ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেহেরপুরের শতাধিক পরিবার নিঃস্ব, নিখোঁজ অর্ধশত

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ মে ২০১৫

মেহেরপুরের শতাধিক পরিবার নিঃস্ব, নিখোঁজ অর্ধশত

নিজস্ব সংবাদদাতা, মেহেরপুর, ১৮ মে ॥ মেহেরপুরের মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে শতাধিক পরিবার। এদের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত অর্ধশত। মারা গেছে বলে খবর প্রচার হয়েছে চারজনের। এরা হলেন, গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মামুন (২৫), সদর উপজেলার পাটকেলপোতা গ্রামের আলামিন হোসেন (৩২), সিংহাটি গ্রামের আতিয়ার রহমান (৩৮) ও ঝাঁঝা গ্রামের আনারুল ইসলাম (৪০)। সম্প্রতি থাইল্যান্ডসহ সাগর থেকে বাংলাদেশী উদ্ধারের খবরে নিখোঁজদের পরিবারে স্বজন ফিরে পাওয়ার আশা জাগলেও মাতম চলছে মৃত্যু খবর পাওয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। কম খরচে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে সমুদ্র পথে থাইল্যান্ডের পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয় এসব সাধারণ মানুষকে। স্থানীয় দালালরা এদের নিয়ে যায় টেকনাফ। সেখান থেকে তুলে দেয়া হয় সাগর পথে ট্রলারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে বাঁকি টাকা পরিশোধ করলেই হবে। এমন প্রলোভনে পড়ে মেহেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ দালালদের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ে। দশ, পনেরো বা বিশ দিন পর মোবাইল ফোনে খবর আসে তারা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের হাতে আটকা পড়েছে। দুই বা আড়াই লাখ টাকা দিলে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারবে। বাড়ির লোকেরা হয় ধারদেনা করে নয় সহায় সম্বল বিক্রি করে দালালদের হাতে টাকা তুলে দেয়। টাকা পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত চলে শারীরিক নির্যাতন। আর তিন বেলার মধ্যে খাবার দেয় একবেলা। তাও আবার পরিমাণে সামান্য। ব্যত্যয় ঘটলে বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। অসুস্থ হয়ে মারা গেলে সাগরের পানিতে অথবা জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয় লাশ। আবার কখনও মাটি চাপা দেয়া হয়। টাকা দিতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু। টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসা কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় পাচারকারী চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন, হেমায়েতপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন, খড়মপুর গ্রামের আলি হোসেন, কসবা গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে আব্বাস আলী, সদর উপজেলার শিংহাটি গ্রামের ইমারুল, মোশারফের ছেলে সাজিবুল, ইছাখালি গ্রামের মৃত সুরমান আলীর ছেলে সাদের আলী, আব্দুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক এবং শিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল। তবে ছুটিতে বাড়ি আসা ইমাদুল জানান, তিনি কোন লোক পাঠানোর কাজ করেন না। তাদের এলাকার তিন-চারজন ছেলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের কাছে আটকা পড়লে তাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে পরিবারের লোকজন। বিপদের কথা বিবেচনা করে তিনি তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া ফার্মে কাজ করা কয়েকজন বর্মী লোকের সঙ্গে সাহায্য নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবস্থান করা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। দালালদের দাবি করা টাকা তাদের দেয়া লাইলী ও এমআর ট্রেডার্সের এ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। তিন জনের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা তার শ্যালক রিপনের কাছে দিলে তিনি চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংক থেকে তাদের ঐ এ্যাকাউন্টে পাঠান। রিপন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। তবে দালালদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। যেসব মানুষ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের টেকনাফে নিয়ে প্রথমে লাইলী, মঞ্জু ও আসলামের বাড়িতে রাখা হয়। বাড়িগুলো পলিথিনে ছাওয়া এবং বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক একটি বাড়িতে ৫০ থেকে ৬০ জনকে জড়ো করা হয়। এরপর একসঙ্গে রাতের আঁধারে ট্রলারে তোলা হয়। একেকটি ট্রলারে তিন থেকে চার শ’ লোক নিয়ে যায়। ট্রলারে তোলার আগে সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ঘড়ি, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নেয়া হয়। টেকনাফের ঐ সব বাড়িতে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ থাকে না। সব সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পাহারা দেয়। ট্রলারে করে থাইল্যান্ডের পাহাড়ের ওপরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তে, যেখানে সব সময় তিন চার হাজার করে লোক থাকে। সবখানেই অস্ত্রধারী লোকজন পাহারা দেয়। সীমান্ত এলাকার পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে আটকে রেখে বাড়িতে ফোন করিয়ে টাকা পাঠাতে বলা হয়। টাকা পাঠাতে কোন ব্যত্যয় ঘটলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। মারা গেলে লাশ ফেলে দেয়া হয় অথবা পুঁতে রাখা হয়। টাকা পেলে মালয়েশিয়া ঢোকার জন্য কালো ত্রিপলে ঢাকা ছোট ছোট পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় অনেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আবার কেউ কেউ অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে মালয়েশিয়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাইলীর ৬১১৭ নম্বর এ্যাকাউন্টে কক্সবাজারের ইসলামী ব্যাংক, কোর্ট বাজার শাখায় ৯/৮/১৪ তারিখে ৩ লাখ, ১০/৪/১৪ তারিখে ১ লাখ, ২০/৪/১৪ তারিখে ৪০ হাজার, ২১/৪/১৪ তারিখে ৪০ হাজার ও ২০ হাজার টাকা এবং এমআর ট্রেডার্সের ২০৪৬ নম্বর এ্যাকাউন্টে ইসলামী ব্যাংক, ঢাকার ভিআইপি শাখায় ২১/৪/১৪ তারিখে ১ লাখ ৬০ হাজার, ২৩/৩/১৫ তারিখে ৩ লাখ, ২৪/৩/১৫ তারিখে ৫০ হাজার, ২৫/৩/১৫ তারিখে ৫০ হাজার, ২৯/৩/১৫ তারিখে ৬ লাখ ও ২ লাখ, ৩১/৩/১৫ তারিখে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। সব টাকাই পাঠানো হয়েছে ইসলামী ব্যাংক, চুয়াডাঙ্গা শাখা থেকে। এসব টাকা পাচারকারীদের হাতে আটকা থাকা লোকজনকে ছাড়িয়ে আনতেই দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। মেহেরপুরের পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, মানব পাচারকারীদের কোন ছাড় নেই। কঠের হাতে দমন করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ হবে। সেই সঙ্গে এই ঘৃণ্য কাজ থেকে পরিত্রাণ পেতে জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
×