ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আবুল আজাদ

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শওকত ওসমান- শেষ বেলার জবানবন্দী

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৪ মে ২০১৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শওকত ওসমান- শেষ বেলার জবানবন্দী

আজ ১৪ মে, কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের এই মহান কথাশিল্পী কলমযুদ্ধের পাশাপাশি আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত থাকলেও নতুন প্রজন্মের কাছে এখন আর অতটা পরিচিত নন। কারণ বুঝি শওকত ওসমান নন, নতুনদের দিকভ্রান্ত অভিরুচি। সেই শওকত ওসমানের প্রয়াণ দিবসে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর শেষ বেলার জবানবন্দীটা স্মরণ করা যাক। ১৯৯৮ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে রাইটার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও জন্মদিন উদ্যাপন পরিষদ আয়োজিত মহান কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ৮২তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামান তাঁর শতায়ু কামনা করেছিলেন। জবাবে শওকত ওসমান রসিকতাচ্ছলে তাঁর ভাষায় ‘বোনাস লাইফে’র প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে শ্রোতৃম-লী অনুজগণের উদ্দেশে উচ্চারণ করেন, ‘এবার যেখানে যাবো/অসম্ভব ফিরে আসা/কাঁকড়ার মত অগ্রে পশ্চাতে/জেনো বিচরণশীল/অনুজের প্রতি তার ভালবাসা।’ শতায়ু হলেন না, চলেই গেলেন শওকত ওসমান। দেহ ত্যাগের পর সতেরো বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর সেই ‘বোনাস লাইফে’র সরব উচ্চারণ আজ নির্মম রসিকতা হয়েই আমাদের অগ্রে-পশ্চাতে বিচরণ করছে। জীবদ্দশায় উদ্যাপিত শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে যে অভিনন্দন স্মারকটি প্রকাশিত হয়, তাতে ‘একাশি নট আউট’ শীর্ষক জীবনের শেষ ও শ্রেষ্ঠ অভিভাষণটি রচনা করেন শওকত ওসমান। এবারও ভাগ্যেরই পরিহাস বলতে হবে, একাশিকে অতিক্রম করলেও বেশিদূর যেতে পারলেন না। বোধকরি বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বিরাশি বছরের সূচনায় দাঁড়িয়ে জীবনের মর্মভেদী গভীর অন্তর্গত সত্যেরই দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। বয়সের ভারে কখনোই ন্যুব্জ হয়ে পড়েননি শওকত ওসমান। তারুণ্যের প্রাণোচ্ছল চাঞ্চল্য আর প্রতিবাদী চেতনায় প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত হয়েছেন। সভা-সমাবেশের ডাক তাঁকে কিছুতেই রহিত করতে পারেনি। হাসপাতালের শয্যা থেকে ছুটে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মৌলবাদবিরোধী সমাবেশের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে। গুরুতর রকমের অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও প্রাণের তাগিদেই যুদ্ধাপরাধীদের বয়কটের ডাক দিয়ে এবং বিচার দাবি করে বক্তৃতাও দেন। জীবনের শেষ দশকটিতে জাতির জন্য ত্রিকালদর্শীর মতো অনিবার্য পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মৌলবাদবিরোধী ভূমিকায়, কুসংস্কার-অনাচার প্রতিরোধে সকল সামাজিক আন্দোলনের পুরোধা হয়ে উঠেছিলেন শওকত ওসমান। দুই. জীবনের শেষ অভিভাষণ ‘একাশি নট আউট’-এ শওকত ওসমান জাতিসত্তার চেতনা বিকাশমূলক সমাজমনস্ক ঐতিহাসিক নানা সত্যকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। মহান উত্তরাধিকারের জনক হিসেবে স্বীকার করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কায়েমী স্বার্থবিরোধীদের ফন্দি-ফিকিরের নিন্দা করেন। জীবনের গোধূলিলগ্নে প্রত্যাশা ছিল শওকত ওসমানের, ‘বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান, আদিবাসী, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সকল নাগরিক মোহমুক্ত জীবন যাপনের দিকে অগ্রসর হবে।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নদ্রষ্টা বলেন তিনি। তাই তাঁকে বলতে শুনি, ‘আমাদের একজন তেমনই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের চার স্তম্ভ নির্মিত হয়: ১. গণপ্রজাতন্ত্র ২. জাতীয়তাবাদ ৩. সমাজতন্ত্র ও ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা নামে। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর গোটা মুসলমান কওমের ভবিষ্যত অগ্রগামী পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষ স্তম্ভটি : ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ‘আন্তর্জাতিক ও দেশীয় কুলাঙ্গার আততায়ীর ষড়যন্ত্রে’ সপরিবারে অকালে নিহত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের প্রতিবাদে নির্বাসনকে বরণ করেছিলেন শওকত ওসমান। জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে তাই সেই প্রিয় নেতা সম্পর্কে অমন গর্বিত শ্রদ্ধা রেখে যেতে পেরেছেন। এমন অমিততেজা সমাজসংস্কারক সকল অনাচারবিরোধী মহান কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও সদস্য সচিব, শওকত ওসমান পরিষদ
×