ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মালয়েশিয়ার উপকূলে ভাসছে আরও শতাধিক অবৈধ অভিবাসী

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৫ মে ২০১৫

মালয়েশিয়ার উপকূলে ভাসছে আরও শতাধিক অবৈধ অভিবাসী

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মালয়েশিয়ার লঙ্কাবি উপকূলবর্তী সাগর এলাকা থেকে দুই ইঞ্জিন বোট বোঝাই ৮শ’ অবৈধ অভিবাসীকে গত মঙ্গলবার ফিরিয়ে দেয়ার পর বুধবার শতাধিক মানুষ বোঝাই আরেকটি বোটকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে দেশের কোস্টগার্ড। এদিকে, মানব পাচার রোধে থাই সরকারের বিমান বাহিনী সাগর এলাকাজুড়ে নিয়মিত টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়া লঙ্কাবি দ্বীপের কাছাকাছি আন্দামান সাগরে ৮শ’ অবৈধ অভিবাসী বোঝাই যে দুটি নৌকাকে সে দেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি এর মধ্যে ১০জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বিবিসি সূত্রে বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এসব অবৈধ অভিবাসীর জীবন বাঁচাতে তাদের প্রবেশ করার সুযোগ দিতে অনুরোধ জানিয়েছে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সরকারের প্রতি। ৮শ’ অভিবাসী বহনকারী দুই ইঞ্জিনবোট এখনও সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এতে একটিতে ৫শ’ ও অপরটিতে ৩শ’ অভিবাসী রয়েছে। সর্বশেষ বুধবার যে ১শ’ অভিবাসী বোঝাই ইঞ্জিন বোটটি লঙ্কাবি দ্বীপের কাছাকাছি থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে এর সর্বশেষ অবস্থা এখনও জানা যায়নি। এদিকে, থাইল্যান্ডে আটক দুই শতাধিক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীকে উদ্ধারের পর তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সে দেশের পুলিশ। এর আগে মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষে সে দেশের স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লঙ্কাবি দ্বীপে প্রায় দেড় হাজার অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের উদ্ধারের পর বুধবার পেনাংয়ের উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে ৫শ’ অভিবাসী বহনকারী আরেকটি ইঞ্জিন বোট পাওয়া যায়। অবৈধ অভিবাসীদের ঢল সামলাতে নারাজ মালয়েশিয়ার সরকার। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী বলেন, অবৈধ অভিবাসী ঢল সামলাতে আমরা পারি না। ফলে বুধবার রাতভর এসব নৌকার কোনটিকে উপকূলে ঘেঁষতে না দিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই গভীর সাগরমুখে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এসব অভিবাসীর সকলেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিক। এদিকে, গত মঙ্গল ও বুধবার যেসব অবৈধ অভিবাসী মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ধরা খেয়ে উপকূলে ফিরে এসেছে এদের ১১৬ জনকে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এদের অধিকাংশ কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, যশোর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের। আদালত এদেরকে তাদের স্বজনদের হাতে তুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আদালত চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, এদের অধিকাংশ অসুস্থ। ভালভাবে চলাফেরা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এরমধ্যে ৪ জনকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, প্রায় দেড়মাস অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে সাগরে থেকে এরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। উদ্ধারকৃতদের অনেকে জানিয়েছেন, থাইল্যান্ডে ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দালাল ও ইঞ্জিনবোট মাঝিরা বোট ফেলে গা ঢাকা দিয়েছে। এসব দালাল ও মাঝির অধিকাংশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের বাসিন্দা বলে তারা জানিয়েছে। অপরদিকে, গভীর সমুদ্রে যে সাড়ে ৮ হাজার অবৈধ অভিবাসী বিভিন্ন ছোট-বড় বোট ও ট্রলারে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে তাদের উদ্ধারে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ার কোন সরকারই দ্রুত কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে স্ব স্ব দেশের জলসীমায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এর ফলে মাঝখানে অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে মালয়েশিয়াগামী অবৈধ অভিবাসীর বিপুলসংখ্যক নারী, পুরুষ ও শিশু। এদিকে, থাইল্যান্ড পুলিশের উপপ্রধান আয়েক আং সানানন্ট জানিয়েছেন, পুলিশ ইতোমধ্যে ১৮৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। সত্বরই আইনী প্রক্রিয়া শুরু হবে। এছাড়া ৬৩ জনের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে তা পরবর্তী নির্দেশনার জন্য তারা অপেক্ষা করছে। উল্লেখ্য, গত রবিবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে মেনতাং পুনতংগামী দুটি নৌকা থেকে ৬শ’ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করে সে দেশের কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এর পর সোমবার লঙ্কাবি দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের কাছে ১৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৫৫৫ বাংলাদেশী নাগরিক বলে জানিয়েছে মালয়েশিয়া পুলিশ। এদিকে, সাগরে অবৈধ অভিবাসীর ঢল নামায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এসব অবৈধ অভিবাসীকে সাগর থেকেই পুনরায় ফিরিয়ে দেয়ার বিরোধিতা করছে। এসব সংস্থার মতে, সাড়ে ৮ হাজারের মতো বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা অভিবাসী সাগরে ভাসছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাই সরকার অবৈধ অভিবাসী নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর নতুন করে মানব পাচার এ মুহূর্তে থমকে গেছে। তবে ইন্দোনেশিয়া উপকূলে দফায় দফায় অভিবাসী উদ্ধারের খবর আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। অপরদিকে, গত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের জলসীমা দিয়ে মালয়েশিয়াগামী মানব পাচারের ঘটনা চলে এলেও এর ট্রানজিট পয়েন্ট হয়েছে থাইল্যান্ডের উপকূলবর্তী এরাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে জঙ্গল অভ্যন্তরে। এসব জঙ্গলে শেকলঘেরা বেষ্টিত ৮০টিরও বেশি বন্দীশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব বন্দীশালায় নিহতদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গণকবর। এসব বন্দীশালা ও গণকবরের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর মানব পাচারকারী গডফাদার ও দালালরা নিমিষেই গা ঢাকা দিয়েছে। তবে অসমর্থিত খবর অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে গত দেড় দশকে ৫ হাজারেরও বেশি লোক থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছে। উদ্ধারকৃতদের পক্ষে এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী পাচার হওয়াদের অধিকাংশ বাংলাদেশী এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে এদেরকে থাই জঙ্গলের বন্দীশালায় নির্যাতনে নির্যাতনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যারা মরেছে এদের সঠিক কোন ঠিকানাও জানা যায়নি। আর যারা বেঁচে এসেছে এবং আসছে তারাও মৃতপ্রায়। বন্দী শিবিরে যারা নির্যাতনে মরেছে এদের গণকবর দেয়া হয়েছে। আর যারা ট্রলারে মরেছে তাদের সাগরেই নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া বন্দীশালায় মহিলাদের যৌনদাসি বানানো হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের ২৪১ দালাল সাগরপথে মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। মালয়েশিয়ার নাগরিক আলী রাজ্জাক নামের শীর্ষ এক গডফাদার থাইল্যান্ডে থেকে মানব পাচার প্রক্রিয়ায় জড়িত। তার অধীনে রয়েছে টেকনাফ অঞ্চলে বেশকিছু সহযোগী। ইতোমধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এ সহযোগীদের ৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদিকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া স্টাইলে দেশের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় একাধিক স্পট রয়েছে বলে অভিযোগ আছে । এসব স্পটে পাচারের আগে মানুষ জড়ো করা হয়। বন্দীশালা স্টাইলে এসব স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে দালালদের নিয়োজিত সশস্ত্র ক্যাডার। ইতোপূর্বে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিলকৃত পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে ৩শ’ দালালের নাম উল্লেখ করা হলেও ছোটবড় হিসেবে দালালের সংখ্যা ৫শতাধিক বলে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হচ্ছে। গেল বছর মানব পাচার এতই ভয়াবহ রূপ নেয়, ওই সময় মানব পাচারকারী গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো বিভিন্ন শ্রেণীর পেশার মানুষ। দালালদের নগদ অর্থ বিলির অবস্থা দেখে বিভিন্ন স্তরের মানুষ আদম পাচারের কাজে সম্পৃক্ত হয় অর্থের লোভে। মিনি দালালদের মধ্যে কেউ কাউকে ফুঁসলিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করলে সে পায় ৫ হাজার টাকা। যার মাধ্যমে দালালের হাতে যাবে, সে পায় জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা। যে মিনি দালাল উপকূলে ট্রলারে তুলে দেয় সে জনপ্রতি পায় ২০ হাজার টাকা। উপকূলে এসব লোকজনকে আটক রেখে সশস্ত্র পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত ক্যাডাররা পায় জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা হারে। সর্বশেষ ট্রলারে মাথা গুনে লোকজনকে তুলে দেয়ার পর কতজন উঠেছে তা বুঝিয়ে দেয়া হয় ট্রলারের হেড মাঝিকে। ট্রলারের হেড মাঝির কাছে থাকে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। ঐ ট্রলারে অস্ত্রসহ তার সহযোগী থাকে ৮-১০ জন। উল্লেখ্য, আরাকান প্রদেশের জনৈক তাজর মল্লুক মাঝি ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের বাংলাভাইখ্যাত দিল মোহাম্মদ, বন্দুকযুদ্ধে নিহত ধলু হোছনসহ ৫-৬ জনের একটি সিন্ডিকেট সড়কপথে অবৈধভাবে মানব পাচার রুটের মূল আবিষ্কারক। এদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশের অভিযানের কারণে উখিয়া টেকনাফসহ কক্সবাজার জেলাজুড়ে মানব পাচারকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শীর্ষ মানব পাচারকারীরা এখন আত্মগোপনে চলে গেছে। পাশাপাশি বিজিবি ও কোস্টগার্ড সাগর উপকূলে কড়া প্রহরায় রয়েছে। কক্সবাজার ১৭বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে জানান, মানব পাচারের রুটখ্যাত সোনারপাড়ার রেজুখালের মুূখে বিজিবি সদস্যরা পালাবদল করে দিনরাত পাহারা দিচ্ছে। বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি ছাড়াও মালয়েশিয়াগামী এবং দালালদের ধরতে বিজিবি সাগরে স্পীডবোট নিয়ে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের এসব অভিযানের ফলে ইয়াবা ও মানব পাচার ব্যবসায় জড়িতদের নিত্যনতুন মডেলের মোটরসাইকেলের ঝনঝনানি বর্তমানে আর চোখে পড়ছে না। মানব পাচারকারীরা লাপাত্তা হওয়াতে সাধারণ মানুষের কদর বেড়েছে। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৫ দালাল নিহত হওয়ায় জেলার পুরো চালচিত্র বদলে গেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে মালয়েশিয়াগামী ১১৬ যাত্রী উদ্ধারের ঘটনায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে অর্ধশতাধিক অজ্ঞাতনামা মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানায় মামলা রুজু করা হয়েছে।
×