ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবপাচারের অসহায় শিকার অসংখ্য অভিবাসী;###;মৃতের সংখ্যা দু’শ’ ছাড়িয়েছে ;###;মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া ভিড়তে দিচ্ছে না ভাসমানদের;###;ইন্দোনেশিয়ার পাঁচ যুদ্ধজাহাজ পাহারা দিচ্ছে

সাগরবক্ষে মৃত্যু আতঙ্কে প্রহর গুনছে ওরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৯ মে ২০১৫

সাগরবক্ষে মৃত্যু আতঙ্কে প্রহর গুনছে ওরা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ পাচারের কবলে পড়ে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উপকূলীয় সমুদ্র এলাকায় বর্তমানে ভাসমান আরও প্রায় ৬ হাজার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিকের জীবন আরও সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে সাগরে ভাসমান অবস্থায় খাদ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি এবং রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের মধ্যে নানা কারণে কথা কাটাকাটি, ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে সাগরে ঝাঁপ দেয়া এবং ছুরিকাঘাতসহ নানা ঘটনার জের হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ২শ’ ছাড়িয়ে গেছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে। রবিবার পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল শতাধিক। এছাড়া সোমবার ইন্দোনেশিয়া মালাক্কা প্রণালী উপকূল এলাকা থেকে মানব বোঝাই আরেকটি ইঞ্জিন চালিত বোট ফেরত পাঠানো হয়েছে। শতাধিক মানববাহী এ বোটটি মালয়েশিয়ায় জলসীমায় থেকে সে দেশে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী তাড়া খেয়ে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারাও সে দেশের কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী তাড়িয়ে দেয়ার পর এখন কোন এলাকায় অবস্থান করতে কোন সূত্রে নিশ্চিত করতে পারেনি। এদিকে, সোমবার সকালে সেন্টমার্টিনে ছেড়াদ্বীপ ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে জেটি ঘাট এলাকা থেকে কোস্টগার্ড বিজিবি সদস্যরা পৃথক পৃথক অভিযানে মালয়েশিয়া গমনের রুট থেকে ফিরে আসা আরও ১৩ জনকে উদ্ধার করেছে। তাদের টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে, মালয়েশিয়া সরকার সোমবার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা এসব অবৈধ অভিবাসীর দায়ভার কোন অবস্থাতেই নেবে না। অপরদিকে, ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে সে দেশের জেলেদের আর কোন অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার কাজে জড়িত না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু তাই নয় সে দেশে সরকারের নির্দেশে ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর চারটি যুদ্ধ জাহাজ ও একটি যুদ্ধ বিমান পাঠিয়েছে তাদের সমুদ্রসীমা অভ্যন্তর থেকে। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ আচেহ এলাকা দিয়ে এসব অভিবাসী বোঝাই ইঞ্জিন চালিত বোট ও ট্রলার প্রবেশ করছে বলে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের হিসাবমতে এ পর্যন্ত ৩ সহস্রাধিক অভিবাসী সাঁতার কেটে সাগর থেকে উপকূলে উঠেছে। এরা সবাই আচেহ প্রদেশ হয়ে প্রবেশ করেছে। ইন্দোনেশিয়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থার মতে, থাই-ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উপকূলবর্তী সাগরে এখনও কমপক্ষে ৮ হাজার অভিবাসী ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। এরা না ঢুকতে পারছে ইন্দোনেশিয়ায়, না যেতে পারছে মালয়েশিয়ায়। এছাড়া ফিরে আসার জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীও নিঃশেষ হয়ে গেছে। অপরদিকে, আগামী ২৯ মে থাইল্যান্ড সরকার যে ১৫টি দেশ নিয়ে আঞ্চলিক সম্মেলন আহ্বান করেছে তার প্রতি সাধুবাদ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধারকৃত এ পর্যন্ত প্রায় ৮শ’ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিককে সে দেশের কয়েকটি শরণার্থী ক্যাম্পে পৃথক পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। আচেহ প্রদেশে পুলিশ প্রধান দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই দুই দেশের নাগরিক তথা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীরা অনবরত ঝগড়াঝাটি ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে থাকায় তাদের পৃথক পৃথকভাবে রেখে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। টেকনাফে আরও উদ্ধার ১৩ ॥ সেন্টমার্টিনের ছেড়াদ্বীপ ও শাহপরীরদ্বীপের জেটিঘাট এলাকা থেকে কোস্টগার্ড ও বিজিবি সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে আরও ১৩ মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের উদ্ধার করেছে। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ জেটিঘাট থেকে অসুস্থ অবস্থায় সোমবার ভোরে ৬জন মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেছে বিজিবি সদস্যরা। উদ্ধারের সময় তারা ক্ষুধার্থ ও অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারছিল না। বিজিবি কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ খালেকুজ্জামান সোমবার জনকণ্ঠকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে ভাসমান ট্রলার বা ব্যক্তিদের উদ্ধারকল্পে বিজিবি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয় জেলে সম্প্রদায় এবং মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু আমদানিকারকদের এ ব্যাপারে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে বিজিবি। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে নরসিংদীর মোঃ শাহীন মিয়া, মোঃ জাহিদুল ইসলাম, জয়পুরহাটের মোঃ জসিম উদ্দিন, পাবনার শহিদুল ইসলাম ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মোঃ মুছা। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা জানান, তারা দালালের মাধ্যমে মহেশখালী পয়েন্ট হয়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা করেছিল। উদ্ধারের পর বিজিবির তত্ত্বাবধানে তাদের খাবার ও চিকিৎসা দিয়ে জিডি এন্ট্রির মাধ্যমে সোমবার টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে। কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন ইনচার্জ লে. কমান্ডার সাঈদ হোসেন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, ছেরাদিয়া দ্বীপে মিয়ানমারের জেলেদের একটি নৌকা থেকে কোস্টগার্ডের সেন্টমার্টিন ক্যাম্পের একটি টিম ৭জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন জয়পুরহাটের শাহাদত সরকার, জিনাইদহের আলা উদ্দিন শেখ, মামুন মোল্লা, জসিম মুন্সি, সিরাজগঞ্জের ইদ্রিস আলী, ইসমাঈল ও ইমরান আলী। তাদের সেন্টমাটিনদ্বীপে নিয়ে খাবার ও চিকিৎসা সেবা প্রদান শেষে টেকনাফ থানা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া যুবকরা কোস্টগার্ডকে জানিয়েছেন, সাগরে থাকা মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলার থেকে দালালরা ৭ বাংলাদেশীকে সাগরে নিক্ষেপ করে দেয়। আমরা সাগরে ভাসতে থাকলে সেখানে মাছ ধরারত মিয়ানমারের জেলেরা আমাদের উদ্ধার করে জলসীমায় এনে ছেরাদিয়া দ্বীপে নামিয়ে দিয়ে যায়। রোহিঙ্গা দালাল ॥ উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় সরকারী বনভূমি দখল করে বসবাসরত অবৈধ রোহিঙ্গা বস্তিতে ও শরণার্থী ক্যাম্পেও ঘাপটি মেরে রয়েছে বহু চিহ্নিত দালাল। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বসবাসরত ৫ জন প্রভাবশালী রোহিঙ্গাসহ কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের ১৫ জন রোহিঙ্গা দালাল মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। কুতুপালং ক্যাম্পের খাইরুল আমিনের নেতৃত্বে ওইসব রোহিঙ্গা এবং সোনারপাড়ার দালাল চক্র শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ায় সাগরপথে মানব পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা হাশেম উল্লাহ, মাস্টার কবির, মাস্টার হাশিম ও মাস্টার সাবের বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে স্থায়ীভাবে সপরিবারে বসবাস করছে। তারা কক্সবাজারে এবিসি ঘোনায় বসবাসরত মানবপাচারকারী আবদুর রহিম প্রকাশ বর্মাইয়া রহিমের মাধ্যমে সাগর পাড়ি দিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীকে মালয়েশিয়া নিয়ে গেছে। এদের মধ্যে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে এবং সাগরে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা জানিয়েছেন। বর্মাইয়া রহিম সাগরে মাছ ব্যবসার আড়ালে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করে এখন কোটিপতি বনে গেছে। তার সিন্ডিকেটে থাকা দালালরা হচ্ছে- কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের কেফায়েত উল্লাহ, সাইদুল হক, নুর বেগম, আরেফা বেগম, নুর মোহাম্মদ, খাইরুল আমিন ও জকির আহমদ।
×