ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমুদ্র হক

ভূমিকম্প আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৮ মে ২০১৫

ভূমিকম্প আতঙ্ক

প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা খরা ঝড় টর্নেডো জলোচ্ছ্বাস (হালে বজ্রপাতও) দুর্যোগের খাতায় নাম লিখিয়েছে। তবে সকল দুর্যোগের আভাস ঋতু ও আকাশের কালোমেঘ জানিয়ে দেয়। কেবল আভাস দিতে পারে না প্রকৃতির নির্মম ঘটনা ‘ভূমিকম্প’। বাংলাদেশে এই সময়টায় এত বেশি ভূমিকম্প আঘাত করছে যে, মানুষের মন সারাক্ষণই আতঙ্কে থাকেÑ এই বুঝি কেঁপে উঠছে। চেতনার শঙ্কার বহ্নিশিখার দিনলিপি শুরু হয়ে পার হচ্ছে এখন। ঘরে কেউ টেবিলে হেলান দিয়ে দুলুনি দিলে মনে হচ্ছে এটা কি ভূকম্পন! কোন কারণে রান্নাঘর থেকে কিছু পড়ে গেলে গৃহিণী আঁতকে উঠে স্বগোক্তি করে- কেন পড়ল! ভূমিকম্প কী! অবচেতনেই ঘরে থাকা সদস্যদের বলেÑ এই ভূমিকম্প! বর্তমানে শহরের বাসা বাড়ি অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংগঠনের কার্যালয় ক্লাব রেস্টুরেন্ট ছাত্রাবাস তথা সকল জায়গায় যেখানে একাধিক সিলিং ফ্যান আছে সেখানে একটি বা দু’টি ফ্যান ঘুরানো থেকে বিরত রাখা হয়। অর্থাৎ এই গরমেও একটি দু’টি ফ্যান বন্ধ থাকে ভূকম্পন হচ্ছে কি-না তা টের পাওয়ার জন্য। এর আগে দেখা গেছে, ভূ-কম্পন হলে বন্ধ সিলিং ফ্যান দুলে ওঠে। কত জোরে ঝাঁকুনি হচ্ছে তা দুলুনি দেখে অনুমান করা যায়। এমনও দেখা গেছে ঝাঁকুনি কমে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ফ্যান দুলছে। ভূমিকম্পে পথে হাঁটার সময় অনুভূত হয় মাটির নিচে কাঁপছে। মাটি একটু কাঁপলেই মানুষ দৌড় দেয়। একজনের দেখাদেখি আরেকজন দৌড়ায়। কিছুদিন আগেও শহরের বড় মার্কেটের কলাপসিবল বড় গেটের একটা অংশ বন্ধ থাকত। বর্তমানে মার্কেটের চার ধারের সকল গেটই খোলা থাকে। এই বিষয়ে বগুড়া সপ্তপদী মার্কেটের কেয়ারটেকার জানালেন, কয়েক দফার ভূমিকম্পে একটি বিষয় মাথায় এসেছে, ভূকম্পনের সময় যার কাছে গেটের চাবি থাকে তারও মস্তিষ্ক কাজ করে না। পকেটে চাবি রেখেই সে এলোমেলোভাবে খুঁজতে থাকে। এই অবস্থার নিরসনে সকল গেটই খুলে রাখা হয়। বহুতল বাড়ির কর্তৃপক্ষ মৌখিক নোটিস দিয়েছে যারা সর্ব উপরে ও তার নিচের তলায় অবস্থান করেন তারা যেন কোনভাবেই লিফট ব্যবহার বা সিঁড়ি দিয়ে নিচে না নামেন। তাদের ছাদে আশ্রয় নিতে বলা হয় এই কারণে কোনভাবে যদি বিল্ডিং ধসেই যায় তাহলে ছাদের মানুষেরা চাপা পড়বে না। ভেতরের মানুষদের দ্রুত নিচে নামতে বলা হয়। অর্থাৎ ভূকম্পন সময় দেয় না। মুহূর্তেই যতটা পারা যায় ততটা সাবধানে থাকা ভাল। অনেক বাসাবাড়ির ডাইনিং টেবিলে পানির জগ ভরে রাখা হয়। কারণ কম্পনে পানি উছলে ওঠে। এই বিষয়ে একজন ভূতত্ত্ববিদ জানান, বছর পনেরো আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের কয়েক জেলায় মৃদু ভূকম্পনে পুকুর ও জলাশয়ের পানি আলোড়িত হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠত। বর্তমানে দেশের প্রতিটি এলাকায় জলাশয়ের পানি এমন তীব্রভাবে উছলে ওঠে যে মনে হবে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। এটা এখন পরিষ্কার যে, মাঝারি ভূকম্পনেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি শঙ্কিত করে তুলছে এই কারণে, যে এলাকায় জিওলজিক্যাল ফল্ট আছে সেখানেই পুকুর ও জলাশয়ের পানি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই অবস্থাকে বলা হয় ডাউজিং। অর্থাৎ ভূ-স্তরের প্লেট কোনভাবে স্থানচুতি হলে ভূপৃষ্ঠে পানির অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয়। এটা ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া। ভূতত্ত্বের আরেক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পানিবাহী বালির স্তর বা পলিগঠিত অঞ্চলে ভূ-কম্পনের ফলে ভূ-স্তর বা মাটি সঙ্কুচিত হয়। ফলে যে চাপের সঙ্কোচন হয় তা পানিকে ঝর্না আকারে ছুড়ে দেয়। এ ধরনের নরম পলিগঠিত অঞ্চলে ভূমিকম্প আঘাত করলে জলাশয় তো তীব্রভাবে আলোড়িত হয়ই, ভূ-উপরিস্থ সকল অবকাঠামোও দুলে ওঠে। বর্তমানে হিমালয় পর্বতমালার নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটটি ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে প্রবেশ করায় সেখানে টেকনোটিক লকের সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন সময়ে এই লক খুলে গেলে মহাবিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে এমন শঙ্কাই করা হচ্ছে। এই শঙ্কা এখন সাধারণের মধ্যে ভর করেছে। শিক্ষিতজনরা ধরে নিয়েছেন যে কোন সময় প্রলয়ঙ্করী কোন কিছু ঘটতে পারে। চেতনায় এই বহ্নিশিখায় তারা প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। বন্যা ঝড় টর্নেডো জলোচ্ছ্বাসের তাও সিগন্যাল আছে। জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া যায়। নির্মম প্রকৃতির ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন আভাস নেই, সেখানে প্রকৃতির কাছেই কি মানুষ নিজেকে সঁপে দেবে! ঘরে বাইরে মানুষ এখন এতটাই শঙ্কিত যে সামান্য নড়াচড়াতেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। কখনও দৃষ্টিভ্রমে কোন কিছু এলোমেলো দেখলেই চিৎকার করে ওঠে। ঘরের শিশুরা সামান্য কিছুতেই আঁতকে ওঠে। রাতে শোয়ার পর এপাশ ওপাশ হতে সামান্য অসঙ্গতি ঠেকলেই চেঁচিয়ে ওঠে ভূমিকম্প বলে। গ্রামের মানুষ আগে রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ত, এখন অনেক রাত জেগে থাকে। তার মধ্যে কুসংস্কারের শাখা-প্রশাখার বিস্তার তো আছেই। তারপরও গ্রামের মানুষ এখন সচেতন হয়ে গৃহপালিত পশুপাখির আচরণের দিকে খেয়াল করে। এভাবেই চেতনার শঙ্কার দিনলিপি শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। কি জানি কখন কী হয়......।
×