ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভূমিকম্পে আবার কেঁপে উঠল সারাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৩ মে ২০১৫

ভূমিকম্পে আবার কেঁপে উঠল সারাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২৫ এপ্রিল থেকে ১২ মে সময়ের ব্যবধান মাত্র ১৮ দিন। আর এ সময়ের ব্যবধানে আবারও বড় মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল বাংলাদেশসহ গোটা এলাকা। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৫ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ঢাকা থেকে ৬১১ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে নেপালে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৩। উৎপত্তি স্থল নেপালের কোদারী এলাকা থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে। তবে নেপাল থেকে উৎপন্ন এ ভূমিকম্পে দেশের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক নেমে এলেও কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। প্রথম দফায় বড় মাত্রা ভূমিকম্পের পর পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরও ছয়দফা ভূমিকম্প হয়েছে। যার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৩ মাত্রার। বাংলাদেশ সময় ১টা ৩৬ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে সংগঠিত হয়। অন্যগুলোর মাত্রা ছিল ৫ এর ওপরে। আন্তর্জাতিক একদল গবেষক সম্প্রতি তাঁদের গবেষণায় উল্লেখ করেছেন এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় উৎস হলো হিমালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। তাদের গবেষণায় দেখানো হয় নেপালের প্রধান চ্যুতিরেখা থেকে হিমালয় বরাবর ফাটলরেখার অস্তিত্ব রয়েছে। ভারত এবং এশিয়ান টেকটোনিক প্লেট বরাবর এ ফাটল রেখাটি অবস্থিত। বিশেষ করে মধ্য হিমালয়ে যেখানে চ্যুতিরেখার অস্তিত্ব রয়েছে তা ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে চার শ’ কিলোমিটার দূরত্বে। ফলে নেপালে যে কোন ধরনের ভূমিকম্পের প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়বে। এদিকে নেপাল থেকে উৎপত্তি হওয়ায় ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ কেঁপে ওঠে। আতঙ্কে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় আতঙ্কে এক বৃদ্ধার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার নাম নূর নাহার। উপজেলা সদরের খুনিয়াপাড়া গ্রামের কপিল উদ্দিনের স্ত্রী। মঙ্গলবার দুপুরে গোসল করার সময় ভূমিকম্পে মাটিতে পড়ে যান। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে নেপালে মঙ্গলবারে ভূমিকম্পের আঘাতে ২৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক। গত ২৫ এপ্রিল নেপালের একই এলাকা থেকে ভয়াবহ মাত্রার ভূমিকেম্পর উৎপত্তি হয়। যার প্রভাবে নেপালে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সে ভূমিকম্পের উদ্ধার কাজ এখনও চলছে। তবে সম্প্রতি একদল আন্তর্জাতিক গবেষক আভাস দিয়েছেন হিমালয় এ অঞ্চলে ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় উৎস। সম্প্রতি নেপালে বারবার বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানার পর আভাসের সত্যতা মিলছে। তারা হিমালয়ের যে ফাটল রেখা রয়েছে সেখান থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে এসে পড়তে পারে তাও গবেষণায় উল্লেখ করেছেন। তবে নেপালে এ ভূমিকম্পে বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলে ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আন্তর্জাতিক গবেষকরা হিমালয়ের পাদদেশে যে কোন সময় ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এর দূরত্ব মাত্র সাড়ে চারশ’ কিলোমিটারে মধ্যে হওয়ায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ন্যানিয়াং (হধহুধহম) প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি জানিয়েছেন যে কোন সময়ে মধ্য হিমালয়ে ৮ থেকে সাড়ে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এটি হলে হিমালয়ের উপরিভাগ ভেঙ্গে পড়তে পারে। এতে বলা হয় মধ্য হিমালয় বরাবর একটি ফাটল রেখা সৃষ্টি হয়েছে যা থেকে ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ ফাটলরেখাটি হিমালয়ের সম্মুখভাগে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। আর এখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হলে এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে এসে পড়তে পারে। পল ট্যাপোনিয়ার নামের একজন বিশেষজ্ঞের মতে, অতীতে এ এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ এলাকায় এ ধরনের ভূমিকম্প পুনরায় সংঘটিত হতে পারে। আর এটি হলে পৃথিবীর শীর্ষ ভূপৃষ্ঠও ভেঙ্গে পড়তে পারে। পল ট্যাপোনিয়ার তার গবেষণায় দেখিয়েছেন ১২৫৫ সালে এবং ১৯৩৪ সালে সংঘটিত দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশ বিছিন্ন হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখানো হয় নেপালের প্রধান চ্যুতিরেখা থেকে হিমালয় বরাবর ফাটলরেখার অস্তিত্ব রয়েছে। ভারত এবং এশিয়ান টেকটোনিক প্লেট বরাবর এ ফাটল রেখাটি অবস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন হিমালয় বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস। অতীতে এলাকায় ভায়বহ ভূমিকম্পে সংঘটিত হয়েছে। নতুন করে ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার জন্য প্রচুর শক্তি জমা হয়েছে। তারা বলেন, হিমালয় পর্বতমালা থেকে যে কোন সময় ভূমিকম্প হতে পারে এ কথাটি বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলে আসছেন। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে তারা জোর দিয়েই বলছেন যে কোন সময় এখান থেকে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। মধ্য হিমালয়ে যেখানে চ্যুতিরেখার অস্তিত্ব রয়েছে তা ঢাকা থেকে মাত্র সাড়ে চারশ’ কিলোমিটার দূরত্বে। ফলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরি কেন্দ্রের পরিচালক সৈয়দ হুমায়ন আকতার বলেন, ১৯৫০ সালে হিমালয়ের অরুনাচল এলাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আর ১৯৩৪ সালে বিহার নেপালের দিকে সংঘটিত হয় শক্তিশালী অন্য আরেকটি ভূমিকম্প। স্বাভাবিকভাবেই এ গ্যাপের মধ্যবর্তী অঞ্চল ভূমিকম্পের জন্য এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার বিলহামও কয়েক বছর আগেই হিমালয় পাদদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তার গবেষণায় দেখিয়েছেন হিমালয় পাদদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্য যথেষ্ট ভূতাত্ত্বিক গ্যাপ রয়েছে। এ গ্যাপ থেকে ৮ মাত্রার দুটি এবং ৭ মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নেপালে যে গ্যাপ থেকে বারবার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হচ্ছে এর সঙ্গে হিমালয়ের পাদদেশের ফাটলরেখায় সংযোগ রয়েছে। এদিকে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনা, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঈশ্বরদী, সিদ্ধিরগঞ্জ, পার্বতীপুর মির্জাপুর থেকে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টাররা জানান, প্রায় ১ মিটিন স্থায়ী এ ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ভূমিকম্পের সময় মানুষ ঘর থেকে আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আতঙ্কে ক্লাসরুম ছেড়ে অনেকে বেরিয়ে আসে। অনেক জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া এলাকায় অবস্থিত লুৎফা টাওয়ার ও প্যানোরমা প্লাজার মাঝখানে জোড়া ফাটল দেখা দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। পাবনা শহরের নিমতলায় জনকণ্ঠ নিজস্ব সংবাদদাতার চারতলা বাসার বীমে মারাত্মক ফাটলের সৃষ্টি হয়। লালমনিরহাটে দু’দফায় ভূমিকম্পের পর শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। এতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভূমিকম্পের পরপরই অনেক এলাকা স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়।
×