ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র লায়লাতুল মি’রাজের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৫ মে ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র লায়লাতুল মি’রাজের গুরুত্ব

আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সঙ্গে রাহমাতুল্লিল আলামীনের আরশে আজীমে মহামিলনের রাত লায়লাতুল মি’রাজ। এই বিশ্বজগত আল্লাহ জাল্লা শানুহুর এক অপূর্ব সৃষ্টি। আল্লাহ হচ্ছেন রব্বুল আলামীনÑ বিশ্ব জগতের রব আর এই বিশ্বজগত সৃষ্টির সূত্রপাত তিনি ঘটান যে নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে সেই নূর মুবারকই হচ্ছে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহ্মদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূর মুবারক। মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মখ্লুকাতরূপে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁকে পৃথিবীতে তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস সালামকে পৃথিবীতে খলীফা হিসেবে প্রেরণেরও বহু পূর্বে, এমনকি তাঁর মানব আকৃতিতে সৃষ্টিরও বহু পূর্বে প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সেই আলমে আরওয়াহ্ বা রূহের জগতে নবী ও রসূল হিসেবে ঘোষণা করেন, তাঁকে নবুয়ত ও রিসালতের অভিষেকে অভিষিক্ত করেন। পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতার প্রথমে প্রেরিত হয়ে আগমন করেন হযরত আদম আলায়হিস সালাম, সেইসঙ্গে জনবসতি সমৃদ্ধ করার জন্য তাঁর স্ত্রী হযরত মা হাওয়া আলায়হাস সালামের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদেরই সন্তান-সন্ততি মানবজাতি বা বনী আদম। মানুষের হিদায়াত দান করার জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহু যুগে যুগে অসংখ্য নবী রসূলকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের প্রিয়নবী প্রেরিত হয়ে আসেন। তাঁর পৃথিবীতে তশরীফ আনয়নের মধ্য দিয়ে হিদায়েতের পূর্ণ স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বিশ্ব মানবসভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং আল্লাহর দেয়া একমাত্র জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের পূর্ণতা আসে। প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু। তিনি তাঁকে যাবতীয় শিক্ষাদান করে এক পর্যায়ে তাঁকে সৃষ্টির তাবত রহস্য প্রদর্শনের জন্য সমগ্র বিশ্বজগত পরিভ্রমণ করান, এমনকি তাঁর বিরাটত্ব, মাহাত্ম্য ও কুদ্রতের কেন্দ্র আরশে আজিমে নিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। এই অনন্য ঘটনা মি’রাজ নামে পরিচিত। হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পঞ্চাশ বছর বয়সকালে মি’রাজ সংঘটিত হয়। মাটির পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের সকল স্তর অতিক্রম করে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সঙ্গে তাঁর একান্ত সাক্ষাত ঘটে। এখানে উল্লেখ্য যে, চল্লিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম ওহী লাভ করেন। প্রথম ওহীর প্রথম উচ্চারণ ছিল ‘ইকরা’Ñ পাঠ করো। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে সেই জ্ঞানের পূর্ণতা প্রদান করেন মি’রাজের মাধ্যমে। মি’রাজের কয়েকটি স্তর রয়েছে। যেমন ১. কা’বা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বুরাকে চড়ে গমন। ২. বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে নূরের কুদ্রতী সিঁড়ি পেরিয়ে আসমানে গমন এবং একে একে সাত আসমান পরিভ্রমণ করে বায়তুল মামুর হয়ে সিদ্রাতুল মুন্তাহা-সীমান্তকুল বৃক্ষ পর্যন্ত উপনীত হওয়া। ৩. সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে রফ্রফ্ নামক কুদ্রতী যানে মহান আরশে উপনীত হওয়া এবং আল্লাহ্র দীদার লাভ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন মধ্যে দুহ ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন (সূরা নজম : আয়াত ৮-১০)। দীদার লাভকালে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মহা আনন্দ-আবেগে দেহ-মনের সমস্ত প্রেম, শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান ব্যক্ত করেন এবং উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে : আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু ওয়াত্ তাইয়েবাতুÑ সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান, তাবত্ ইবাদত ও পবিত্রতা আল্লাহ্র জন্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু এর জবাবে ইরশাদ করেন, আস্সালামু আলাইকা আয়্যুহান নাবীও ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু- হে নবী সালাম, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত আপনার প্রতি। এই সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উম্মতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেন : আস্সালামু আলায়না ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহীন- সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক আমাদের ওপর এবং আল্লাহ্র নেক বান্দাদের ওপর। তিনি আরো বললেন : আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুÑ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই। জবাব এলো : ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু ওয়া রসূলুহু- আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল। এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, আরশে আজীমে যখন আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ও তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মধ্যে উপরোক্ত সালাম ও সাক্ষ্য বিনিময় হচ্ছিল তখন ফেরেশতা জগতের সকল ফেরেশতা ও রূহগণ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে পাঠ করছিলেন : আল্লাহুম্মা সল্লে ‘আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মদ। আমরা কুরআন মজীদে দেখতে পাই আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্র এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্র এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পেশ করেন। ওহে, তোমরা যারা ইমান এনেছো, তোমরাও নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথ সম্মানের সাথে সালাম জানাও (সূরা আহযাব : আয়াত ৫৬)। সিহাহ্ সিত্তা হাদীস শরীফের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই ঘটনার রাতে কা’বা শরীফের নিকটবর্তী শি’বি আবিতালিবে হযরত উম্মে হানী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহার গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন। গভীর রাতে আল্লাহ্র ফেরেশতা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম কয়েকজন ফেরেশতাসহ এসে তাঁকে কা’বা শরীফের হাতীমে নিয়ে আসেন এবং তাঁর বক্ষ বিদারণ করে তাঁর কল্ব মুবারককে আবে যম্যম্ দ্বারা ধৌত করে তা যথাস্থানে আবার লাগিয়ে দেন। তিনি এক অপূর্ব আসমানী শক্তির তেজোদীপ্ত আলোক ধারায় উদ্ভাসিত হন। এরই মাধ্যমে তাঁকে পার্থিব পরিবেশ থেকে মাধ্যাকর্ষণ স্তর ভেদ করে উর্ধ থেকে উর্ধলোকে, এমনকি সৃষ্টি জগতের শেষ সীমা পাড়ি দিয়ে আরও উর্ধে গমনে উপযোগী করে নেয়া হয়। তাঁকে আসমানী পোশাক পরিধান করানো হয়। অতঃপর তাঁকে বুরাকে চড়িয়ে এক নিমিষে জেরুজালেমে নিয়ে আসা হয়। এখানে বায়তুল মুকাদ্দিসে সকল নবী-রসূলের বিশাল জাম‘আতে প্রিয় নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইমামতি করেন। তিনি যেসব নবীর ইমাম এবং রসূলগণের নেতা অর্থাৎ ইমামুন নাবীয়ীন এবং সাইয়েদুল মুরসালীন তা এখানে প্রমাণিত ও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনিই যে প্রথম নবী এবং সর্বশেষ নবী তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর তাঁর উর্ধলোক সফর শুরু হয়। সঙ্গে ছিলেন হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম। মুহূর্তের মধ্যে প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে উপনীত হলে আসমানের দ্বাররক্ষী ফেরেশ্তা তাঁদের পরিচয় জানতে চায়। হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্্ সালাম পরিচয় প্রদান করেন। সঙ্গে সঙ্গে দরওয়াজা খুলে যায়। ফেরেশ্তারা তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানান। এখানে তাঁর সাক্ষাত পরিচয় হয় হযরত আদম আলায়হিস সালামের সঙ্গে, দ্বিতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ঈসা ও ইয়াহ ইয়া আলায়হিস সালামের সঙ্গে। তৃতীয় আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালামের সঙ্গে, চতুর্থ আসমানে সাক্ষাত হয় হযরত ইদ্রীস আলায়হিস সালামের সঙ্গে, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুণ (আ:)-এর সঙ্গে, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা কলীমুল্লাহ্ আলায়হিস সালামের সঙ্গে, সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালামের সঙ্গে। সব নবী রসূলের সঙ্গে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়। সপ্তম আসমানে ফেরেশ্তাদের কা’বা বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশ্তার সঙ্গে একবার সালাত আদায় করেন। তাঁদের দ্বিতীয়বার সালাত আদায়ের সুযোগ ঘটে না। এই বায়তুল মামুরের ঠিক নিচ বরাবর পৃথিবীতে কা’বা শরীফ অবস্থিত। এখান থেকে তিনি সিদ্রাতুল মুন্তাহার নিকট উন্নীত হন। সিদ্রাতুল মুন্তাহা বা সীমান্ত কুল বৃক্ষের নিকট এসে হযরত জিবরাঈল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, এটাই আমার শেষ সীমানা; এই সীমানা অতিক্রম করলে আমি পুড়ে ছারখার হয়ে যাব। এখন শুধু আপনি আর আপনার রব্। সিদ্রাতুল মুন্তাহা থেকে তিনি রফ্রফে চড়ে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পাড়ি দিয়ে স্থান কালের উর্ধে লামাকান ও লাযামানে উপনীত হন। তিনি নিকট থেকে নিকটতর হলেন। নূর আর নূরের আতিশয্যে তিনি একাকার হয়ে গেলেন। আল্লাহ্র দীদার লাভ করলেন। বিস্ময় ও আনন্দে নৈকট্য ও পরিপূর্ণতার অপূর্ব অনুভবে অভিভূত হয়ে গেলেন। আল্লাহ্র যা ওহী করার ছিল তা করলেন। কালামে মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তাঁর দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। তিনি তো তাঁর রব্-এর মহান নিদর্শনসমূহ দেখলেন (সূরা নজর : আয়াত ১৭-১৮)। মি’রাজ শরীফের মাধ্যমে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জানা-অজানা, প্রকাশ্য ও গোপন তাবত জ্ঞানের নিদর্শন সরেজমিনে অবলোকন করেন এবং আল্লাহ জাল্লা শানুহুর কুদ্রতের সীমা-পরিসীমা প্রত্যক্ষ করে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ মাকামে উন্নীত হন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু উম্মতে মুহম্মদীকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দেন। এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মরতবাও নির্ধারণ করে দেন দৈনিক পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান। বলা হয়েছে : আস্সালাতু মি’রাজুল মু’মিনীন- সালাত (নামাজ) হচ্ছে মু’মিনের জন্য মি’রাজ। আমরা সালাতে বসা অবস্থায় যে আত্তাহিয়াতু পাঠ করি সেটা মি’রাজকালে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের মধ্যে কথোপকথনেরই বাক্যসমূহ। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায়। আল্লাহ্ এই মহাসফরের মাধ্যমে তাঁর হাবীব রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে যেমন সর্বজ্ঞানের অধিকারী করেন, তেমনি তিনি যে সরওয়ারে কায়েনাত বিশ্বজগতের নেতা তা সর্বত্র জাহির করে দেন। আল্লাহ্ হচ্ছেন রব্বুল আলামীন আর তাঁর হাবীব হচ্ছেন রহমাতুল্লিল আলামীন- এটা সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পবিত্র মি’রাজের রাত রব্বুল আলামীনের সঙ্গে রহমাতুল্লিল আলামীনের দীদার লাভের রাত, এ এক মহামিলনের রাত। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
×