রের, রাজনীতিবিদের, সরকারপ্রধান বা ভবিষ্যত সরকারপ্রধানদের, এমনকি নাগরিক সমাজের? এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগের সমাজটি কেমন ছিল? ফার্মগেটের কাছে একটি বাড়ির নাম মনে পড়ল। ‘সংশয়’ নামের এ বাড়ির মালিক সাইদুর রহমান আস্তিক নন। তার সম্পর্কে নানা কথা শুনি। জগন্নাথ কলেজের এই আলোকিত অধ্যক্ষকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বললেন, কলেজ ক্যাম্পাসে একটা মসজিদ বানাতে। উত্তরে সাইদুর রহমান বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, যে পুণ্যবানরা এই শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারা তো এখানে মন্দির বানাননি। আমি তাদের দান করা এই জায়গায় মসজিদ বানাতে পারব না। ইসলাম ধর্মে যার গভীর নিষ্ঠা, সেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের যুক্তি এক বাক্যে মেনে নিলেন। ‘সংশয়’ নামের বাড়িতে কখনও ঢিল পড়েনি, কেউ কালির পোচে ঢেকে দেয়নি নামফলকটি। ড. আহমেদ শরীফও আস্তিক ছিলেন না। ধর্ম তার ছিল। তা মানবধর্ম। তার জন্য তার প্রাতঃভ্রমণে কেউ বিঘœ ঘটায়নি। জীবননাশ তো নয়ই। ড. অভিজিত রায়ের মৃত্যুর পর বিডিনিউজ২৪-এ ‘নিঃশব্দতার চাপাতি ও জীবন বাঁচাতে জীবন’ শীর্ষক আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১০ মার্চ, ২০১৫ তারিখে। পরাধীন বাংলাদেশে ধর্মীয় গেঁাঁড়ামি বিষয়ে সাধারণ মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর ভাব-মানসটি বোঝাতে সে প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখ করছি। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গোপালগঞ্জ আসনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু বলছেন, “জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল নয়, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় আলেম, পীর ও মাওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ শর্ষীনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে যত রকম ফতোয়া দেয়া যায়, তা দিতে কৃপণতা করলেন না।” ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু জয়ী হয়েছিলেন। নির্বাচনে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র ছিল একই। এ থেকে বঙ্গবন্ধু যে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাটি পেয়েছিলেন, তা তিনি বিবৃত করেছেন এভাবে : “এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ সেøাগান দিয়ে ধোঁকা দেয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালী মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না, এ ধারণা অনেকের হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৮) ’৫৪ সালের এই অভিজ্ঞতার আরও উজ্জ্বল নিদর্শন ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের সেসব গৌরবময় অতীত কী নির্দ্বিধায় আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা ভুলে বসেছেন! বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কি ভুলে গেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইসলামের নামে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দালালদের গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতির পিতার আহ্বানে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর নামটি জপ করেই জীবন দিয়েছিল অকাতরে এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল? ‘আমরা সবাই এদেশের সন্তান’, এই বিশ্বাসে একত্র হয়েছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-আদিবাসীরা। তারই ফসল আমাদের সংবিধান, যাতে চার মৌলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা। কি দুর্ভাগ্য আমাদের। যেখানে মাত্র দু’বছর আগে এদেশের নতুন প্রজন্ম জামায়াত-হেফাজত-বিএনপির ধর্মীয় উস্কানির বিরুদ্ধে সৃষ্টি করল জাতীয় পুনর্জাগরণের, যার ফলে টিকে থাকল শেখ হাসিনার সরকার, সেই দেশের ভবিষ্যত কাণ্ডারি জাতির পিতার দৌহিত্র নতুন প্রজন্মের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টারকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ কি কথা বললেন? উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গী, যারা তাদের লিস্ট অনুযায়ী এক এক করে হত্যা করছে মুক্তমনা মানুষদের, তাদের তিনি তুষ্ট করতে বক্তব্য রাখলেন? কি ভেবেছেন তিনি, তার এই আপোসে এরা চাপাতি উঠিয়ে রাখবে? তা যে নয়, তার প্রমাণ পেতে তো দু’দিনের বেশি সময় গেল না। নিহত হলো অনন্ত বিজয় দাশ। নতুন প্রজন্মকে কি উত্তর দেবেন জয়? কি উত্তর দেবেন যখন তার দলের নবনির্বাচিত মেয়র হেফাজতের শফি হুজুরের কাছে দোয়া চাইতে যান? জয় কি ভুলে যাচ্ছেন, হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে সেই সংগঠন, যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ৮৪ জন মুক্তমনা ব্লগারের তালিকা পেশ করেছিল তাদের শাস্তি দাবি করে? সে তালিকা ধরেই তো এক এক করে হত্যাকাণ্ড। আর হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মানববন্ধনের ছবি দেখেছি। অধ্যাপক জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হকসহ তিনজন শিক্ষক এবং তাদের সঙ্গে অল্প কিছুসংখ্যক ছাত্রছাত্রী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অনন্ত বিজয় দাশের করুণ মৃত্যুর বিরুদ্ধে এই মানববন্ধন। ইসলামী জঙ্গীদের হাতে নিহত হওয়ার আগে অনন্ত লিখেছিল অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েস চৌধুরীর শিষ্টাচার বিবর্জিত ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে। শুনেছি, এই ব্যক্তিটি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য। মুক্তিযুদ্ধকালে নূরপুর গ্রামের আলবদর সদস্য যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী ফিরুর পুত্র আওয়ামী লীগের সিলেট-৩ আসনের এই সংসদ সদস্য সিলেট শহরের কোর্ট পয়েন্টে ‘সিলেটবিদ্বেষী’ অধ্যাপক জাফর ইকবালকে চাবুকপেটা করার মহৎ ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আর বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের একজন নেতাকেও পাওয়া যায় না তার প্রতিবাদ করতে। সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিতও নিরুত্তর থাকেন। নিশ্চুপ থাকেন সিলেটের আলোকিত মান্যজনেরা। প্রতিবাদ করে কথা বলতে হয় অনন্ত বিজয় দাশকে এবং তার দু’দিনের মাথায় নিহত হতে হয় তাকে। আগের হত্যাগুলো থেকে এটা অনেকটাই নিশ্চিত যে, জামায়াত জঙ্গীরাই অনন্তকে হত্যা করেছে তাদের লিস্ট ধরে। তারপরও এই হত্যাকাণ্ডে ওই সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস-সামাদ কয়েস চৌধুরীর কি কোন দায় নেই? আওয়ামী লীগ কি দলীয়ভাবে কোন ব্যবস্থা নেবে না এই ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে? অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ২০০৭ সালে যখন আমি ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে জেলখানায় আটক, আপনি কলম ধরেছিলেন। আমি ও আমার পরিবার কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করি। আপনাকে যেভাবে হেয়-অপদস্থ করা হচ্ছে, তাতে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ভুলে গিয়েছে এই অল্প কিছুদিন আগেই বেগম খালেদা জিয়ার তিন মাসের অবরোধ-হরতাল-পেট্রোলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে আপনার কলম কত তীক্ষè হয়েছিল। রয়টারকে দেয়া জয়ের সাক্ষাতকারের পর হাতেগোনা অল্প কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে বাকি সকলে। ‘নুরলদিনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যের অমর রচয়িতা সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সহস্র্র নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক। তাঁর কণ্ঠও নিশ্চুপ। কিন্তু এই সময়ে, এই দুঃসময়ে ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবাই’ শুনতে চেয়েছে সবাই আপনার কণ্ঠে। এই কিছুদিন আগে সিলেটে সাংবাদিক আহমেদ নূর রচিত ‘ওয়ান-ইলেভেন : কারারুদ্ধ দিনগুলো’ পুস্তকের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সৈয়দ শামসুল হকসহ বহু আলোকিতজনেরা সে অনুষ্ঠানে ছিলেন। শ্রদ্ধেয় সৈয়দ শামসুল হক, অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করুন। নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তার অধিকারী অংশের পাশে দাঁড়ান। সিলেটের আহমেদ নূর, আপনার শহরের আলোকিত মানুষদের নিয়ে একটি প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন। আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়াব। বাংলাদেশ এবং যথার্থ অর্থেই তার কাণ্ডারি শেখ হাসিনার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। অন্যদিকে, বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে কিনাÑ তাই গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে একটি সম্ভাবনার দেশে পরিণত করার সংগ্রামে আমাদের যে ভরসা শেখ হাসিনা, তা শুধু তাঁর দল আওয়ামী লীগ নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষ বিশ্বাস করে। তাই আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের লাগাতার ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতায় তারা অংশ নেয় না। বরং তা অকার্যকর করে দেয়। শত প্রতিকূলতার মুখেও তাই বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ৪১ বছর পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, যাকে বিএনপি গোলামির চুক্তি বলে এসেছে এতদিন, তার অন্যতম ধারা ছিটমহল বিনিময় ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এর আগে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানা নির্ধারণের ফলে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদ কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ করায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয়ের তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি, সামাজিক নানা সূচকে পৃথিবীর বহু দেশকে পেছনে ফেলা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার বাস্তব সম্ভাবনা, মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়াÑ এসব কারণে অনেকেরই সুচিন্তিত ধারণা, বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক শক্তির এমন সুসময় আগে আর কখনও আসেনি। এমন সবল অবস্থানে থেকে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার শেকড় শক্ত মাটিতে প্রোথিত করার সুবর্ণ সুযোগ কেন হেলায় হারাবেন জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়? এ কথা তো তাদের জানা যে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বসবাসস্থল হিসেবেই সোনার বাংলার কল্পনা করেছেন জাতির জনক। তাঁর সেই স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন। এখন শুধু প্রয়োজন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। সে কাজটি তারা করতে পারবেন, যেমনটি তাদের পূর্বসূরীরা করেছিলেন ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে। তার জন্য প্রধানত রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে। সঙ্গে অবশ্যই প্রকৃত সুশীল সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। অতীতে দেশের দুঃসময়ে কি আমরা এগিয়ে আসিনি? সে জন্যই দেশ প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এক এগারোর পরের কঠিন সময়ে কারাগারে থেকেও সিএমএম কোর্টে আমার জবানবন্দীর কথা আমি স্মরণ করি। সে সময় কাণ্ডারির ভূমিকায় থাকা শেখ হাসিনাকে অবিচল রাখতে, আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাহস যোগাতে সে জবানবন্দী ছোট হলেও ভূমিকা রেখেছিল। আজ শেখ হাসিনা সরকারের সুসময়ে যখন মুক্তবুদ্ধির চর্চা চাপাতির নিচে, যখন নৈশব্দের ভয়াল চাপাতি আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে, যখন স্তাবকেরা মুক্তকচ্ছ হয়ে শক্তিমানদের বন্দনায় মত্ত, যখন বিবেক নিজের টুঁটি চেপে চুপ থাকা বাঞ্ছনীয় মনে করছে, তখন সৈয়দ শামসুল হকের কণ্ঠ আমি নিজ কণ্ঠ করে উচ্চারণ করছি, ‘জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।’ জানি, সে ডাকে সাড়া দেবেন দেশের শুভশক্তি। সে ডাকে সজীব ওয়াজেদ জয়কে সাড়া দিতেই হবে। তা না হলে জয় এক সময় নতুন প্রজন্মের সবচেয়ে অগ্রসর শক্তির আস্থা ও সমর্থন হারাবেন। এর ফলে এক অনন্যসাধারণ শক্তির ঐক্য বিনষ্ট হবে। সোনার বাংলা গড়ার জন্য এই ঐক্য যে অপরিহার্য, জয়কে তা অনুধাবন করতে হবে। এই ঐক্যে ফাটল ধরলে আমাদের সামনে সমূহ বিপদ, যা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মনে পড়ল, অনন্ত নিহত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর একটি টিভি চ্যানেল থেকে একজন যোগাযোগ করে বললেন, রাতে এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে টকশোতে অংশ নিতে। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলাম। পাঁচ মিনিট গেল না। আবার ফোন এলো। খুবই কুণ্ঠার সঙ্গে তিনি জানালেন অনুষ্ঠানে পরিবর্তনের কথা। ভূমিকম্প নিয়ে আলোচনা হবে। তবে আগামীকাল অনুষ্ঠানটি হবে। সে আগামীকাল আর আসেনি। রাত পোহায়নি। ভয়টি সেখানেই। আমার প্রয়াত বড় ভাই কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের কনিষ্ঠ পুত্র মিশু তার একটি রচনায় লিখেছিল : “আকাশের তীরে ঠেকা চাঁদ, রাত সবে শুরু।” মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন শক্তি যদি নৈশব্দ থেকে বেরিয়ে না আসে, আত্মসমালোচনার অনুশীলনের অভাবে ইস্পাত-কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, এই রাত আমরা কখনই পার করতে পারব না। তবে মানবতা, যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মূল্যবান জীবন বিপন্ন হতেই থাকবে। সোনার বাংলায় তা হবে না। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×