ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সীমান্ত বিল পাস

কুড়িগ্রামে আনন্দ র‌্যালি, সমাবেশ ॥ ছিটমহলে খুশির জোয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ মে ২০১৫

কুড়িগ্রামে আনন্দ র‌্যালি, সমাবেশ ॥ ছিটমহলে খুশির জোয়ার

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ অবশেষে ভারতের লোকসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল পাস হলো। কেটে গেল আঁধার। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতের লোকসভা এ বিল পাসের মধ্য দিয়ে ৬৮ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান টানল। বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরের ১৬২ ছিটমহলে এখন আনন্দের বন্যা। বাঁধভাঙ্গা আনন্দে উদ্বেলিত ৫০ হাজারেরও বেশি ছিটমহলবাসী। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল ১৫০নং দাসিয়ার ছড়ায় আনন্দ র‌্যালি, লাঠিখেলা উৎসব ও ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কালিরহাট বাজারে শত শত নারী-পুরুষ উপস্থিত হয়। দীর্ঘদিনের বন্দী জীবনের অবসানের আনন্দে আত্মহারা ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ উল্লাস করেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মোঃ জাফর আলী। বক্তব্য রাখেন পিপি এ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, গোলাম রব্বানী, আলতাফ হোসেন, অধ্যাপক খন্দকার শামসুল আলম, সাঈদ হাসান লোবান, মইনুল হক প্রমুখ। বক্তারা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধান করায় বাংলাদেশ ও ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিমিয় সমন্বয় কমিটি ভারত ইউনিটের সহ-সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, মন্ত্রিসভায় ও রাজ্যসভায় বিলটি পাসের পর বৃহস্পতিবার লোকসভা বিলটি পাস করে। বিলটি পূর্ণাঙ্গরূপে অনুমোদন করায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ৬৮ বছরের বঞ্চনার অবসান ঘটল। আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ ইউনিট সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বলেন, লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ায় আমরা খুশি। এখন এর আইনী প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ে শেষ করে ছিটমহল বিনিময় বাস্তবায়ন ঘটবে খুব দ্রুত এ আশা করছি। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতের ১৫০ নম্বর ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় গিয়ে দেখা যায় নারী-পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মাঝে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। কৃষক এছাহক আলী (৭০), আয়শা সিদ্দিকা (৫৪), আলেকজন বিবি (৫০), রাহেলা বেগম (৪০) ও শরিফ (২০) জানায়, ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশের নাগরিক হতে পেরে আনন্দিত। তাদের আর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে জীবনযাপন করতে হবে না। শিক্ষ, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা বৈধ ভোগ করতে পারবে। এটি তাদের হাতে চাঁদ পাবার মতো স্বপ্নময় প্রাপ্তি বলে উল্লেখ করেন ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের নেতা আলতাফ হোসেন। স্কুল শিক্ষার্থী আয়শা বলেন, মিথা পরিচয়ে তাকে গঙ্গারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে হচ্ছে। এ জন্য শুনতে হয় নানা কটু কথা। রাস্তাঘাটে ছিল না কোন নিরাপত্তা। বিচার চাওয়ার ছিল না কোন স্থান। এ সবরই অবসান ঘটল। আমরা চাই দ্রুত পাসকৃত সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন। জহুরুল হক, বাচ্চু শেখ, শাহ আলমগীর, জোবায়দুল হক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, খাঁচার বন্দী পাখি কেবল বোঝে, স্বাধীনতার কী স্বাদ? তাই এর মর্ম আমরা বুঝতে পারছি হৃদয় দিয়ে। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠছে। এ আনন্দে আর চাওয়ার কিছু নেই। আমাদের সন্তানরা একটা পরিচয় পাবে। তারা গর্ববোধ করবে। এটাই অনেক বড় পাওয়া।’ আনন্দের ঢেউ লেগেছে ১৬২ ছিটমহলে। চলছে আনন্দ র‌্যালি, মিষ্টি খাওয়া, সমাবেশ। মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত সবাই। চলছে করমর্দন ও কোলাকুলি। এসব কথা জানান ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মইনুল হক। তবে আক্ষেপ বাপ-দাদারা অস্বাভাবিক জীবন নিয়ে পরপারে চলে গেছেন। তারা জানতে পারলেন না এ আনন্দের খবর। বন্দী দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি লাভের খবর। জীবনের পড়ন্ত বিকেলে এসে একটাই সান্ত¡না বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারব। ১৬২ ছিটমহলের উৎস ও অবস্থান ॥ ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তের সময় মানচিত্র বিভাজনের সময় ছিটমহলের উদ্ভব ঘটায়। এক দেশের ভূখ-ে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। ফলে এসব ছিটমহলে অসহনীয় মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয়, যা এখনও ১৬২ ছিটমহলে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১ এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহল। কুচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন উপজেলা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট ও ফুলবাড়ীতে অবস্থিত ছিল। ভারত ও পাকিস্তান ভাগের সময় ওই আট উপজেলা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পড়ে। আর কুচবিহার একীভূত হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখ- আসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আর বাংলাদেশের কিছু ভূখ- যায় ভারতের অভ্যন্তরে। এই ভূমিগুলোই হলো দীর্ঘ ৬৮ বছরের আলোচিত ছিটমহল। অবাক করা বিষয় হলো ছিটের ভেতরে ছিট। তার নাম ছিট চন্দ্রখানা। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ভূখ-ের ভেতরে ১৫০নং ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার আয়তন ১৯৪৩ একর। ছিটমহলটিতে প্রায় ১১ হাজার মানুষের বাস। এই দাসিয়ারছড়া ছিটের ভেতরে ১২০ একরের বাংলাদেশের ছিটমহল চন্দ্রখানা। এখানে ৬৬ পরিবারে ৩৩৩ জন মানুষের বাস। দেশের ভেতর থেকেও তারা ভারতীয় ভুখ- দ্বারা ঘেরা। এসব ছিটমহলে বর্তমান বসবাস করছে প্রায় ৫১ হাজার মানুষ। ২৪ হাজার ২৬৮ একর ভূমি নিয়ে দু’দেশের ছিটমহল। এর মধ্যে ভারতের ১৭ হাজার ১৫৮ একর এবং বাংলাদেশের ৭ হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় চারটি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১ ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে কুচবিহার রাজ্যে ৪৭টি এবং জলপাইগুড়ি জেলায় চারটি ছিটমহল রয়েছে। সীমানা সমস্যার নেপথ্যে ॥ দেশ বিভক্তির সময় ১৯৪৭ সালে সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সাইরিল র‌্যাডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরেই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ওই বছর ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন র‌্যাডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর পর ১৬ আগস্ট সীমানা মানচিত্র প্রকাশ করা হয় জনসমক্ষে। কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। বলা যায় কোন প্রকার সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরা। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ছিটমহল সমস্যা থেকে গেছে যুগ যুগ। ১৬৮ ছিটমহলের অধিবাসীদের দৃষ্টি এখন ভারতীয় লোকসভার দিকে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে চলছে আনন্দ উল্লাস। লালমনিরহাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ভারতের লোকসভায় বৃহস্পতিবার ছিটমহল ও সীমান্ত চুক্তি সংশোধনী বিলটি পাস হওয়ায় উল্লাসে ফেটে পড়েছে মানুষ। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ছোট-বড় সকলেই ছিটমহলের পাড়া-মহল্লায় আনন্দ মিছিল করেছে।
×