ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

পুঁজি ও পিকেটি

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৩ মে ২০১৫

পুঁজি ও পিকেটি

চৌত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ফ্যানহীন নষ্ট এসির রমেশচন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনের উপচেপড়া ভিড় দরজার বাইরের করিডর ছুঁয়েছে। বৈশাখী তাপ উপেক্ষা করে শ্রোতারা জ্বলছেন একুশ শতকের ‘পুঁজি’র উত্তাপে। আলোচনার বিষয় ‘পুঁজি’ হলেও মূল ফোকাস। টমাস পিকেটি। একুশ শতকে পুঁজি নিয়ে তিনি কী বলেছেন- যা পশ্চিমা পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ঝড় তুলেছে? জানতে আগ্রহী এ দেশের পরিবর্তনকামী মানুষেরাও। পাঁচ মে কার্ল মার্কস-এর এক শ’ আটানব্বইতম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে বাঙলার পাঠশালা বেছে নেয় প্রাসঙ্গিক এ বিষয়টি। মূল আলোচক অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশের সঙ্গে ছিলেন সহযোগী অন্যান্য আলোচক। জার্মান ভাষায় লেখা মার্কস-এর ‘পুঁজি’র প্রথম খ- প্রকাশিত হয় আঠারো শ’ সাতষট্টি সালে। পটভূমি ছিল আঠারো-উনিশ শতকের ফ্রান্স, জার্মানি ও ইংল্যান্ড। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের জন্ম ও বিকাশের যুগ ছিল সেটা। ‘পুঁজি’ লেখার বেশ আগে আঠারো শ’ ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশে অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের নিয়ে ‘কমিউনিস্ট লীগ’ গঠন করেন। এর পরের বছর বন্ধু এঙ্গেলস ও তাঁর যৌথ প্রচেষ্টায় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র জন্ম। সমাজের ক্রমবিকাশের ইতিহাস, ধনতান্ত্রিক সমাজের উৎপত্তি ও অসামঞ্জস্যর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দিল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন ব্যবস্থা গড়ায় তাদের নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা দিল। বলার অপেক্ষা রাখে না এ কাজগুলো নিরবচ্ছিন্ন শান্তিময় পরিবেশে করতে পারেননি তিনি। পুলিশী তাড়ায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে অবিরাম নির্বাসনে থেকেছেন। কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতিতে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে তাকে। ‘পুঁজি’ শেষ করার পর বন্ধু এঙ্গেলসকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘এ কাজে আমি আমার স্বাস্থ্য, সুখ ও পরিবারকে বিসর্জন দিয়েছি’ (সাম্যবাদের ভূমিকা-অনিল মুখার্জী)। সীমাহীন দারিদ্র্য কেড়ে নিয়েছিল দুই শিশুপুত্র। নিজে তিনি ধনী পরিবারের সন্তান ছিলেন। স্ত্রী ছিলেন তাঁর চেয়েও বেশি ধনবান বাবার মেয়ে। কিন্তু নিজের সংসারের অভাব-অনটনে ভেঙ্গে পড়েছিল তাঁর স্বাস্থ্য। তবে দমে যাননি। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করেছিলেন স্বামীর মতোই। মার্কস-এর ‘পুঁজির’ এক শ’ ছেচল্লিশ বছর পর ফরাসী তরুণ গবেষক টমাস পিকেটি লিখলেন ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’। উনিশ শ’ আটানব্বই থেকে দু’হাজার তেরো এই দীর্ঘ সময় ছিল এ বইয়ের প্রস্তুতি পর্ব। দু’হাজার চৌদ্দয় প্রথমে ফরাসী ভাষায় এবং পরে ইংরেজী অনুবাদে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাত শ’ পৃষ্ঠার এ বই বেস্ট সেলার তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নেয় কয়েক মাসে। বিক্রি হয় প্রায় তিন লাখ কপি। প্রথম সারির পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খ্যাতিমান শিক্ষকদের আলোচনার সমালোচনার বিষয় হয়। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার অন্যতম রক্ষণশীল পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ তাদের চার মে দু’হাজার চৌদ্দ সংখ্যায় পিকেটিকে ‘এ কালের কার্ল মার্কস’ বলে মন্তব্য করেছে। টমাস পিকেটি ‘একুশ শতকের পুঁজি’ লিখেছেন তথ্যপ্রযুক্তির চরম বিকাশের এ যুগে, যখন শ্রম ও শ্রমিকের সংজ্ঞার পরিধি বেড়েছে। পুঁজির চেহারায়ও পরিবর্তন এসেছে। শিল্প বিপ্লবের যুগে পুঁজির বিকাশ ও অগ্রযাত্রার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে মার্কস এর অনিবার্য পরিণতি নির্ধারণ করেছিলেন আয় ও সম্পদের আপেক্ষিক বৈষম্য বৃদ্ধি, ঘনীভূত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট, পরিণতিতে বিপ্লব। এবং বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকবে শ্রমিক শ্রেণী। পিকেটি বলছেন, তখনকার বাস্তবতায় এ বিশ্লেষণ ঠিক ছিল। কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরের বাস্তবতা মার্কস দেখে যেতে পারেননি। এর অভিঘাত পুঁজিবাদের চালকদের রাজনৈতিকভাবে আরও অভিজ্ঞ করেছে। পুঁজিরও সাময়িক নবজাগরণ হয়েছে। এ বাস্তবতা দেখে গেলে মার্কস-এর ব্যাখ্যায় হয়ত আরও অনেক কিছু পাওয়া যেত। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোয় উনিশ শ’ তেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত আয় ও সম্পদ বৈষম্য অনেকদিন নিচু মাত্রায় থাকলেও উনিশ শ’ সত্তর সালের পর থেকে তা আবার অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে একুশ শতকের প্রথম দশকে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে একুশ শতকে এসে পুঁজিবাদে বেশ কিছু উপাদান যোগ হয়েছে, যা মার্কসের সময় সেভাবে হয়ত স্পষ্ট ছিল না। যেমন মার্কস পুঁজির বিভিন্ন ‘ধরন’এর যে বর্ণনা দিয়েছেন তার প্রতিটিই এখন আলাদাভাবে শক্তিশালী। আর্থিক পুঁজি, শিল্প পুঁজি, বাণিজ্যিক পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজি- সবগুলোকেই মনে হয় যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এসব পুঁজি পণ্য ও মুদ্রাবাজারকে বিস্তৃত করেছে, যা পুঁজির গতিশীলতা যেমন বাড়িয়েছে তেমনি এর সংকটকেও প্রকট করেছে। দু’হাজার নয়-এর সঙ্কট তার একটি উদাহরণ। আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান, যা একুশ শতকে বিশেষভাবে প্রকট হয়ে চোখে পড়ছে। তা হলো তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে মানুষের ‘জ্ঞান’ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে শাসক শ্রেণীকে এর প্রতিও মনোযোগী হতে হচ্ছে। এখন শুধু শ্রমশক্তি বা যন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ নয়, জ্ঞানের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। বিষয়টি এম এম আকাশ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন- একদিকে যেমন যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে; অন্যদিকে আবার ‘জ্ঞান’ নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে শুধু যন্ত্রের বা শ্রমশক্তির নিয়ন্ত্রণ নয়, জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণও শ্রমিক শ্রেণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উল্টোদিকে জ্ঞানী শ্রমজীবীদের উৎপাদনশীলতা এবং দরকষাকষির ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে। কিন্তু জ্ঞানকে জ্ঞানের মালিক থেকে আলাদা করে ক্রয়-বিক্রয় করা যাচ্ছে না। এর ফলে পুঁজি এখন একটি অসম-স্বত্ব শ্রমবাহিনী তৈরি করেছে- যেখানে নানা ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শ্রমিক তৈরি হয়েছে। কেউ পাচ্ছেন বেতন, কেউ পাচ্ছেন মজুরি। এমনকি কেউ কেউ পাচ্ছেন মুনাফার অংশ বা ডিভিডেন্ড। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন ব্যবস্থায় তাদের কারোরই কোন মালিকানা কর্তৃত্ব বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। আবার কোথাও শ্রমজীবীরা ঝড়পরধষ ঝড়ষরফধৎরঃু ঝবপঃড়ৎ-এর অধীনে যৌথ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, ফলে শ্রমিক শ্রেণীর ভেতরেই আয় ও সম্পদের যথেষ্ট তারতম্য তৈরি হয়েছে। মার্কস যেমন ভেবেছিলেন বৃহৎ যন্ত্রশিল্পের অধীনে দুনিয়ার সকল শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হবে, তেমন সংখ্যা-গরিষ্ঠতা বা অটুট ঐক্য আগের মতো সহজে আর তৈরি হচ্ছে না। একুশ শতকের এই বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পিকেটি তার একুশ শতকে পুুঁজি লিখেছেন। তার বই নিয়ে আলোচনা করা বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের কাজ। পাঁচ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে তাই হয়েছিল। যা চোখে পড়ার মতো তা হলো ওই আলোচনায় উপচে পড়া ভিড়। সেখানে চল্লিশোর্ধদের উপস্থিতিকে ছাপিয়ে গেছে তরুণদের উপস্থিতি। পরিবর্তনকামী এ তরুণদের দেখে ভরসা জাগে। এ তরুণদের মতো আরও অসংখ্য তরুণ নিশ্চয়ই ছড়িয়ে আছে সারাদেশে। যারা চিন্তা করতে পারে। যুক্তির পরম্পরা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে চারপাশের ঘটনাবলী। ভাবালুতায় ভরা সমাজ ও রাজনীতির জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবে যুক্তিনির্ভর সমাজ ও মননশীল রাজনীতি এমন ভাবা কি অযৌক্তিক? মার্কস একটি পদ্ধতির কথা বলেছিলেন, তাকে ভিত্তি করে পিকেটিও বলছেন। আরও অনেক চিন্তাবিদ এ নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় পরিবর্তনের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসছে না। অবশ্য সব কিছু আগে থেকে ঠিক করে রাখা যায় না। পরিস্থিতিই অনেক সময় বলে দেয় কি করতে হবে।
×