ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টেকসই সমাজ ভাবনায় বিশ্ব জাদুঘর দিবস উদ্্যাপন

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৯ মে ২০১৫

টেকসই সমাজ ভাবনায় বিশ্ব জাদুঘর দিবস উদ্্যাপন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যে কোন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কৃষ্টির স্মারক জাদুঘর। সোমবার ছিল আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। আর প্রতিবছরের মতো বিশ্বব্যাপী জাদুঘর পরিবার পালন করেছে দিবসটি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫ দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি জাদুঘর দিবসটি উপলক্ষে পালন করেছে কর্মসূচী। প্রকৃতি ও সমাজকে সংরক্ষণ এবং এগিয়ে নিতে জাদুঘরের অবদান উঠে এসেছে সেসব আয়োজনে। সেই সূত্রে ‘টেকসই সমাজের স্বার্থে জাদুঘর’ প্রতিপাদ্যে সেমিনার, শোভাযাত্রাসহ নানা আয়োজনে রাজধানীতে উদযাপিত হলো দিনটি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও জাদুঘরসমূহের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (আইকম) বাংলাদেশ জাতীয় কমিটি যৌথভাবে দিবসটি উদ্্যাপন করে। জ্যৈষ্ঠের সকালে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুুফিয়া কামাল মিলনায়তনে জাদুঘর বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থাপিত হয় সমাজ-সভ্যতার বিনির্মাণ এবং প্রকৃতির সংরক্ষণে জাদুঘরের ভূমিকা বিষয়ক দু’টি প্রবন্ধ। এতে টেকসই সমাজের স্বার্থে জাদুঘর বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থান করেন বিশিষ্ট গবেষক ও জাদুঘরবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদ। এছাড়া জাদুঘর শিক্ষা এবং টেকসই সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিকদার মোঃ জুলকারনাইন। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন টাকা জাদুঘরের কিউরেটর ড. মোঃ রেজাউল করিম ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জনাব মফিদুল হক। প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আক্তারী মমতাজ। সভাপতিত্ব করেন জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি এম. আজিজুর রহমান। স্বাগত ভাষণ দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আইকম বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারপার্সন জাহাঙ্গীর হোসেন। ফিরোজ মাহমুদ তাঁর প্রবন্ধে জাদুঘরের সঙ্গে দর্শনার্থীর সম্পর্কের বিশ্লেষণ করে বলেন, আধুনিক জাদুঘর সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তাই আধুনিক জাদুঘরকে বলা হয় গণবিশ্ববিদ্যালয়। আর সকল দর্শনার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোন পাঠ্যসূচী ও শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। দর্শনার্থীরা প্রদর্শিত নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠ করে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। যেহেতু কোন শিক্ষাই চোখে দেখার আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সমতুল্য নয়, তাই জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষাটা অতুলনীয়। এখানেই নিহিত রয়েছে জাদুঘর পরিদর্শনের স্বার্থকতা। টেকসই সমাজ গঠনে জাদুঘরের করণীয় প্রসঙ্গে প্রবন্ধে ফিরোজ মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ এখনও রাজনৈতিক কলহ ও সহিংসতা থেকে মুক্ত নয়। অর্থনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান এখনও আশানুরূপ নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে। সমাজের এই সামগ্রিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে সাস্টেইনেবল সোসাইটির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। সেই আলোকেই দেশের জাদুঘরগুলোর ভূমিকা নিরূপণ করতে হবে। আধুনিক পৃথিবী ও সমাজ দ্রুত বদলাচ্ছে এবং ক্রমাগত উন্নতির পথে পা বাড়িয়ে চলেছে। আধুনিক জাদুঘর প্রকৃতপক্ষে সময়ের প্রতিবিম্ব এবং সমাজের ক্রমবিকাশের ধারাটির পরিচায়ক। সুতরাং জাদুঘরকে নতুন অবস্থায় নবতর ভূমিকা পালন করতে হয়। আধুনিক বিশ্বের জাদুঘরের অন্যতম কাজ হচ্ছে শিক্ষামূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং জ্ঞানদান করা। তাই জাদুঘরকে সব সময় বিবিধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বস্তুসামগ্রী সংগ্রহের কথা ভাবতে হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রতœতাত্ত্বিক ও শিল্পকলা জাদুঘরের পাশাপাশি ইতিহাস, প্রাকৃতিক ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, লোকশিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, যানবাহন, সমকালীন শিল্প, ভাষা ও সাহিত্য প্রভৃতি নানা বিষয়ক জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে ও হচ্ছে। অতএব বাংলাদেশে সমাজকে চলমান রাখতে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জাদুঘর নির্মাণ করতে হবে এবং এর কোন বিকল্প নেই। দেশে বিষয়ভিত্তিক জাদুঘর গড়ে উঠলেও সংখ্যায় খুবই কম। জাতীয় জাদুঘরের নিদর্শনের সমৃদ্ধতার সংখ্যা তথ্য তুলে ধরে প্রাবন্ধিক বলেন, ২০১৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ৮৬ হাজার ৫১৪টি নিদর্শন সংগ্রহ করেছে। এই জাদুঘর তাম্রলিপি, শিলালিপি, মুদ্রা, ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য প্রতœতাত্ত্বিক ও শিল্পকলার নিদর্শনে এখন খুবই সমৃদ্ধ। এসব নিদর্শন গবেষণার জন্য বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার যা গবেষণার জন্য খুবই ফলপ্রসূ। মুক্তিযুদ্ধের বিপুল তথ্য-উপাত্তও রয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। তবে নানা নিদর্শনের সমাহার দর্শকদের অভিভূত করলেও ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ এই চারটি গ্যালারি ব্যতীত জাতীয় জাদুঘরে ইতিহাসের ক্রমবিকাশ অনুপস্থিত। প্রবন্ধের উপসংহারে ফিরোজ মাহমুদ বলেন, জাদুঘর এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে শিশু-কিশোরদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ তাদের মনের বিকাশ ও প্রস্তুতিতেই ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বের সূচনা। জাদুঘরে এসে তারা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হবার সুযোগ পায় যে জীবনের পথে অগ্রসরের একটা অর্থ খুঁজে পাবে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে একটি অপরিহার্য অংশ হতে হবে শিক্ষার্থীর জাদুঘর পরিদর্শন। নিজ দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি সবচেয়ে বেশি মমতাশীল সংবেদনা সৃষ্টি করবে জাদুঘরের প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। অবশ্য এজন্য জাদুঘরের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপযোগী শিক্ষামূলক কর্মসূচীর ব্যবস্থা করতে হবে। জাদুঘর শিক্ষা এবং টেকসই সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক প্রবন্ধে জাদুঘর শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে শিকদার মোঃ জুলকারনাইন বলেন, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে জাতীয় জাদুঘর একটি প্রফেশনাল মাস্টার ডিগ্রী ইন মিউজিয়াম এডুকেশন/স্টাডিজ চালু করার মাধ্যমে বিভিন্ন জাদুঘরে কর্মরত মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এবং ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের সম্মিলিতভাবে আধুনিক জাদুঘরের নানা বিষয়ে তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে। গবেষণায় আমরা দেখেছি অনেক গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরে একজন ব্যক্তিও নেই যিনি জাদুঘরবিদ্যার কোন ধরনের কোর্স সম্পন্ন করেছেন। আমরা আশা করি জাদুঘর নিজ প্রয়োজনেই তার জনবলকে প্রশিক্ষিত করবে। আলোচনায় মফিদুল হক বলেন, সাধারণ মানুষকে জাদুঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, মানবিক শক্তিকে পরিপুষ্টি জোগায় জাদুঘর। মানবসভ্যতার ইতিহাস ধারণে জাদুঘরের বিকল্প নেই। সেমিনারের আগে সকাল ৮টায় আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি শাহবাগ জাদুঘর থেকে শুরু হয়ে টিএসসি হয়ে পুনরায় জাদুঘর চত্বরে এসে শেষ হয়। জাতীয় জাদুঘর, ঢাকাস্থ বিভিন্ন জাদুঘর, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ এবং জাদুঘরের সুহৃদবৃন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। আলোচনা ও তথ্যচিত্রে ভাস্কর নভেরা স্মরণ ॥ আলোচনা ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার ভাস্কর নভেরা আহমেদকে স্মরণ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগ। সোমবার দুপুরে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষদের লেকচার থিয়েটারে ‘নভেরা আহমেদ : জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদান করেন নভেরার সমকালীন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান, শিল্প সমালোচক মঈনুদ্দিন খালেদ, চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন, শিল্প সমলোচক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা রাশেদ চৌধুরী, রেজাউল করিম সুমন ও শীবু কুমার শীল প্রমুখ। সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলেন, নভেরার সামাজিক জীবন বলে কিছু ছিল না। যা ছিল সেটা হলো কাজ আর কাজ। কাজকেই তিনি জীবনের পাথেয় মনে করেছেন। অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, আমাদের দেশে মানের চেয়ে সংখ্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। বিবেচনা করা হয় কে আগে করল কিংবা কে বেশি কাজ করল। সেই অর্থে গুণগত মানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। নভেরা ছিলেন সেই শিল্পী, যার কাজের মধ্যে মানটাই ছিল সর্বোচ্চ বিবেচনাযোগ্য। মঈনুদ্দিন খালেদ, নভেরা আহমেদের পরিচয় সেভাবে ফুটে না ওঠার নেপথ্যে এই আমরা এবং রাষ্ট্র অনেকাংশে দায়ী। এছাড়াও দায়ী মাস্তান-স্বভাবের কিছুসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মী। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে শিল্পের ইতিহাস ও তাৎপর্যকে অনেক ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ করে দেই। যেমনটি করেছি নভেরার ক্ষেত্রেও। তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হলেও সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। জাতীয় জাদুঘরের অবহেলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নভেরার ওপর জাতীয় জাদুঘরে এক সময় পেপার পড়া হলেও সেগুলোকে পেপারবন্দী করেই রাখা হয়েছে কোন দিন প্রকাশনার মুখ দেখেনি। সুতরাং বলা যায়, সর্বোপরি নভেরাকে নিয়ে এক ধরনের দায়সারাভাব রয়েছে। এটার কারণ আমার জানা নেই। রেজাউল করিম সুমন বলেন, শহীদ মিনার ও আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ নভেরা আহমেদ। এর আগে তাকে নিয়ে গত দুই দশকে দুটি ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। একটি হলো কথাসাহিত্যে ও ভাস্কর্য নিয়ে। কিন্তু কোনটাতেই আর তেমনভাবে নভেরা জীবন ও কর্ম স্পষ্ট হয়নি। শীবু কুমার শীল বলেন, নভেরাকে নিয়ে চারুকলায় কোন আয়োজন হয়নি। তবে বর্তমানে তাঁকে নিয়ে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে আলোচনা হচ্ছে সেটা না করে তাঁর ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনা জরুরী। আলোচনা শেষে নভেরা আহমেদের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত ষাট মিনিটের তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ছায়ানটে আবৃত্তি ও সঙ্গীতসন্ধ্যা ॥ সোমবার সন্ধ্যায় কবিতার দোলায়িত ছন্দ ও গানের সুরেলা শব্দধ্বনিতে মুখরিত হলো ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তন। গান ও কবিতার যুগলবন্দী এ আয়োজনে পরিবেশনায় অংশ নেন দুই বাংলার শিল্পীরা। ছন্দোময় উচ্চারণে কবিতাপাঠে অংশ নেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বেলায়েত হোসেন, ডালিয়া আহমেদ, পারভেজ চৌধুরী, সোহেল আনোয়ার ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ণালী সরকার। আর গান শুনিয়ে শ্রোতার হৃদয় সিক্ত করেন অনিমা রায় ও প্রমোদ দত্ত। আর্কাইভ উপস্থাপনা করেন পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রশান্ত কুমার।
×