ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

স্বদেশের নয়া মানচিত্রে আঁকা তাঁর মুখ

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১১ মে ২০১৫

স্বদেশের নয়া মানচিত্রে আঁকা তাঁর মুখ

বিশ্বমানবের তালিকায় তাদের নাম নেই। নামহীন গোত্রহীন এই না-মানুষরা জানতই না কোনটা তাদের দেশ। কারণ তাদের ছিল না কোন নির্দিষ্ট দেশ। যেন নিজ বাসভূমে পরবাসী তারা। আশ্চর্য ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে বসবাস তাদের। সেই তারা এখন বিশ্বমানবে পরিণত হতে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের এতদিনের লালিত নাগরিকত্ব। একদার নিজ দেশের নতুন নাগরিক পরিচয় নিয়ে এবার নিজ মাতৃভূমির পরিচয়দানকারী হিসেবে বসবাস করতে পারবেন, যা তারা দীর্ঘকাল ধরে চেয়ে আসছেন। বিগত ৬৮ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসেছে, পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছে পিতা-পিতামহরা নাগরিকত্বহীন, দেশহীন, মানবেতর জীবনের গ্লানি বহন করে। দেশ ভাগ তাদের কপাল পুড়িয়েছে, জীবনকে করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেই ভাগ্যহতদের নতুন প্রজন্ম অবশেষে দেশ ফিরে পাচ্ছে, পাচ্ছে খোলা আকাশ, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, নিজস্ব পরিচয়, বাঁচার মৌলিক অধিকার। সীমান্তের ঘেরাটোপে থাকা এক বন্দীশালা, যার নামকরণ ছিটমহল। সেখানকার বাসিন্দারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসা বর্তমান নারী-পুরুষরা পিতা-পিতামহরা স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো বাঁচার যে স্বপ্ন দেখতেন, তার বাস্তব রূপ দেখতে পারবেনÑ এমন আশায় তারা বছরের পর বছর বুক বেঁধেছিলেন। আশাবাদী হয়ে ওঠেছিলেন, যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতা তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্পাদিত চুক্তির বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অবিচল থেকে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই যথেষ্ট কৃতিত্বের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গিয়েছেন। সাফল্যও পেয়েছেন। কঠিন হলেও পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফেরত এনেছেন নিজ বাসভূমে। দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে ছেড়েছেন। সমুদ্র জয় করেছেন মুর্শিদাবাদে বাংলাদেশ সীমান্তে জেগে ওঠা চরের মালিকানাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সহিংস ঘটনার পর শেখ হাসিনা দূতিয়ালী চালিয়ে সেই চর বাংলাদেশের দখলে নিয়ে আসেন। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সমস্যার সমাধানে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে দেশের স্বার্থকে রক্ষা করে চলেছেন। আগামীতে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিও করাতে পারবেন। ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে যতই মতবিরোধ থাক শেখ হাসিনা তাঁর সপ্রতিভ রাজনৈতিক উজ্জ্বলতায় উভয়ের কাছে নিজস্ব দাবি আদায়কে গুরুত্ববহ করে তুলতে পেরেছেন। ভারতের কেন্দ্রে যেই সরকারই থাক না কেন, শেখ হাসিনা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিজের দেশের হক আদায়ে পিছপা নন। তাই কংগ্রেস বা বিজেপি কিংবা কোয়ালিশন যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণের মাধ্যমে ভারতের কাছ হতে ন্যায্য দাবি আদায়ে নিরন্তর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি তো জানেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটি ঝুলে যায়। ছিটমহলগুলোর সমস্যা সমাধানে দেশীয় ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারগুলো কোন তৎপরতা না চালিয়ে বিষয়টিকে ভারতবিদ্বেষী রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করার অপচেষ্টা চালায়। তদুপরি ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর ক্ষমতাসীন বিএনপিও ভারতবিরোধিতার জজবা তুলে অধিকার ও দাবিসমূহ আদায় করতে পারেনি। এমনকি ১৯৯২ সালে তিন বিঘা করিডরের ওপর পূর্ণ অধিকার আদায় করতে পারেনি। শর্তসাপেক্ষে কয়েক ঘণ্টার জন্য করিডর খোলা রাখার চুক্তি করে বিএনপি সরকার। ভারত সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিন বিঘা করিডর চালু করাতে পেরেছি। তবে গঙ্গার পানিবণ্টন বিষয়ে বলতে ভুলে গেছেন বলে দাবি করেন। খালেদার নতজানু নীতির ফলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসী দেশের মূল ভূখ-ে আসার সুযোগ কিছু সময়ের জন্য পেলেও তাদের সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধান হয়নি। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে করিডর দিনরাত ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করান। সেখানে বিদ্যুত সংযোগ প্রদান, ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল চালু করেন। তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশী ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা সফর করে সেখানকার অধিবাসীদের সমস্যা আন্তরিকতার সঙ্গে শোনেন ও তা সমাধানের আশ্বাসও প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলবাসীর মধ্যে আশার যে আলো মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ফুটে ওঠেছিল, সেই চুক্তি অবহেলিত পড়ে ছিল। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চুক্তিটি বাস্তবায়নে ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা কথাও বলেন। এ আলোচনার ফলাফল ছিটমহলবাসীকে আশান্বিত করে তোলে। শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় সেই আশার আলো আরও প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। দেশহীন না-মানুষদের দেশের দিশা দিলেন, মানুষ এবং নাগরিকের মর্যাদাও দিলেন। তারা এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন প্রথমবারের মতো। মৌলিক অধিকার হিসেবে এখন দেশের এ প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে অনায়াসে যেতে পারবেন। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো দীর্ঘদিন কাটানো বাসিন্দারা জানেন না স্বাধীনতা কী, নাগরিক অধিকার কাকে বলে। ওরা জানে অবরুদ্ধ জীবনের গ্লানি কত ভয়াবহ। কৃষিকাজ ও মৎস্য শিকারই যাদের পেশা, সেই তারা এখন বিশ্ব নাগরিকের স্তরে, না-মানুষ হতে মানুষের স্তরে পৌঁছার পথ খুঁজে পেয়েছেন। ছিটমহলবাসীর দেশ, নাগরিকত্ব নির্দিষ্ট হওয়ার পথ খুলে গেল শেখ হাসিনার দ্রুত দূতিয়ালীর কারণেই। মানবেতর ও অবরুদ্ধ জীবন থেকে তাদের বের করে আনার কাজটিও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার পক্ষপাতী তিনি। তাই পূর্বাহ্ণেই ছিটমহলের বাসিন্দাদের দেশের মূলধারায় নিয়ে আসার কাজটিও শুরু করতে সচেষ্ট রয়েছেন। সীমান্ত জটিলতাটি কখনই রাজনৈতিক ছিল না, ছিল মানবিক। ৬৮ বছর ধরে বিশ্ব হতে বঞ্চিত যে নারকীয় জীবন কাটিয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সেই অর্ধলাখ মানুষ এই প্রথম মুক্তির আলো পেতে যাচ্ছেন। তারা গাইতে না জানলেও তাদের অন্তর হয়ত অজান্তেই গেয়ে ওঠবেÑ ‘আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা।’ তারা দেখবেন এপারে লালসবুজের পতাকা, ওপারে ত্রিরঙ্গা পতাকা, যা তাদের আদি অকৃত্রিম দেশ। ইংরেজরা যাওয়ার আগে তাদের নরকবাসে রেখে গেছে অযাচিতভাবেই। অভিশপ্ত জীবনের ভার বইবার সব কষ্টকর অবস্থান হতে তাদের মুক্ত করার জন্য যিনি সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট, যিনি ১৯৭৪ সালের চুক্তিটিকে হুবহু বাস্তবায়নে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন, তিনি শেখ হাসিনা। সেই তৎপরতার ফসল ভারতের রাজ্য ও লোকসভায় সংবিধান সংশোধন বিল পাস। নজিরবিহীন ঘটনা যে, ভারতের যেসব রাজনৈতিক দল স্থলসীমান্ত চুক্তি পাসের বিরোধিতা করে আসছিল এতদিন ধরে, শেখ হাসিনার লিয়াজোঁর ফলে সেই তারাই বিল আনেন এবং সকল দলের সম্মতিতে তা পাস হয়। যে অসম প্রদেশের বিরোধিতার কারণে বিজেপিসহ কয়েকটি দল চুক্তিটিকে ঝুলিয়ে রেখেছিল, সেই অসমের রাজনীতিকদের বিলের সপক্ষে নিয়ে আসতে পেরেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। সীমান্তচুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ইতিবাচক ভাবমূর্তি যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অনুরূপভাবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ক্যারিশমাও প্রমাণিত হয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে, নিজের দেশের স্বার্থরক্ষায় শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দক্ষতা, যোগ্যতা, কর্মকুশলতা ও স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ। ছিটমহলবাসীর আস্থা, বিশ্বাসও তিনি অর্জন করতে পেরেছেন কাজের ভেতর দিয়ে। এমনটাই দেখা গেছে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর। শেখ হাসিনার আশ্বাস পেয়ে ২৪ দিন পর অনশন তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দা। ডাবের পানি ও ফলের রস খাইয়ে তাদের অনশন ভঙ্গ করানো হয় নেত্রীর পক্ষ হতে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও অবিলম্বে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ওই বছরের ১৮ মার্চ হতে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের ধারে পুঁটিমারী ছিটমহলে গণঅনশনে বসেছিলেন তারা। একই দাবিতে ভারতের কোচবিহারে ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল বাসিন্দা ১২ মার্চ থেকে অনশন শুরু করলেও ভারতের সরকার ও প্রশাসন তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। বহু অনশনকারী অসুস্থ হয়ে পড়ার পর বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের অনুরোধে ৮ এপ্রিল ২৮ দিনের মাথায় সে অনশন তুলে নেয়া হয় কোন আশ্বাস ছাড়াই। বাংলাদেশের অনশন মঞ্চে শেখ হাসিনার প্রতিনিধি সাংসদ বলেছিলেন, ‘আপনাদের অনশনে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়েছেন, ছিটমহল বিনিময়ের বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ঢাকা আসছেন, তার সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের পাশাপাশি ছিটমহল নিয়েও কথা হবে। ছিটমহলবাসীর ন্যায্য দাবি আদায়ে বাংলাদেশ তৎপর।’ এরপরই তারা অনশন প্রত্যাহারে সম্মত হয়। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় বলে এসেছেন, ছিটমহলগুলো নিজ নিজ দেশেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেখানে বসবাসকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক। তাদের নাগরিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। এই অধিকার বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরই স্বীকার করে আসছে। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তি সম্পাদনই শুধু নয়, এ লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনও করেছেন, যা তৃতীয় সংশোধন হিসেবে গ্রহণীয়। এমনকি চুক্তির শর্তানুযায়ী, বেরুবাড়ি ভারতের কাছে হস্তান্তরও করা হয়। সংবিধান সংশোধন ও এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করে তখন ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি, জাসদ, জাগমুই, জাতীয় লীগসহ সরকারবিরোধী দলগুলো। তারা একে ভারতের কাছে দেশ বিক্রির জজবা তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেয়। বেরুবাড়ি নিয়ে অনেক কবিতা, ছড়া ও নিবন্ধ লেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে এ জন্য ‘ভারতের পুতুল সরকারও’ বলা হয়। অথচ চুক্তিটি হয়েছিল ১৯৫৮ সালে নেহরু ও ফিরোজ খান নুনের মধ্যে সম্পাদিত ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তির আলোকে। যদিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। চুক্তিটির বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিকের দায়ের করা মামলায় ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ ভারতের সুপ্রীমকোর্ট ছিটমহল বিনিময়ের পক্ষে রায় প্রদান করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নতুন করে চুক্তি প্রণয়নের ওপর জোর দেন। তারই আলোকে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী চুক্তি করেন, যাতে অপদখলীয় জমি হস্তান্তরের বিষয়টি আনা হয়। মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে ভারতবর্ষ ভাগ করার সময় ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল রেডক্লিফের কমিশন দিল্লীতে বসে স্বল্প সময়ে দেশভাগের সীমান্তরেখা টানেন। অসতর্ক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি করে। আবার বাউন্ডারি কমিশনের অদূরদর্শিতার কারণেও এ ধরনের একটি দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট তৈরি হয়। এই কমিশনে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও ছিলেন। কিন্তু দেশভাগের ডামাডোল আর সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও অবিশ্বাসের মধ্যে সকলে নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, দেশ বা সর্বসাধারণের স্বার্থ নিয়ে সঠিকভাবে চিন্তা-ভাবনা ভারত-পাকিস্তানের দিক হতে খুব কমই হয়েছে। শেখ হাসিনা সর্বসাধারণের সেই স্বার্থ নিয়ে এগিয়ে আসেন। এই বাংলায় কিংবা ভারতে জন্মগ্রহণকারীরা ভিনদেশী নাগরিক হিসেবে অবরুদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করবে, তা মেনে নিতে পারেননি। শেখ হাসিনার জানা ছিল যে, আইনগত জটিলতা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ছিটমহলের হাজার হাজার বাসিন্দা দশকের পর দশক ধরে নারকীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। এদের এই করুণ নির্মম অবস্থা হতে উদ্ধারে তিনি ভারতীয় প্রতিপক্ষের ওপর চাপপ্রয়োগ করেন মানবিক দিকটিকে সামনে এনে। বাংলাদেশের মানচিত্রের উত্তর-পশ্চিমাংশ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সীমান্তের কাছাকাছি কয়েকটি জেলার অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখ- দ্বীপের মতো ভাসছে। অপরদিকে ভারতের মানচিত্রেও তাই। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত বুকার অব বুকারস পুরস্কারপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপন্যাস ’মিডনাইটস চিল্ড্রেন’-এ দেশ বিভাগের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ছিটমহলগুলোকে রেডক্লিফের কালির ছিটা হিসেবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। মানচিত্র তৈরি করতে গিয়ে ছিটমহল সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা টানা ৬৪ বছর বন্দিত্বে থাকা দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষকে মুক্ত করেছিলেন। মূল ভূখ-ের সঙ্গে তাদের যুক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্রের বিচিত্র আঁকিবুকি নামক ছিটমহল বিলোপ করে অপদখলীয় ভূমি উদ্ধার করে স্বাধীন দেশটিকে পূর্ণপ্রাণ দিলেন। দেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা জনপদ ও মানুষকে মূলধারায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। সীমান্তচুক্তি কার্যকর হওয়ার পর দুই দেশের মানচিত্রে আসবে পরিবর্তন। যে বাংলাদেশের মানচিত্র এতকাল লালন করে আসছে দেশবাসী, সেই মানচিত্র কিছুটা পরিবর্তন হবে। দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্তরেখা টানা হবে। নয়া মানচিত্রে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীসহ বাংলার মানুষ এঁকে দেবে যার মুখ, তিনি বাঙালীর অন্তঃপ্রাণ শেখ হাসিনা। সকল বিরোধিতাকে দুমড়েমুচড়ে দেশের স্বার্থকে যিনি রেখেছেন সমুন্নত। টুপিখোলা স্যালুট জননেত্রীকে।
×