ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঞ্চিত কৃষক

নীলফামারী ও রৌমারীতে ॥ গম সংগ্রহে তুঘলকি কারবার

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৪ মে ২০১৫

নীলফামারী ও রৌমারীতে ॥ গম সংগ্রহে তুঘলকি কারবার

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ জেলার রৌমারী খাদ্যগুদামে সরকারী গম সংগ্রহ অভিযান নিয়ে চলছে তুঘলকি কারবার। কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে নেয়া সরকারের এ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। রৌমারী উপজেলায় নয়শ’ মে.টন গম ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ বরাদ্দের সব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া হয়। এখন এই ভাগের অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের মাঝে দেখা দিয়েছে বিরোধ। শুধু তাই নয় এ উপজেলার ৫ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাদ্দ কম পাওয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বয়কট করেন উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভা। উপজেলার দুই ভাইস চেয়ারম্যানও বরাদ্দের অনিয়ম নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সর্বশেষ এই ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটায় বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এ বিষয়টি নিয়ে এখন প্রশাসনে চলছে তোলপাড়। অভিযোগে জানা যায়, সরকার ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুনের মধ্যে রৌমারী খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে ৯শ’ মে.টন গম সরাসরি কৃষকের কাছে ক্রয় করতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। প্রকৃত কৃষকদের বঞ্চিত করতেই বিলম্বে গত ২৮ এপ্রিল বরাদ্দকৃত গম ক্রয়ে একসভা রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গম বরাদ্দের বিভাজনে এমপি রুহুল আমিনের জন্য ১০০ টন, উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর জন্য ৪০০ টন, ইউএনওর নামে ৫০ টন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ১৪০ টন, উপজেলা পরিষদের দুই ভাইস চেয়ারম্যানের জন্য ৪০ টন, রৌমারী উপজেলার ৫ জন চেয়ারম্যানের বিপরীতে ৫০ টন, উপজেলা চালকল মিল মালিক সমিতির নামে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯০ মে.টন গম। এর বাইরে ৩০ মে.টন রাখা হয়েছে অন্যদের ম্যানেজ করার জন্য। বরাদ্দ কম পাওয়ায় অনেকের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও হতাশা। এই ক্ষোভ বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন ঘটছে বসচা। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে রৌমারী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা খন্দকার রেজাউল ইসলাম বলেন, সরকারী নিয়ম-নীতি মেনে কৃষকের কাছ থেকে গম ক্রয় করা হচ্ছে। এর বাইরে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। রৌমারী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ও বন্দবের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের জানান, গত ২৯ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় গম বরাদ্দের বিভাজন নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। তারা চেয়ারম্যান প্রতি ৫০ মে.টন বরাদ্দ দাবি করেন। কিন্তু বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ১০ মে.টন করে। এ কারণে তারা সভা থেকে ওয়াকআউট করেন। পরে ইউএনওর আশ্বাসে ফিরে আসেন। ফলে সমন্বয় কমিটির সকালের মিটিং বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসেম ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তার সহকর্মী মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জনপ্রতি ২০ টন করে। তিনি গম বরাদ্দের ভাগবাটোয়ারার অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এখন আর ছোট কৃষকের ঘরে গম নেই। গম চলে গেছে বড় গৃরস্থ ও ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে শেষ সময়ে গম কেনার সরকারী কার্যক্রমের সুফল কৃষকের কপালে জুটছে না। রৌমারী খাদ্য গুদামের ইনচার্জ (ওসিলএসডি) আবু বক্কর সিদ্দিক এমপির ১০০ টন, আওয়ামী লীগের ৪০০ টন বরাদ্দের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রায় ৩০০ মে.টন গম ক্রয় করা হয়েছে। এর বাইরে গত ১০ মে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজা আহমেদ রিপন দলবল নিয়ে গোডাউনে হাজির হয়। এ সময় তিনি ৫০ মে.টন গম বরাদ্দের দাবি জানান। তিনি তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে দলীয় নেতাদের কাছে যেতে বলেন। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে গম সংগ্রহ অভিযানে বাধা দেয়। এ খবর পেয়ে ছুটে আসে রৌমারী সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রাজু আহমেদ খোকা, উপজেলা শ্রমিকলীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম সালু, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হারুন অর রশীদ, সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম মিনু, ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাসির উদ্দিন লালসহ অনেকে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে উভয়ের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সংসদ সদস্য রুহুল আমিন অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বড় ঘটনা আছে। সবসময় অস্ত্রের ঝনঝনানি হয় ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। তার নামে ১০০ মে.টন গম বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষকের গম কৃষক দেবে। ফেসবুকে কি লেখা হলো, পত্র-পত্রিকায় কি লেখা হলো তাতে আমার যায় আসে না। সরকার আছে, সরকারী বিভিন্ন বিভাগ আছে তারা দেখবে। এর বেশি বলতে রাজি হননি তিনি। সিøপ পাচ্ছে না নীলফামারীর কৃষক স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, কৃষক কার্ড থাকার পরেও গমের স্লিপের জন্য হন্য হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমরা হাঁফিয়ে গেছি। কিন্তু ভাগ্যে জুটাতে পারিনি স্লিপ। খাদ্য গুদামে ৪০ কেজি (এক মণ) গম বিক্রি করতে পারলে পাওয়া যেত ১ হাজার ১২০ টাকা। কিন্তু স্লিপ না পাওয়ায় বাজারে বাধ্য হয়ে ওই পরিমাণ গম বিক্রি করতে হচ্ছে ৬ শ’ টাকায়। এতে প্রতিমণ গমে কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫২০টাকা। আর আমাদের এই গম কিনে সরকারী খাদ্যগুদামে সরবরাহ করছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা। এমন অভিযোগ ডিমলা উপজেলার গমচাষী আবুল কাশেম, মফিজার রহমান, আব্দুল কাদের, আজম আলীসহ একাধিক কৃষকের। ডিমলার মতো ঠিক একই অবস্থা জেলা সদর, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলায়। গম চাষীদের অভিযোগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নীলফামারীতে সরকারীভাবে গম ক্রয় অভিযান শুরু হলেও প্রকৃত কৃষক বা গম চাষীরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষকদের গমের স্লিপ চলে যাচ্ছে টাউট বাটপার ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার হাতে। এ ব্যাপারে জেলার ৭টি সরকারী খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষি কর্মকর্তা বলেন নীলফামারীর ৬ উপজেলার সরকারীভাবে গম ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউপি চেয়ারম্যান ও কৃষি বিভাগের লোকজনের যৌথ স্বাক্ষরে স্লিপ বিতরণ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কোন চাপ থাকলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ পর্যন্ত নীলফামারীর ৭টি খাদ্যগুদামে সরকারীভাবে ১ হাজার ৭৮২ মেট্রিক টন গমের মধ্যে ৪শ’ মেট্রিকটন গম ক্রয় করা হয়েছে।
×