ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিবির সভাপতির বিকৃত বক্তব্যে আলেম সমাজে অসন্তোষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১০ মে ২০১৫

শিবির সভাপতির বিকৃত বক্তব্যে আলেম সমাজে অসন্তোষ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশের আলেম সমাজ ও কওমি রাজনীতি নিয়ে জামায়াতী সংগঠন শিবির সভাপতির দেয়া মিথ্যা, বিকৃত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে আলেম সমাজকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন শিবির সভাপতি আবদুল জব্বার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আলেম সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ। রাজনীতিতে বাংলাদেশের আলেমদের প্রথম সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের চেষ্টায়-ফেসবুক, বাঁশের কেল্লাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিবিরের এমন বক্তব্যকে ‘যুদ্ধাপরাধী ও ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচার’ ‘মূর্খের আস্ফালন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন আলেম সমাজসহ ইসলামী চিন্তাবিদরা। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই ওরা এ অপপ্রচার চালাচ্ছে। জামায়াত ও গোলাম আযমের কাছ থেকে ইসলামী রাজনীতি নয় বরং গোলাম আযমরাই প্রথম রগকাটা, নারী ধর্ষণ ও গণহত্যার অপরাজনীতি শুরু করে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার ইমাম ও খতিব আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শিবিরের অপপ্রচার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ইসলাম সম্পর্কে ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে জামায়াতীদের জ্ঞান থাকার কথা না। কারণ ওদের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর মতবাদ আসলে ইসলামের কিছু নয়। এদেশে ইসলামী আন্দোলনে আলেমদের ইতিহাসকে ওরা এখন বিকৃত করছে। গোলাম আযমের মাধ্যমে আলেম সমাজ ইসলামী আন্দোলন শুরু করেছে- এমন তথ্যকে যুদ্ধাপরাধীদের অপপ্রচার উল্লেখ করে বিশিষ্ট এ ইসলামী চিন্তাবিদ বলেন, আসলে গোলাম আযমের কাছ থেকে ইসলামী রাজনীতি নয় বরং এদেশে রগকাটা, নারী ধর্ষণ ও গণহত্যা শুরু হয়েছে। জামায়াতীদের এ তথ্যকে ‘মূর্খের অপপ্রচার’ হিসাবে অভিহিত করেছেন জমিয়তে ওলামা ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস। তিনি বলছিলেন, এটা হয় না জেনে মূর্খের মতো বলেছে না হয় ইচ্ছে করেই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ওরা এটা করেছে। এদেশে আলেম সমাজের রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই সিপাহী বিদ্রোহের আগেও এদেশে আলেম সামাজ রাজনীতি করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও আলেম সমাজের অংশগ্রহণ আছে। গোলাম আযমতো পরে। তাদের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী নিজেই যখন বাচ্চা তখন ভারতে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের অফিসে চাকরি করেছে। আর এখন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। জানা গেছে, গেল মঙ্গলবার রাতে নিজের ফেসবুকে দেয়া ‘ইসলাম বিদ্বেষীদের ৫ মে গণহত্যার উল্লাস অতঃপর ইসলাম পন্থীদের ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আলেমদের নিয়ে বিকৃত তথ্যগুলো প্রচার করেন শিবির সভাপতি। শিবির নেতা লিখেছে, ‘১৯৮১ সালের আগ পর্যন্ত ইসলামে যে রাজনীতি আছে তা স্বীকার করতেন না বাংলাদেশের অধিকাংশ আলেম। ইসলামী রাজনীতির প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছিল শুধু জামায়াতে ইসলামী। ইসলামে রাজনীতি আছে এবং সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য ইসলামী রাজনীতির বিকল্প নেই তা পীর সাহেব বা খানকার খাদেমরা জানলেও অস্বীকার করার মূল কারণ হলো-ওনারা পীর দরবার ও খানকায়ের আয়েশি জিন্দেগি থেকে বের হয়ে আসতে নারাজ ছিলেন।’ আরও লিখেছেন, ‘ইসলামী রাজনীতির পক্ষে কর্মকা- পরিচালনা করায় সে সময়ে অনেক আলেম জামায়াতে ইসলামী সম্পৃক্তদের ফিরকাবাজ, নতুন ইসলামের প্রবর্তক ইত্যাদি বলে ফতোয়া দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির গোলাম আযম আশির দশকে আলেমদের ইসলামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে এবং ১৯৯৪ সালের দিকে এ দেশের সর্বস্তরের হাক্কানি আলেম ওলামাদের সঙ্গে নিয়ে ইসলামী ঐক্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এর কার্যক্রম অনেকদূর পর্যন্ত এগুলেও কিছু আলেম ওলামার চরম একগুঁয়েমি ও নির্বোধ আচরণের কারণে সব প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।’ জামায়াতীদের এ ধরনের বক্তব্যে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল এমপি বলছিলেন, ও যা বলেছে তা হলো যুদ্ধাপরাধী ও ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচার এবং মূর্খের আস্ফালন। একাত্তরে ইসলামের নামে গণহত্যা চালিয়েছে। মিথ্যা আর বিকৃত তথ্য এদের পুঁজি। এখন এরা ইচ্ছে করেই আলেম ওলামাদের নিয়ে বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে যাচ্ছে। আসলে ওরা যা বলে ওদের মওদুদীর যে মতবাদ তার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পৃক্ততা নেই। ইসলামকে বিবৃত করে এরা ইসলামের ক্ষতি করছে। এরা ইসলামের শত্রু। এরা এখন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে এদেশের আলেম সমাজের তথা ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে মাঠে নেমেছে। ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়ামের সদস্য মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, গোলাম আযম কে? তার জন্ম কবে? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কারা করেছে? ছাত্র শিবিরের সভাপতির এ সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে? ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন করেছে আলেম ওলামারা। এর আগে হাজী শরিয়ত উল্লাহর আন্দোলন। এরপর পাকিস্তান আমলে নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এসব দল কী গোলাম আযমের মাধ্যমে রাজনীতি করেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, একমুখী শিক্ষা ও বই পাঠ করলে যা হয়। এরা তো কোরআন হাদিস পড়ে না। এরা তো মওদুদীর বই পড়ে। তাহলে কীভাবে জানবে? শিবিরের তৎপরতার তীব্র সমালোচনা করেন গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, এদের কথার জবাব দিয়ে কি হবে। জামায়াতে ইসলাম ফিরকাবাজ, ফেতনাবাজ এবং মওদুদী ইসলামের প্রেতাত্মা, এসব ফতোয়া নিয়ে আমাদের অবস্থান আগের মতো। আগেও যেমন বলেছি, তেমন এখনও বলছি। সোজা কথায় ইসলাম নিয়ে তামাশা করেছিলেন মওদুদী। আর তার শিষ্যরা তো বলবেই যে, রাজনীতি গোলাম আযম শিখিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন শুরুর সময় শিবির সভাপতির তখন জন্ম হয়েছিল কিনা, এ প্রশ্ন তুলেছেন হাফেজ্জি প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ওর তো মনে হয় তখন জন্ম হয়নি। সঠিক তথ্য জানেন না। আবদুল জব্বারের লেখার বিষয়ে মাসিক আল আশরাফের যুগ্ম সম্পাদক মুফতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, শিবির যে সময়ের কথা বলছে গোলাম আযম তো ওই সময়ে বাংলাদেশেই ছিলেন না। তিনি কীভাবে আলেমদের রাজনীতি শেখাবেন। এটি কি উলুবনে জ্ঞান বিস্তার? গোলাম আযমসহ জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কওমি আলেমদের মধ্যে বিবদমান দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক। এ দ্বন্দ্ব মিটে যাবার নয়। ইসলাম, হযরত মুহাম্মদ সা. ও সাহাবায়ে কেরামগণের সম্মান নিয়ে মওদুদীর যে চর্চা, যে বেয়াদবি, সেগুলোতো তারা এখনও বিশ্বাস করে। তাহলে তাদের নেতা গোলাম আযম কবে, কখন রাজনীতি শেখাল আলেমদের? তাহলে হাফেজ্জি হুজুরের ভূমিকা কি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এমন একটা গলি দেখাতে পারবে যেখানে কওমি আলেমরা জামায়াতকে ওউন করে বা তাদের দল করে? শিবির সভাপতি আবদুল জব্বারের বক্তব্যের সমালোচনা করেন তরুণ লেখক মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, আবদুল জব্বার সম্ভবত উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাস মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখেননি। উপমহাদেশে রাজনীতি শুরুই হয়েছে কওমি আলেমদের হাত ধরে। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে খেলাফত আন্দোলন, ইংরেজ খেদাও আন্দোলন, রেশমি রুমাল আন্দোলন, গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন, দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং সর্বশেষ দেশভাগ; সব আন্দোলনে কওমি আলেমরাই দিশা দিয়েছেন এ দেশের আপামর জনসাধারণকে। তার স্মরণ রাখা প্রয়োজন, দেশ ভাগের পর অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম পতাকা উড্ডীন করেছিলেন একজন কওমি আলেম-মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি। সালাহউদ্দীন আরও বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামের নামে গোলাম আযম এবং তাদের দোসরদের অনৈসলামিক দালালির কারণেই অনেক নির্দোষ কওমি আলেম নিগৃহীত হন। শুধু গোলাম আযমরা ইসলামী বেশ ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার কারণে আলেমদের রাজাকার বলে গালি দেয়া হয়। অথচ সবাই জানে, বাংলাদেশের কওমি আলেমরা সবসময়ই স্বাধীনতার স্বপক্ষে ছিলেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১০০ বছরের পুরনো কওমি ধারার রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। তারা সে সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়াকে হারাম বলে ঘোষণা দেন। এদিকে জামায়াতীতের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র আকবর তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ইতিহাস বিকৃত করা যায় না। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। কেবল ইতিহাস বিকৃতকারীরাই কওমী আলেমদের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করে জাতির সামনে উপস্থাপনের দুঃসাহস দেখাতে পারে। অপর এক ছাত্র সামদানী লিখেছেন, ‘ জামাত কোন ইসলামিক দল না। তাদের থেকে ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। জামায়াত সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইমরান লিখেছেন, জামায়াতে ইসলাম একটি নাম। যে নামের মধ্যে রয়েছে শত বিলিয়ন কোটি বিতর্ক। এটি ঈমান বিধ্বংসীর অন্যতম সংগঠন। এতে রয়েছে সকল সাহাবায়ে কেরামগণের প্রচ- সমালোচনা, এমন কি নবীদের পর্যন্ত মারাত্মক সমালোচনার এক সমাহারের ইমান বিধ্বংসী পা-ুলিপি। এক কথায় জামায়াতে ইসলামী একটি ঈমান-আক্বিদা, আমল-আখলাক, বেয়াদব-উচ্ছৃঙ্খলের এক পূর্ণ উপহারের ক্যাটালগ। তাই এশিয়া মহাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব সমাজের হক্কানী আলেম ওলামাদের পূর্ণ অভিমত ওরা ইসলামী দল নয়।
×