ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সচিব কমিটির সুপারিশ পেশ ॥ নয়া বেতন স্কেল

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ মে ২০১৫

সচিব কমিটির সুপারিশ পেশ ॥ নয়া বেতন স্কেল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা মূল ধরে নতুন বেতন কাঠামো করার সুপারিশ করেছে সচিব কমিটি। বাংলাদেশ বেতন ও চাকরি কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই বেতন কাঠামো করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশে আগের মতো ২০টি ধাপে বেতন কাঠামো রাখার জন্য সুপারিশ হয়েছে। নতুন বেতন কাঠামোর বাস্তবায়ন হলে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ সরকারী চাকরিজীবীর বেতন ৮৭ থেকে ১০১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন এই বেতন কাঠামো কার্যকর করা হবে। তবে বেতন বাড়লেও এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুুল মুহিত। জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। বুধবার সচিবালয়ে সচিব কমিটির প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুুল মুহিতের দফতরে প্রতিবেদনটি জমা দেন। ধারাবাহিকতা অনুযায়ী, অর্থমন্ত্রী দেখার পর আন্তঃমন্ত্রণালয়ে এ কাঠামো নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদে যাবে অনুমোদনের জন্য। এদিকে, দুপুরের দিকে সরকারী ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী প্রতিবেদনের এ তথ্য সাংবাদিকদের জানান। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা এটি মিনিস্ট্রিতে দেখব, আমার কলিগদের সঙ্গে আলোচনা করব। তবে ৪ জুনের আগে দেখবই না। এটি কেবিনেটে যেতে যেতে মাস দুয়েক লাগবে। কিন্তু এটি ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, পে-স্কেল ঘোষণা করতে জুলাই-আগস্ট মাস লেগে যেতে পারে। তবে যখনই এটা ঘোষণা করা হোক না কেন, ১ জুলাই থেকে এটা কার্যকর হবে। নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, দুই ধাপেই এটা বাস্তবায়ন করা হতে পারে। আগেও তাই হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশন গত ২১ ডিসেম্বর যে প্রতিবেদন দিয়েছিল তাতে ১৬টি গ্রেডে বেতন কাঠামো প্রস্তাব করা হয়েছিল। সচিব কমিটির সুপারিশে আগের মতো ২০টি ধাপে বেতন কাঠামোর সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখানে ২০টি ধাপই রয়েছে। আমার যেটা মনে হয়, এটাকে আর টাচ করা উচিত হবে না। নতুন এই বেতন কাঠামোর বাস্তবায়ন হলে প্রায় ১৪ লাখ সরকারী চাকরিজীবীর বেতন ৮৭ থেকে ১০১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে কতটা প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন এটার কোন ইমপ্যাক্ট হয় না। অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকেরই বেতন বাড়ানো উচিত। প্রতিবছর অটোমেটিক্যালি হওয়া উচিত। প্রতিবেদনে এটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, কমিটির সুপারিশ কমিশনের সুপারিশ থেকে কম হবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতেও তাই হয়েছে। কমিশনের রিপোর্ট দাখিলের পর বাজারের ওপর কোন প্রভাব পড়েনি, তাই এ পর্যায়েও হওয়ার কোন যুক্তি নেই। ফরাসউদ্দিনের বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আহ্বায়ক করে গত ১ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের এই কমিটি করে সরকার। অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন। আগের বেতন কাঠামোর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের বেতন ও চাকরি কমিশন (অষ্টম কমিশন) গঠন করা হয়েছিল গত বছরের ২৪ নবেম্বর। দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় ১৩ মাস পর তারা প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নতুন কাঠামো কার্যকর করতে সরকারের বেতন বাবদ খরচ বাড়বে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের হাতে রয়েছে। সচিব কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চূড়ান্ত কাঠামো অনুমোদন করা হলে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে যোগ দেয়া একজন চাকরিজীবীর মূল বেতন হবে মাসে ২৫ হাজার টাকার বেশি। আগের কাঠামোতে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মূল বেতন ছিল ১১ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০০৯ সালে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী বর্তমানে সরকারী চাকরিজীবীরা সর্বনিম্ন ৪,১০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা বেসিক ধরে বেতন পাচ্ছেন। এর সঙ্গে তারা পাচ্ছেন মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ্য ভাতা, যা ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের দিন থেকে এই মহার্ঘ্য ভাতা বিলুপ্ত হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, পর্যালোচনা কমিটি ২০টি গ্রেডে বেতন দেয়ার সুপারিশ করেছে। নতুন বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকবে না। নতুন পে-স্কেল পেয়ে সরকারী চাকরিজীবীরা সবাই খুশি হয়েছে সাংবাদিকদের এ কথার জবাবে তিনি বলেন, খুশি করার জন্য এটা দেয়া হয়নি। আগেরবার ৬২ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছিল। এবার কতটা বেড়েছে? প্রসঙ্গক্রমে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের বেতন কি বাড়েনি? সময়ের সঙ্গে বেতন বাড়াটা খুব স্বাভাবিক। এ বিষয়ে পে-কমিশন শতকরা হিসেবে অটো বেতন বৃদ্ধির একটা সুপারিশ করেছে। এটা পর্যালোচনা করে দেখা হবে। বাজারে প্রভাব পড়বে না ॥ নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুুল মুহিত। নতুন পে-স্কেলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারেÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেন মুহিত। তিনি বলেন, আমি এর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করি। এসব আপনাদের কথা। আপনারাই আপনাদের মতো করে লেখেন। এ প্রসঙ্গে সচিব কমিটির প্রধান বলেন, কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ মাস আগে। এতদিনেও বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। তাই এখন এর প্রভাব পড়ারও কোন কারণ নেই। ২০টি গ্রেডের বেতন কাঠামো ॥ শুধু বেতন দিতে প্রথম বছরের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর পরের বছর থেকে বেতনের সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ- সুবিধা দিতে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। বর্তমানে প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি ব্যয় হয় এ খাতে। এতে সরকারের এ খাতে ব্যয় বাড়ল দ্বিগুণেরও বেশি। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের জন্য বেতন সুপারিশ করা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। সিনিয়র সচিবের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা (নির্ধারিত) এবং সচিবের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। এ ছাড়া প্রথম ধাপের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৭৫ হাজার টাকা। দ্বিতীয় ধাপে মূল বেতনের সুপারিশ এসেছে ৭০ হাজার টাকা, বর্তমানে তা রয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে তৃতীয় ধাপে বর্তমানের ২৯ হাজার টাকার পরিবর্তে ৬০ হাজার, চতুর্থ ধাপে বর্তমানের ২৫ হাজার ৭৫০ টাকার পরিবর্তে ৫২ হাজার, পঞ্চম ধাপে ২২ হাজার ২৫০ টাকার পরিবর্তে ৪৫ হাজার, ষষ্ঠতে ১৮ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৩৭ হাজার, সপ্তমে ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩২ হাজার টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে অষ্টম ধাপে ১২ হাজার ও নবম ধাপে ১১ হাজার টাকা মূল বেতন রয়েছে বিদ্যমান বেতন স্কেলে। এই দুটি মিলিয়ে করা হয়েছে অষ্টম ধাপ। এর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে এই সুপারিশটি করা হয়েছে বলে জানান ফরাসউদ্দিন। এ ছাড়া নবম ধাপে ১৭ হাজার, দশমে আট হাজারের পরিবর্তে ১৩ হাজার এবং একাদশে ছয় হাজার ৪০০ টাকার পরিবর্তে ১১ হাজার ৫০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে দ্বাদশ ধাপে ৫ হাজার ৯০০ ও ত্রয়োদশ ধাপে ৫ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতন। এই দুটি মিলিয়ে নতুন দ্বাদশ ধাপের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে ১১ হাজার। এ ছাড়া ত্রয়োদশ ধাপে ১০ হাজার ৪০০ টাকা, চতুর্দশ ধাপে বর্তমানের ৫ হাজার ২০০ টাকার পরিবর্তে ৯ হাজার ৮০০ টাকা সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানের সপ্তদশ ধাপে মূল বেতন ৪ হাজার ৫০০ ও অষ্টাদশ ধাপে ৪ হাজার ৪০০ টাকা। এই দুটি মিলিয়ে নতুন কাঠামোতে করা হয়েছে পঞ্চদশ ধাপ, যার জন্য সুপারিশ নয় হাজার টাকা। বর্তমানের ১৯তম ধাপের বেতন ৪ হাজার ২৫০ টাকার পরিবর্তে করা হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং ২০তমের চার হাজার ১০০ টাকা পরিবর্তে করা হয়েছে ৮ হাজার ২৫০ টাকা।
×