ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাসমান সবজি চাষে জড়িত ১২ হাজার কৃষক

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১০ মে ২০১৫

ভাসমান সবজি চাষে জড়িত ১২ হাজার কৃষক

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষই আমার একমাত্র পেশা। প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে প্রতি বছরই আশানুরূপ ফল পাচ্ছি। সফলতা অনেক, গত কয়েক বছরে আয়ও বেড়েছে। ৫০-৬০টি বেডে শাকসবজি ও চারা রোপণ করে পরিবারের ভরণ পোষণ করছি। গ্রামের প্রায় ৬০-৭০টি পরিবার একইভাবে ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদন করছে।’ কথাগুলো বলছিলেন পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষক মোঃ শাহাদাত হোসেন। শুধু শাহাদাত নন, দেশের প্রায় ১২ হাজার কৃষক ভাসমান পদ্ধতিতে শাক-সবজি ও মসলা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশের রয়েছে ৪৫ লাখ হেক্টরেরও অধিক জলসীমা। এর মাত্র ৫ হাজার হেক্টর ওয়াটার বডি যদি ভাসমান শাকসবজির আওতায় আনা যায় তাহলে দেশে শাকসবজি উৎপাদনে নতুন যুগের সূচনা হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কৃষিবিদরা। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদকে ত্বরান্বিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার, যা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বাস্তবায়ন করছে। সম্পূর্ণ মাটি বিহীন ও পানির উপরে ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষাবাদ হয়ে থাকে। ব্যবহৃত হয় না কোন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এমনকি চাষের জন্য প্রয়োজন পড়ে না বাড়তি কোন জমির। পরিত্যক্ত জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কচুরিপানা ব্যবহার করে প্রায় ১০০ বছর ধরে এ ধরনের চাষাবাদ হয়ে আসছে। জানা যায়, মূলত হাওর ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভাসমান পদ্ধতিটি দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত। ওই এলাকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ফলশ্রুতিতে এর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা। মাটিতে সারা বছর শস্য চাষাবাদ সম্ভব না হওয়ায়, নিম্নভূমির ওই এলাকাগুলোকে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষের আওতায় আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, দেশের ১০টি জেলার ৪২ট উপজেলায় ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করে শাকসবজি চাষাবাদ ও বিভিন্ন ধরনের চারার উৎপাদন হচ্ছে। বরিশাল, পিরোজপুর, গোপালগঞ্চ, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, বি. বাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার ১২ হাজার কৃষক ভাসমান পদ্ধতিতে শাক-সবজি চাষ করছে। তবে নেছারাবাদ ও স্বরূপকাটিতে এ পদ্ধতিতে সারা বছর চারা উৎপাদন হয়। বলা হয়ে থাকে এলাকা দুটি ভাসমান পদ্ধতির জন্য প্রসিদ্ধ। জানা যায়, পানিতে ডুবন্ত জমির ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু হয়। অব্যবহৃত কচুরিপানা অজৈব সারের একটি প্রধান উপাদান। আর এ পদ্ধতিতে কচুরিপানার ব্যবহার হয়ে থাকে। বন্যা, খরার সময় ফসল উৎপাদন করে দুর্যোগ মোকাবেলা ছাড়াও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শাকসবজি উৎপাদনে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে এর যাত্রা শুরু হয়। খাদ্যের যোগান বৃদ্ধিও এ পদ্ধতিতে চাষাবাদের অন্যতম কারণ। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষের কৌশল ॥ ঘন কচুরিপানাযুক্ত এলাকার জলাশয় এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। বর্ষার শুরুতে কচুরিপানা দ্রুত বংশবিস্তার শুরু করে। আর ওই সময়ে সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ (জুন-মধ্য আগস্ট) মাসে ভাসমান পদ্ধতিতে বেড তৈরি করা হয়, তবে এলাকা ভেদে জ্যৈষ্ঠ ও কার্তিক মাসেও এটি হতে পারে। বেড তৈরির স্থান স্রোতহীন হওয়া বাধ্যতামূলক। কচুরিপানা, টোপাপোনা, শেওলা, বিভিন্ন ধরনের জলজ আগাছা, ধানের খড়, ফসলের অবশিষ্টাংশ প্রভৃতি ব্যবহার করে ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। তবে দেশে কচুরিপানা সহজলভ্য বলে এর মাধ্যমেই বেড তৈরি হচ্ছে। সাধারণত ভাসমান বেড দৈর্ঘ্যে ৩৯ ফুট (১২ মিটার), চওড়া ও উচ্চতায় ৪ ফুট (১.২৫ মিটার) হয়ে থাকে। দৈর্ঘ্য জমির আকারের ওপর নির্ভর করে। বেড ৬০ মিটার পর্যন্ত লম্বাও হতে পারে। খুব বড় আকারের জলাশয়ে আলাদা আলাদা করে বেড তৈরি করা যায়। পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা কচুরিপানা সংগ্রহ করে ৪ ফুট পুরু স্তূপ তৈরি করতে হবে। স্তূপটির দুপাশ বাঁশ দিয়ে আটকে রাখতে হয়। স্তূপটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে এর ওপর অন্তত একজন মানুষ দাঁড়াতে পারে। অধিক মান সম্মত হলে একের অধিক মানুষ এর উপর দাঁড়াতে পারবেন। এছাড়া পচা কচুরিপানার মধ্যে অতিরিক্ত পানি থাকলে তা চিপে ফেলে দিয়ে বল তৈরি করেও চারা লাগানো যায়। তবে কোন ক্রমেই মাটি ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি রাসায়নিক সারও। চাষ উপযোগী ফসল ॥ মৌসুমের সময় যে কোন মৌসুমি ফসল ভাসমান পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। তবে লতিরাজ কচু, লালশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, ফুলকপি, ভাটি শাক, লেটুস, ফুলকপি, ব্রোকলি, টমোটো, বেগুন, মরিচ, মুলা, শালগম, ওলকপি, করলা ও বরবটি অধিকহারে উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা চাষ করা যায়। বন্যা মোকাবেলায় আগাম ভিত্তিতে লাউ, শিম, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, বেগুন, মরিচ, টমোটো, করলা, চিচিঙ্গাসহ নানা ধরনের সবজির চারা ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। একাধিক কৃষক ও কৃষিবিদদের ধারণা মতে, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্রোতহীন জলাশয়ের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃষক ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন। মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বিনোয়োগ করে মৌসুম শেষে এক একর জমি থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। জানা যায়, ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের চাহিদাও বেশি। অধিক সবুজ শাকসবজি গুণে মানে উন্নত হওয়ায় পাইকারি সবজি ক্রেতাদের কাছে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই দিন দিন বেড়ে চলছে ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজির চাষাবাদ। গোপালগঞ্জের গনাপাড়া গ্রামের কৃষক মোঃ আলীম ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ অনেক লাভজনক। ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি চাষকে উৎসাহিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাস্তবায়নে ‘বন্যা ও জলাবদ্ধতা প্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান সবজি ও মসলা উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প’ টি চলমান রয়েছে। কৃষকদের দেয়া হচ্ছে সব রকমের সহায়তা। প্রকল্পটি ২০১৩ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়। ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদের ভবিষ্যত নিয়ে প্রকল্প পরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দিন কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এর ফলে সবজি উৎপাদনে নতুন যুগের সূচনা হবে।
×