ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুখসানা কাজল

ফতোয়া ॥ নারী প্রগতির অন্তরায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ মে ২০১৫

ফতোয়া ॥ নারী প্রগতির অন্তরায়

২০০০ সালে নওগাঁ জেলার এক দম্পতির অনিচ্ছুক তালাককে জোর করে কায়েম করার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে হাইকোর্টের রায়ে বাংলাদেশে ফতোয়া নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কয়েক বছর পরে আপীল বিভাগের শুনানিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে একটি যুগান্তকারী রায়ে বলা হয় যে, বিচারবহির্ভূত ফতোয়া বৈধ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু আপীল বিভাগ ‘কোন অবস্থাতেই ফতোয়া দেয়া যাবে না’, হাইকোর্টের এই রায় থেকে সরে এসেছে। কেন এই সরে আসা? আপীল বিভাগ যুক্তি দেখিয়েছে যে, ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনের প্রতিটি ব্যাপারে প্রচলিত আইনে কোন সুরাহা না থাকায় আপীল বিভাগকে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে সরে আসতে হয়েছে। অর্থাৎ ফতোয়া বা সালিশে দেয়া বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদানের সুযোগ কিন্তু প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবেই রয়ে গেল। যে বিষয়টি নিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত তা হচ্ছে, ফতোয়া। কমবেশি আমরা ‘ফতোয়া’ শব্দটির সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সত্যি কি আমরা জানি ‘ফতোয়া’ কি? অনেকের মতে, ফকিহ্্ কর্তৃক প্রদত্ত অভিমতের নামই হচ্ছে ফতোয়া। কারও কারও মতে, আরবি আল ফুতওয়া থেকে ফতোয়া শব্দটি এসেছে। যার অর্থ করলে বোঝায়Ñ অনুগ্রহ, বদান্যতা, দানশীলতা, মনুষ্যত্ব। আবার কেউ কেউ জানান, আফতা শব্দ থেকেই ফতোয়া এসেছে। কোন বিষয়ে বিশেষভাবে ব্যাপক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়াই হচ্ছে আফতা। আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো অনেকের মতে, ফাতা থেকে ফতোয়া শব্দটি এসেছে; ফাতা অর্থ তারুণ্য, নতুনত্ব, স্পষ্টকরণ, ব্যাখ্যা। এবার আসি কারা ফতোয়া দিতে পারবে সেই প্রসঙ্গে। ফতোয়া কি সকলেই দিতে পারে? মানে যে কোন বিষয়ে সংশয় তৈরি হলে সেক্ষেত্রে সালিশী সভার যে কেউ কি ফতোয়া দেয়ার অধিকার রাখে? এ প্রসঙ্গে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র মুফতিগণ ফতোয়া দেয়ার অধিকার ও যোগ্যতা রাখে। যেনতেন কোনভাবে ফতোয়া দেয়া যাবে না। এই মুফতিদের কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে তবেই ফতোয়া জারি করতে হয়। যেমন পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা এবং কিয়াস। এই চারটি স্তরে যদি কোন সমাধান না মেলে তবে মুফতিগণ সমাজের অধিকাংশের মত নিয়ে ফতোয়া দিতে পারে। নবী করিম হযরত মুহম্মদ (সাঃ) জানিয়েছেন, কোরআন এবং হাদিস ঘেঁটে যদি সমাধান না পাওয়া যায়, তবে কোরআন এবং হাদিসলব্ধ জ্ঞান বিবেকের দ্বারা মূল্যায়ন করে তা অধিকাংশ মানুষের মতামত নিয়ে তবেই সমস্যা সমাধানের প্রয়াস গ্রহণ করবে। ফতোয়া হতে হবে নিরপেক্ষ, মানবিক এবং গ্রহণযোগ্য। ফতোয়া কাউকে পরিহাস, উপহাস, অপমান, কষ্ট অথবা মৃত্যুর জন্য দেয়া হবে না। ফতোয়া নিয়ে অন্তত এটুকু বোঝা গেল যে, এটি ইসলাম ধর্মের একটি শরীয়া আইন। তাফসীরকারকগণ বলেন, ‘কোন ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে দলিল-প্রমাণভিত্তিতে শরীয়তের বিধান স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হলো ফতোয়া।’ এটি ইসলামী বিধান। এবার জানার বিষয় হলো ফতোয়া কি কেবল নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিদিনের চিত্র ব্যবচ্ছেদ করলে একটি বদ্ধমূল ধারণা আপনা আপনি চলে আসে যে, ফতোয়াদানের মূল লক্ষ্য যেন নারী। নিচের আলোচনায় কিছু কিছু ফতোয়াদানের উদাহরণ দেয়া হলো। দেখুন, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুসলিম নারীর জন্য কেমন ধারার ফতোয়া জারি করা হয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান নেতা কর্তৃক তালেবান সৈন্যের স্ত্রীকে ভোগ করার শাস্তি মৃত্যুদ- কেবল অসহায় স্ত্রীটির ভাগ্যেই বহাল হলো। কেন? জেনার শাস্তি কি কেবল নারীর প্রাপ্য? আর এটা কি জেনা ছিল? বিচারে কি প্রমাণিত যে এই কর্মটি ‘জেনা’? জেনা কি কখনই একার দ্বারা সংঘটন করা সম্ভবপর? তাই যদি না হয় তবে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ফতোয়ায় জেনাকারী সঙ্গী পুরুষের শাস্তি হলো না কেন? ফারকুন নামের আফগান মেয়েটিকে পবিত্র কোরআন শরীফ পোড়ানোর অভিযোগে প্রকাশ্যে প্রথমে পিটিয়ে পরে শরীরে আগুন ধরিয়ে কাবুল নদীতে ফেলে দেয়া হলো। অথচ কেউ কোন প্রমাণ দিতে পারেনি যে ফারকুন কোরআন শরীফ অবমাননা করেছে। এক্ষেত্রে ফতোয়ার কি সার্থক মূল্যায়ন করা হলো? কার স্বার্থে, কেন এই ফতোয়া দেয়া হলো এবং কার্যকর করা হলো? ইরানে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে একটি মেয়েকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল। কেন? মোবাইল কি কেবল পুরুষের একচেটিয়া ব্যবহারের বস্তু? ইসলামের ধর্মীয় ব্যাখ্যায় ভারতের দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এই দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকেই ফতোয়া দেয়া হয়েছে, মুসলিম নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে যে কোন সরকারী-বেসরকারী চাকরি করা হারাম। কারণ চাকরি করতে গেলেই তো পর পুরুষের সঙ্গে দেখা, মেলামেশা হয়; যা কিনা ইসলামে সমর্থনযোগ্য নয়। নারী কি শত শত যোনিসদৃশ একটি মাংসপিণ্ড যে চাকরি করতে গেলেই ভোগে চলে যাবে? অন্যান্য মুসলিম দেশেও কিন্তু নারীরা চাকরি করছে। তাহলে প্রশ্ন তো করাই যায় যে , ফতোয়া কি কেবল নারীর জন্য সংরক্ষিত প্রয়োগনীতি মাত্র? একেবারেই তাজা খবর, আসছে ঈদ। মুসলিমদের সব চেয়ে বড় অনুষ্ঠান। এই সময় সকল মুসলিম জনগোষ্ঠী নতুন জামাকাপড় নেয় এবং উপহার দেয় শিশু, কিশোর, গুরুজনদের। পাকিস্তানের একটি প্রদেশে ফতোয়া দেয়া হয়েছে, কোন নারী রোজার সময় কেনাকাটা করতে মার্কেটে আসতে পারবে না। কেন? কারণ, তাতে পুরুষদের রোজা কেঁচে যেতে পারে। ভাবুন একবার! বোরকা পরা নারীরাও রোজাদার পুরুষের ইমান খসিয়ে দিতে পারে। পুরুষের ইমানের জোর কি এত নাজুক! কোন কোন দেশে নারীদের গাড়ি চালানো নিষেধ। কেন? গাড়িটি কি শুধু পুরুষের? নাকি গাড়ি চালনায় নারী অপারগ, অদক্ষ? নিজ দেশে আসি। দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসার ফতোয়ার প্রতিধ্বনি কি বাংলাদেশের নারীরা কয়েক বছর আগেই শুনতে পায়নি হাফেজ্জি হুজুরের কণ্ঠ থেকে? এটা কি বিবেক সঞ্চিত কোন ফতোয়া? যেখানে স্বামীর আয়ে দিনাতিপাত করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না বা নারী তার নিজের যোগ্যতাবলে স্বামী, সংসার পরিবারের আর দশজনের মঙ্গলের জন্য চাকরি, ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন করছে, তা কেন হারাম হবে? ফতোয়া তো হতে হবে বিবেক দ্বারা মূল্যায়িত সিদ্ধান্ত; যা কিনা মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত। আসুন, দেখি, বাংলাদেশে কেমন ফতোয়া জারি হয়ে থাকে এবং তার ফলাফল কিরূপ ধারণ করেÑ ইসলামে তালাক একটি স্বীকৃত বিধান। নিকৃষ্ট নাকি উৎকৃষ্ট সেটি আলোচ্য বিষয় নয়। বলা হয়েছে তালাক প্রদান করতে হবে শরিয়ত অনুযায়ী। সাক্ষীসাবুদ রেখে। রাগের মাথায়, উত্তেজিত হয়ে, তাৎক্ষণিকভাবে তালাক তালাক বললেই তালাক কার্যকর হবে না। গরিব, অশিক্ষিত, দুঃখী, খেটেখাওয়া, হাল বাওয়া, রিকশাটানা মানুষ সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘরে ফিরে ক্ষুধার মুখে ভাত দিতে দেরি হলে বা সংসারের কোন ঝামেলায় অসহিষ্ণু হয়ে তাৎক্ষণিক রাগের মাথায় তালাক শব্দটা উচ্চারণ করে বসে। আর এর সুযোগ গ্রহণ করে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী কাঠমোল্লারা। যেমন হয়েছিল নওগাঁয়ে, রংপুরে, মাদারীপুর, শরিয়তপুরে। অতিরাগী হিতাহিত জ্ঞানহীন পুরুষের রাগান্বিত উচ্চারণে বলা তালাক যে শরিয়া মোতাবেক দেয়া হয়নি, তা সবাই বোঝে। কিন্তু তারপরেও বিপত্তি বাধায় এই ধর্মান্ধ শ্রেণী। তাদের এই শয়তানির জন্য বাংলাদেশের অনেক নারীই আত্মহত্যা করতে বা বিড়ম্বিত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। ২০১১ সালে রংপুরের বদরগঞ্জে গ্রাম সালিশে দুই গৃহবধূকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করায় একজন মা তাঁর শিশুসন্তানসহ ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করেন। রংপুরের হেনা, গাজীপুরের লিপি, মাদারীপুরের সেলিনা, এ রকম অনেক নাম আমরা পত্রিকায় দেখি, যারা সালিশে দেয়া শাস্তির অপমানে জীবন শেষ করে দেয়ার পথ বেছে নিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ সালিশ সভায় নারীর প্রতিনিধি থাকে না। অথবা নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও তার সামনে পুরুষরা শাস্তির বিধান দিয়ে তৎক্ষণাৎ তা কার্যকরও করে ছাড়ে। দোররার আঘাতে নিহত হেনার বাবা-মা বলেন, ‘সালিশে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরুষরা, সেখানে নারীদের কোন প্রতিনিধিত্বই ছিল না। চার বছর হয়ে গেলেও আমরা কোন বিচার পাইনি।’ গাজীপুরের নবম শ্রেণীর ছাত্রী লিপির বাবা-মাও এই একই অভিযোগ করেন। এ রকম সালিশে যারা থাকে তারা কি ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতা ও অধিকার রাখে? যতদূর জানা আছে কেবলমাত্র মুফতিগণ ফতোয়া দিতে পারবেন। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে কতজন মুফতি আছে? সুনানে দারিমীতে বলা হয়েছে, যে ফতোয়া প্রদানে দুঃসাহস দেখান সে যেন জাহান্নামে প্রবেশের দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। রাসূল (সাঃ) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন বিষয় জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ের সমাধান দিল তাহলে তার গুনাহ্ তার ওপর বর্তাবে।’ আমাদের সমাজের অধিকাংশ ফতোয়া দিয়ে থাকেন সমাজপতি-মাতব্বর ও অল্পশিক্ষিত আলেম হুজুররা। ফতোয়ার অপব্যবহার করে সমাজের দরিদ্র-নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করেন তারা। বিশেষ করে এর শিকার হয় গ্রামের দরিদ্র-অশিক্ষিত নারী। পুরুষরাই সালিশ করছে, ফতোয়া দিচ্ছে, শাস্তি কায়েম করছে। এটা খুব বিস্ময়ের যে, নির্বাচিত প্রতিনিধির উপস্থিতিতেই একজন নারীকে, জুতাপেটা বা অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ফতোয়া দেয়া হচ্ছে একপক্ষীয়ভাবে। নারী প্রতিনিধি সেখানে কেবল অলঙ্কার হয়ে বসে থাকে মাত্র। একচেটিয়াভাবে নারীর ওপর নেমে আসছে শাস্তির নানা ধরন। লাঠিমারা, গালমন্দ, তিরস্কার, জরিমানা, এক ঘরে করে রাখা, চুল কেটে দেয়া, জুতাপেটা, মুখে চুনকালি মাখানোসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এ সমস্ত সালিশ সভা এক রকমের চরম পৈশাচিক আনন্দ লাভ করে। মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে এই ধরনের সালিশের সংখ্যা। অসহায়রা সঠিক বিচার পাচ্ছে না। গ্রামের এসব সালিশে থাকে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত প্রভাবশালীদের আধিপত্য। এই শ্রেণীর লোকের ভয়ে বা চাপে বেশিরভাগ সময় এসব অভিযোগ থানা বা আদালত পর্যন্ত পৌঁছায় না। আর পৌঁছালেও সেখানে এদের প্রভাব থাকে। ফলে অনেক অভিযোগ আমরা জানতে পারি না। অনেক সময় আইনরক্ষাকারী বাহিনীও থাকে নারী প্রগতির বিপক্ষ ভূমিকায় তাদের বিভিন্ন কাজেকর্মে আচরণে, কথাবার্তায়। সভ্য সমাজে এটা অকল্পনীয়। এ ধরনের সালিশ এবং ফতোয়াবাজি সম্পূর্ণ বিচারবহির্ভূত। নারী প্রগতির পথে অন্তরায়। ভেবে দেখা দরকার, দেশে বিদ্যমান আইন থাকা সত্ত্বেও ফতোয়ার মাধ্যমে শাস্তির বিধান করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? লেখক : বেসরকারী কলেজের শিক্ষিকা
×