ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেন্টমার্টিনে ১১৬ যাত্রী উদ্ধার

কক্সবাজারে বন্দুকযুদ্ধে আরও এক মানব পাচারকারী নিহত

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৩ মে ২০১৫

কক্সবাজারে বন্দুকযুদ্ধে আরও এক মানব পাচারকারী নিহত

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরও একজন মানবপাচারকারী মারা গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে পুলিশের দুই সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশে তৈরি বন্দুক ও গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও ভুমুরিয়া ঘোনা এলাকায় মানবপাচারকারীদের সঙ্গে কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের বন্দুকযুদ্ধের এ ঘটনা ঘটে। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি কাজী মতিউল ইসলাম জানান, ভোরে কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও ভুমুরিয়া ঘোনায় মালয়েশিয়া পাচারের জন্য মানুষ জড়ো করার সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে দালালচক্র পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ। এক পর্যায়ে মানব পাচারকারীরা পিছু হঠলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বেলাল হোসেন নামের এক তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশে তৈরি বন্দুক ও ২ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করেছে। নিহত বেলাল হোসেন কক্সবাজার সদরের খুরুস্কুল ইউনিয়নের কাউয়ারপাড়ার বাসিন্দা মৃত মোহাম্মদ মুস্তাফার পুত্র। সে তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী এবং তার বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে বলে ওসি জানিয়েছে। এনিয়ে গত ৫ দিনে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৫ মানবপাচারকারী নিহত হয়েছে। সেন্টমার্টিনের গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে ১১৬ যাত্রীসহ মালয়েশিয়াগামীসহ একটি জাহাজ আটক করেছে কোস্টগার্ড সদস্যরা। মঙ্গলবার বিকেলে বঙ্গোপসাগরে টহলরত কোস্টগার্ড এ অভিযান চালায়। উদ্ধার হওয়া ১১৬ যাত্রীসহ জাহাজটি সেন্টমার্টিন উপকূলে নিয়ে আসা হয়েছে। আটক জাহাজ সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণ গভীর বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের জলসীমায় অবস্থান করছিল বলে জানা গেছে। এদিকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে দু’দেশের প্রশাসন বন্দীশিবির, গণকবরের সন্ধান, লাশ ও কঙ্কাল উদ্ধারসহ দালালদের ধরপাকড় অভিযান অব্যাহত রাখায় সাগরে অপেক্ষমাণ বহু লোক ওই দু’দেশের সীমান্তে ভিড়তে পারছে না বলে জানা গেছে। তারা ধরা পড়ার ভয়ে সাগরে শুধু লোনাজল পান করে উপোস অবস্থায় দিনাতিপাত করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সেন্টমার্টিনের অদূরে ১৩০ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলার ভাসছে বলে তথ্য মিলেছে। তবে কোস্টগার্ড জানিয়েছে, ওই ট্রলারটি মিয়ানমার অভ্যন্তরে। ওই ট্রলারে থাকা চকরিয়ার ভুট্টো নামের এক যাত্রী ট্রলার থেকে মোবাইল ফোনে অন্য একটি বোট পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করার আকুতি জানিয়েছে। হাসেম মাঝির মালিকানাধীন মালয়েশিয়াগামী যাত্রী বোঝাই ওই ট্রলার থেকে ভুট্টো মোবাইল ফোনে তার সহোদরকে বলেন, ট্রলারটিতে ১০৮জন বাংলাদেশী ও ২২ জন রোহিঙ্গা নারী রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন সাগরে অভুক্ত থাকার পর নানা অসুখে ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে বলে তিনি জানান। বিষয়টি কোস্টগার্ডকে জানানো হলে এ ব্যাপারে নজর রাখে কোস্টগার্ড কর্তৃপক্ষ। পরে কোস্টগার্ড সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠে। মানবসেবায় এবং উপোস ব্যক্তিদের উদ্ধারে অভিযান চালায় তারা। জানা যায়, সাগর পথে অবৈধভাবে মানব পাচারের নামে দালাল চক্রের নৃশংসতা ববর্তরতা যেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। দালালদের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার শিকার অসংখ্য পরিবার এখন সর্বশান্ত। জোর করে সমুদ্র পথে মালেয়শিয়া ও থাইল্যান্ড নিয়ে গিয়ে কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য লোকজনকে বন্দীশালায় আটক রেখে ব্যাপক নির্যাতন, হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় এবং নির্মমভাবে হত্যার কাহিনী খুবই করুণ। মঙ্গলবার জেলার টেকনাফ সীমান্ত জনপদের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় নিখোঁজ ও নিহত পরিবারের করুণ অবস্থা। দুর্গম পাহাড়ী এলাকা হোয়াইক্যংয়ের কয়েকটি গ্রাম আমতলী চাকমা পাড়া, কাটাখালী, খারাইংগ্যাঘোনা, উনছিপ্রাং, লম্বাবিল, কানজর পাড়া গ্রামের দুই কলেজছাত্রসহ অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে দালাল চক্র। দালালরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে ওই এলাকার ৭ জনকে। পাচার হয়ে পড়া অধিকাংশ ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান ও বিপুল লোকজনকে উদ্ধারের খবরে এসব পরিবারে দেখা দিয়েছে করুণ আহাজারি। থামছে না হতভাগ্য মা-বাবার বিলাপ। হোয়াইক্যংয়ের দুর্গম পাহাড়ী জনপদ আমতলী গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ মংমাচিং চাকমা তার এক পুত্র ও দুই নাতিকে হারিয়ে এখন শোকে কাতর। ৬ মাস পূর্বে মংমাচিং চাকমার পুত্র উখিয়া ডিগ্রী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র থিমংচিং চাকমা ও উক্যংগ্যা চাকমার পুত্র কলেজ ছাত্র মংথাই চাকমা, তার বড় ভাই চালংথাইং প্রকাশ অজয়া চাকমা দালালদের ফাঁদে পড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল। এদের ৩ জনকে দালালরা বন্দশালায় আটক রেখে মুক্তিপণের জন্য ব্যাপক নির্যাতন চালায়। এরমধ্যে তিমংচি চাকমার পুত্র মংমাচিং চাকমা পিটুনির নির্মম আঘাতে মৃত্যুবরণ করে। বন্দীশালায় তার সঙ্গে থাকা অপর দুই জন এ খবর নিশ্চিত করায় দালালরা তাদের দীর্ঘদিন আটকে রেখে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা হারে আদায় করে এবং পরবর্তীতে ওই দুই জনকেও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বলে পরিবারের লোকজন নিশ্চিত করে। স্বজনদের উদ্ধারে দুই লাখ টাকা করে চাঁদা দিয়েও হিংস্র দালাল জল্লাদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের মা-বাবা বন্দীশালা হতে তাদের উদ্ধারের জন্য নিজের ভিটাবাড়ি, গরু-ছাগল বিক্রি করে এখন প্রায় নিস্ব। পরিবারের লোকজন বিক্রি করে দেয়া ভিটাবাড়ি ছেড়ে এলাকার আত্মীয়ের কাছে আশ্রিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এ অঞ্চলের কাটাখালী গ্রামের আবুল মঞ্জুরের পুত্র আবছার মিয়াকে স্থানীয় দালাল চক্র ৪ মাস পূর্বে সমুদ্র পথে থাইল্যান্ড নিয়ে যায়। অসহায় বাবা তার ভিটাবাড়ি বন্ধক দিয়ে পুত্রকে উদ্ধারের জন্য দালাল চক্রের হাতে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দী থাকার পর দুই মাস পূর্বে অসহায় পিতা নিশ্চিত হয় যে, তার পুত্র মৃত্যুবরণ করেছে। আলাপকালে পুত্রের জন্য পাগল হত ভাগী মা আলকিছ খাতুন জানান, টাকা দিতে বিলম্ব করায় দালাল চক্র কোমরে পিঠে বেধড়ক আঘাত করে তার পুত্রকে মেরে ফেলেছে। তারা জানান, স্থানীয় হোছন আলীর পুত্র শামশুল আলম ও উলুবনিয়া এলাকার মৃত নজির আহমদের পুত্র কোরবান আলীসহ একটি দালাল সিন্ডিকেট নিহত আবছারকে থাইল্যান্ড পাচার করেছে। এছাড়া হোয়াইক্যং খারাইংগ্যাঘোনা এলাকার ইসমাইলের পুত্র জসিমকে কয়েক মাস পূর্বে দালাল চক্র থাইল্যান্ড পাচার করে। বন্দিশালায় নির্যাতনে তারও মৃত্যু হয়। উনছিপ্রাং এলাকার মৌলভী আজিজুল হকের পুত্র আজইয়া ও কানজর পাড়া উত্তর মাথা এলাকার মৃত আব্দুস সালামের পুত্র বদি আলমকে একইভাবে থাইল্যান্ড পাচার করে দালাল চক্র। এ দুই জনকেও দালালরা পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেন। স্থানীয় কুতুবদিয়া এলাকার জবর মুল্লুকের পুত্র আবুল কালাম, সাহাব উদ্দিন, উনছিপ্রাংয়ের মৌলভী তাজ উদ্দিন, লম্বাবিল এলাকার মমতাজ, কানজর পাড়ার মীর কাসেম, ভুলু মিয়াসহ একটি দালাল চক্র তাদের থাইল্যান্ড পাচার করেছে বলে জানা গেছে। সূত্রে জানা গেছে, চকরিয়া ডুলাহাজারার মোঃ রাসেলের এক বছরেও খোঁজ মেলেনি। মালুমঘাট রিংভং ছগিরসাহা কাটা এলাকার মোঃ শাহ্ আলমের পুত্র রাশেলকে দালাল চক্র অপহরণ করে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফাঁসিয়াখালী ঘোনা পাড়ার আবু ছিদ্দিকের পুত্র গিয়াস উদ্দীন, রাসেলকে ভাল বেতনে চাকরি দেয়ার নাম করে জোরপূর্বক চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে যায়। চাকরিতে ঘুষ দিতে হবে বলে, তার পরিবার থেকে গত বছরের ১১ মে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে তাকে গুম করে ফেলে। এর কিছু দিন পরে রাসেলের পিতা শাহ্ আলম গিয়াস উদ্দীনের কাছে ছেলের খবর জানতে চাইলে রাসেলকে মালেশিয়া পাঠানো হয়েছে, সে এখন টাকার অভাবে থাইল্যান্ডে বন্দী রয়েছে বলে আরও ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। কিন্তু এ পর্যন্ত ওই রাসেল কি বেঁচে আছে না মরে গেছে, তার কোন খবর না পাওয়ায় ছেলের শোকে প্রায় পাগল হয়ে গেছে মা-বাবা। হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে গিয়ে নিখোঁজ যুবক-কিশোরদের তালিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবপাচার রোধে এবং মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা অসহায় ব্যক্তিদের নিয়ে গত এক বছর ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আমেরিকাভিত্তিক এনজিও রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় কক্সবাজারে হেল্প এনজিও’র প্রতিনিধিরা ব্যাপক জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা ৭০জনকে স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি আরও ৫ উপজাতিসহ ১৮জন নিখোঁজ থাকার তথ্য তাদের হাতে রয়েছে।
×