ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিভাবক বিক্ষোভের মুখে উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৭ মে ২০১৫

অভিভাবক বিক্ষোভের মুখে উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিশু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় অভিভাবকদের বিক্ষোভের মুখে উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন্নেসাকে অব্যাহতি দিয়েছে মোহাম্মদপুর প্রিপ্যারেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। প্রথম শ্রেণীর এক শিশুসহ তিন ছাত্রীকে কর্মচারীদের ধর্ষণ চেষ্টার প্রতিবাদ করায় অভিভাবকদের উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন রেক্টরের দায়িত্বে থাকা এ উপাধ্যক্ষ। অভিভাবকদের আন্দোলনে অস্থির পরিস্থিতি সামাল দিতে শনিবার একই সঙ্গে দুই কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে ক্লিনিং বিভাগ ও ক্যানটিন থেকে সব পুরুষ কর্মচারীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী ২৫ মে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শনিবার বেলা তিনটার দিকে অভিভাবকদের বিক্ষোভ ও ঘেরাওয়ের মুখে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন স্কুলটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ম তামিম। এদিকে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (মাধ্যমিক) রুহী রহমান জানান, মাউশি’র উপপরিচালক মোস্তফা কামালকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা স্কুল পরিদর্শনে গেছেন। রাতেই প্রতিবেদন দিবেন। গত ৫ মে এই বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের থাকার একটি কক্ষে প্রথম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠে। এরপর একে একে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর দুই ছাত্রীকেও যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। অভিভাবকরা জানান, ৫ মের ঘটনার অভিযোগ জানাতে গেলে গেল বুধবার উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন নেছা বলেছিলেন, ‘মধু থাকলে মৌমাছি আসবেই’। এছাড়া তিনি নারী অভিভাবকদের উদ্দেশে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের বাসায় যখন স্বামীরা একা থাকেন তখন কাজের বুয়ার সঙ্গে তারা কী করেন তা কি আপনারা দেখতে পান।’ অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেনও অভিভাবকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। এরপর থেকেই ধর্ষণ চেষ্টায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার, উপাধ্যক্ষের অব্যাহতি ও অধ্যক্ষের বিচারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে নামে অভিভাবকরা। উপাধ্যক্ষ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও অভিভাবকদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কমিটি করলেও ট্রাস্টি বোর্ড বা স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বিষয়টি ধামাচাপা দিচ্ছে অভিযোগ তুলে শনিবার সকাল থেকেই বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় কয়েকশ ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবক। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে স্কুলের সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। নারীকে যথাযথ সম্মান দেয়ার দাবি জানিয়েছিল ছোট্ট শিশুরাও। নিজের স্কুলে নিজের অধিকার রক্ষার দাবি জানায় স্কুলের ছাত্রীরা। দুপুর পৌনে ১টার দিকে স্কুলের মাঠে অবস্থান নেয়া অভিভাবকদের সামনে এসে অধ্যক্ষ বেলায়েত বলেন, ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনায় যে কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তার নাম গোপাল। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একজন অভিভাবককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে আরেক কর্মচারী শরীফুল ইসলামকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সময় অভিভাবকরা বলেন, যাদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাদের সম্পর্কে যৌন হয়রানির বিষয়টি পরিষ্কার নয়। যাকে তাকে ধরে ববস্থা নিলে হবে না। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের দিনও আজ (শনিবার) ধার্য ছিল। রিপোর্ট কই? অধ্যক্ষ আরও সময়ের কথা জানালে অভিভাবকরা বলেন, তাহলে কিসের ভিত্তিতে এক কর্মচারীকে সরিয়েছেন? এ সময় অভিভাবকরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। উপস্থিত উপাধ্যক্ষ জিন্নাতুন নেছার মন্তব্যও তাদের ক্ষুব্ধ করেছিল। পাশাপাশি স্কুলের সুনাম ক্ষুণœ করতে একদল অভিভাবক বিক্ষোভ করছে বলে কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানানোয় তাতেও উত্তেজিত হয়ে ওঠে অভিভাবকরা। অধ্যক্ষ মাঠ ছেড়ে স্কুল ভবনের তিন তলায় নিজের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে কয়েকজন অভিভাবক তাকে লাঞ্ছিত করেন। তিনি উপাধ্যক্ষের কক্ষে আশ্রয় নিলে সেই কক্ষের জানালা-দরজার কাচ ভাংচুর করে অভিভাবকরা। এ সময় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানসহ এলাকার বেশ কয়েকজন উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন। ততক্ষণে পুলিশও হাজির হয় ক্যাম্পাসে। এরপরও পরিস্থিতি জটিলতার দিকে মোড় নিতে থাকে। বেলা তিনটার দিকে ম. তামিম অভিভাবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে উপাধ্যক্ষসহ দুই কর্মচারীকে অব্যাহতির ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। এছাড়া অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। ম. তামিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত ৫ মে প্রথম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে পাশের একটি নবনির্মিত ভবনের রুমে নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে শারীরিক লাঞ্ছনার চেষ্টা করা হয় বলে ৯ মে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীর মা। অভিভাবকদের অভিযোগ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির নজরে আসার পর এ বিষয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে বলা হয়েছিল তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য। ওই অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল আজ (শনিবার)। কিন্তু বিশেষ কারণে তা জমা দেয়া হয়নি। কেন জমা দেয়া হয়নি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের সময়সীমা আরও তিনদিন বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকেই স্কুল-কলেজের নিরাপত্তার স্বার্থে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে যত পুরুষ কর্মচারী ছিল, তাদের সরিয়ে দিয়ে মহিলা কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি টয়লেটের সামনেই একজন করে আয়া রাখা হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা কোন সমস্যায় পড়লে সহজেই জানাতে পারে। এছাড়া বাথরুম সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। বিক্ষোভে অংশ নেয়া অভিভাবক রেজাউল হক শিশির বলেন, উপাধ্যক্ষের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে। বাচ্চাকে স্কুলের ভেতর পাঠিয়ে গেটের বাইরে বসে থেকেও যদি নিশ্চিন্ত থাকতে না পারি তাহলে আমরা কোথায় যাব? অধ্যক্ষসহ এই ঘটনায় জড়িত ও মদদদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই। নইলে আগামীতে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এমনকি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই আমরা অবস্থান নেব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলের পদত্যাগের দাবি জানাব। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টে একটি রিটও দায়ের করা হয়েছে। এদিকে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে রাতে অধ্যক্ষ বেলায়েত হোসেন বলেন, ভাই আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। বুঝেনইতো চাইলেই আমরা কিছু করতে পারি না। ট্রাস্টি বোর্ড ব্যবস্থা নিতে পারে। দুজন কর্মচারীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এছাড়া আগামী ২৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছি। তবে অভিভাবকরা আপাতত শান্ত হলেও সন্ধ্যায় ঘোষণা দিয়েছেন, যে কর্মচারীদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে তারা কারা? তাদের বিষয়ে অভিযোগ কোথা থেকে এসেছে? ইচ্ছে মতো আসল অপরাধীকে রক্ষা করে যাকে তাকে শাস্তি দিলে হবে না। মূল অপরাধীকে গ্রেফতার ও বিচারসহ সকল দাবি না মানা হলে আন্দোলন চলবে। স্কুল যেদিন খোলা হবে সেদিন আবারও জমায়েতের ঘোষণা দিয়ে অভিভাবকদের একজন দিলরুবা আক্তার বলেছেন, অপরাধীকে রেখে আমরা আমাদের সন্তানকে সেখানে পাঠাতে পারি না।
×