ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চুরির অভিযোগে গাছে বেঁধে গৃহবধূকে নির্যাতন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৮ মে ২০১৫

চুরির অভিযোগে গাছে বেঁধে গৃহবধূকে নির্যাতন

নিজস্ব সংবাদদাতা, নড়াইল, ৭ মে ॥ কথিত চুরির অভিযোগে ববিতা খানম (২১) নামে এক গৃহবধূকে গাছের সঙ্গে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গুরুতর আহত ওই গৃহবধূ বর্তমানে নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার ৫ দিন পর গৃহবধূর মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে ৭ জনের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। তবে এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ববিতার দাবি সে প্রধান নির্যাতনকারী শফিকুলের স্ত্রী। অন্যদিকে শফিকুলের পরিবার এ কথা অস্বীকার করে বলেছে ববিতা ও তার মা চুরি করতে এসে ধরা পড়ে মারপিটের শিকার হয়েছে। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামের ছালাম শেখের ছেলে সেনাসদস্য শফিকুল শেখের (২৬) সঙ্গে পার্শ্ববর্তী এড়েন্দা গ্রামের ইসমাইল মোল্লার মেয়ে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী (প্রাইভেট) ববিতার মোবাইল ফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কের জের ধরে ২০১৩ সালের ২১ নবেম্বর গোপনে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তার শাশুড়ি তাকে ঘরে তুলে নেবে না বলে টালবাহানা শুরু করে। পরে শফিকুল ববিতার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে একপর্যায়ে ববিতা হতাশ হয়ে পড়েন। ঘটনার আগের দিন শফিকুল ছুটিতে বাড়ি এলে ববিতা খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হয়ে স্ত্রীর স্বীকৃতি দাবি করেন। ঘটনার দিন ৩০ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে এ নিয়ে বাগ্বিত-ার একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ববিতার স্বামী, শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন ববিতাকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী গাছের সঙ্গে বেঁধে লাঠিপেটা করে। পরে ববিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। নির্যাতনের শিকার গুরুতর আহত গৃহবধূ ববিতাকে প্রথমে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এদিকে শালবরাত গ্রাম ঘুরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনার পর শফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মা ও অন্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি। শফিকুলের চাচি রেখা বেগম ও প্রতিবেশী রেঞ্জিনা বেগম বলেন, ববিতা শফিকুলের স্ত্রী নয়। তাদের বিয়ের বিষয়টি ঠিক নয়। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ববিতা ও ববিতার মা খোদেজা হঠাৎ শফিকুলদের ঘরে ঢুকে নগদ টাকা, সোনার চেন নিয়ে নেয় এবং ভাংচুর শুরু করে। এ সময় আমরা এবং প্রতিবেশী বাড়ির মহিলারা চোর চোর বলে তাড়া করলে ববিতার মা পালিয়ে যায় এবং ববিতা ধরা পড়ে। এরপর তাকে গাছে বেঁধে প্রহার করা হয়। প্রতিবেশী রেনা বেগম বলেন, চিৎকার শুনে এসে দেখি ববিতাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। পরে পাশের গ্রামের আরজু ভাই এসে ববিতাকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় ও পরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত ববিতা সাংবাদিকদের বলছেন, আরজু নিজেও তাকে মারপিট করেছে। আজিজুর রহমান আরজু এ প্রতিবেদকের কাছে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, চুরির অভিযোগে পাশের গ্রামে এক গৃহবধূকে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই এবং নির্যাতিত মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় ও পরে হাসপাতালে নিয়ে আসি। বিষয়টি ওসি সাহেবও জানেন। পরে জানতে পারলাম এ ঘটনায় আমাকেও আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে শালবরাত গ্রামের কালামের স্ত্রী রতœা নিজেই মারপিট করেছেন স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, বাড়িতে কোন লোক না থাকায় ববিতা ও তার মা ঘরে ঢুকে চুরি করছিল। ববিতার তিন-চারটি বিয়ে আছে। সে একজন নষ্ট মেয়ে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জনান, বিষয়টি ধামাচাপ দিতেই কথিত চুরির ঘটনা সাজানো হয়েছে। নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ববিতা সাংবাদিকদের বলেন, ওরা গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে আমার পরনের জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লাঠির আঘাতে আমার হাত ভেঙ্গে গেছে। ওরা আমাকে টানাহেঁচড়া করেছে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পাশবিক নির্যাতন চালানোর কারণে একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। বিয়ের পর থেকেই স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি মিলে ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করছিল। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আমাকে তারা এর আগেও মারপিট করেছে। ববিতা বলেন, আমি গত বছর ৮ আগস্ট তারিখে আদালতে তাদের নামে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেছিলাম। ওই মামলা তুলে নিতে তারা হুমকিও দিচ্ছিল। এদিকে ববিতার সঙ্গে শফিকুলের বিয়ে হয়েছে ববিতা এ দাবি করলেও কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়া পৌরসভার মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার সুলতান আহমেদ লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, শফিকুল ইসলাম, পিতা-আব্দুস সালাম শেখ, গ্রাম-শালবরাত ও ববিতা খানম, পিতা ইসমাইল, গ্রাম-এড়েন্দা উভয় থানা-লোহাগড়া, জেলা নড়াইলের কোন বিবাহ তার অধীনে হয়নি। এমনকি বই নং ১, বালাম নং-৪৮১৩, পৃষ্ঠা নং-১৮, ক্রমিক নং-৩১৮, তারিখ-০২/১২/২০১৩ এ ববিতা ও শফিকুলের বিবাহ সংক্রান্ত তথ্য সঠিক নয়। ঘটনার ৫ দিন পর নির্যাতিত ববিতার মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে জামাই শফিকুল শেখকে প্রধান আসামি করে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মঙ্গলবার লোহাগড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধন) ২০০৩ এর ১১(গ)১০/৩০ ধারা মূলে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-৭, তারিখ ০৫ ০৫ ১৫)। এ বিষয়ে লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ লুৎফর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে এবং এজাহারভুক্ত একজনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ববিতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে নড়াইলের পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
×