ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দালাল চক্রের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ মে ২০১৫

দালাল চক্রের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে

ফিরোজ মান্না ॥ অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার কারণে খুলে যাওয়া বাজারটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশটির কর্তৃপক্ষ থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধানের আগেই সরকারীভাবে কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছিল। এ ঘটনার পর মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পুলিশী অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর খুলে যাওয়া বাজার আবার হারানোর আশঙ্কা করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পুলিশের নিয়মিত অভিযানে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন অবৈধ অভিবাসীকে মালয়েশিয়া পুলিশ আটক করেছে। এখন তাদের স্থান মালয়েশিয়ার কারাগারে। এর আগে তাদের বন্দী থাকতে হয়েছে থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে। বন্দী জীবন আর তাদের পিছু ছাড়ছে না। তবুও দালালের হাতে জীবনকে তুলে দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথে মালয়েশিয়া যাচ্ছে স্বপ্ন ভুক মানুষ। দালালচক্র তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গ করছে প্রতিনিয়ত। মন্ত্রণালয় দালালচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ পথে কর্মী প্রবেশ করায় মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করেই কর্মী নিয়োগ স্থগিত করে দিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বর্তমান সরকার অভিবাসীদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপদ অভিবাসনের জন্য বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সম্পূর্ণ অভিবাসন কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে করা হচ্ছে। কর্মীদের স্মার্ট কার্ড দেয়া হয়েছে। এই কার্ড ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি অনলাইনে ভিসা যাচাইয়ের সুযোগ থাকার কারণে জাল ভিসায় বিদেশ যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়েছে। অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনা এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকার জি টু জি পদ্ধতিতে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। নিরাপদ অভিবাসনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য বিএমইটিতে বিদেশ গমনেচ্ছু অভিবাসীদের জন্য ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে। অবৈধ পথে দালালদের মাধ্যমে হাজার হাজার কর্মী মালয়েশিয়া প্রবেশ করার কারণে বাজারটি আবার ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে কর্মীদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছে দালালচক্র। এই চক্রের কারণে দেশটির তৈরি করা বাজার আবার হারাতে হতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার থেকে ট্রলারে করে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাত্রা নতুন কোন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাড়ি জমাচ্ছে দেশের মানুষ। উত্তাল সাগর পথে বাহন ট্রলার কিংবা কার্গো বোট। পৌঁছতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। ওই সময়টা কোনভাবে খেয়ে না খেয়ে পার করে পৌঁছে যায় থাইল্যান্ড উপকূলে। এরপর হয় অন্য রকম জীবনের যাত্রা। নিজের জীবনকে এক অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিয়ে এভাবেই অবৈধভাবে সাগর পথে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দেয়া সাগর পথের এসব যাত্রীদের অনেকেই সলিল সমাধি বরণ করেন। না হয় তাদের ঠাঁই হয় বাংলাদেশী বা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে। আর এসব মানবপাচারের কাজে জড়িত মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে সাগর পথে মানবপাচার। টেকনাফ-উখিয়া রুটে মানবপাচারে জড়িত রয়েছে ২০ সিন্ডিকেট। এই চক্রের সহযোগী রয়েছে আরও শতাধিক উপচক্র। তাদের দালাল বলা হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্যে জানা গেছে, শুধু মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড নয়, আরও কয়েকটি দেশে মানবপাচার হচ্ছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের নাগরিকরা যাচ্ছেন। ভাল উপার্জনের আশায় এসব লোকজন বিক্রি করে দিচ্ছেন ঘরবাড়ি, জমিজমা। টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালদের হাতে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে গরিব, দিনমজুর, মধ্যবিত্ত মানুষরা মোকাবেলা করছেন সাগরের উত্তাল ঢেউ। প্রবল বৃষ্টি। ভয়ঙ্কর প্রাণী। ধরাও পড়ছেন কোস্টগার্ডের-নৌবাহিনীর হাতে। জেল খাটছেন। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পথে পথে ঘুমাচ্ছেন না খেয়ে না দেয়ে। আর যারা অর্ধাহারে-অনাহারে ওইসব দেশে পৌঁছেন তাদেরও শান্তি নেই। স্বল্প খরচে বিদেশ পাড়ি দিয়ে এসব লোকজনকে করতে হয় মানবেতর জীবনযাপন। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে দালালদের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় প্রভাব আর পুলিশকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর চলছে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে এই মানবপাচার বাণিজ্য। শ’ শ’ কোটি টাকার অবৈধ পাচার বাণিজ্যের টাকার একটি অংশ বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের হাতেও যাচ্ছে। টেকনাফ ও কক্সবাজারের নাজিরারটেক, কস্তুরা ঘাট, উখিয়ার মনখালী, সোনারপাড়া, টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালী, জাহাজপুরা, টেকনাফ সদর, শাহপুরীর দ্বীপ ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, জেটিঘাট, কাটাবনিয়া, মিটা পানির ছড়া, রাজার ছড়াসহ বিভিন্ন উপকূল ঘাট থেকে মানবপাচার করা হচ্ছে। এই জায়গাগুলো পাচারের জন্য যে ব্যবহার হয় তা প্রশাসনের জানা। মানবপাচার নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানবপাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সার্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসঙ্গতি মানবপাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়ার বিষয়টি। নতুন করে পাচার আইন নিয়ে সরকারকে চিন্তা ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
×