ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খোন্দকার জাকারিয়া খালেদ

দিবস ॥ মানবতার সেবায় রেড ক্রিসেন্ট

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৮ মে ২০১৫

দিবস ॥ মানবতার সেবায় রেড ক্রিসেন্ট

মনে পড়ে, রেডক্রস সংগঠিত হওয়ার পূর্বের সেই ঐতিহাসিক পটভূমির কথা। ইতালির সালফারিনোর মাঠে ১৮৫৯ সালে সংঘটিত ফ্রান্স-অস্ট্রিয়া যুদ্ধ; যুদ্ধের পর সেখানে পড়েছিল কমবেশি ৪০ হাজার নিহত-আহত উভয়পক্ষের সৈন্য- যাদের দেখাশোনা করার মতো কেউ সেখানে ছিল না। জিন হেনরি ডুনান্ট, একজন ব্যবসায়ী, দৈবক্রমে ঐ সময় সে স্থান পার হচ্ছিলেন। তিনি চলেছিলেন ফ্রান্সের রাজা তৃতীয় নেপোলিয়ানের সঙ্গে ব্যবসাসংক্রান্ত আলোচনার জন্য; কিন্তু এ মর্মান্তিক দৃশ্য তার হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি ব্যথিত হন এবং উভয়পক্ষের আহত সৈন্যদের সেবায় নিয়োজিত হন আশপাশের গ্রামবাসীদের নিয়ে। তিনি তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন এবং পানি ও হাল্কা খাবারের ব্যবস্থা করেন। হাজার হাজার সৈন্য তার এই সেবা পেয়ে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পান। ‘ডুনান্ট’ সৈন্যদের যার যার দেশে পাঠিয়ে দেন। এ কাজ করে ডুনান্ট বিরল আনন্দ লাভ করেন। তার মাথা থেকে ব্যবসার কথা উবে যায়। তিনি ভাবতে থাকেন এমনিতর যুদ্ধ ভবিষ্যতেও দেশে দেশে আরও হবে। তাই এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যার দায়িত্বই হবে যুদ্ধাহত সৈন্যদের নিরপেক্ষভাবে সেবাদান করা। তিনি দেশে ফিরে ‘সালফারিনোর স্মৃতি কথা’ নামক একটি বই লিখলেন-যেখানে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে যুদ্ধাহত অসহায় সৈন্যদের সেবার জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানান। বইটি ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হলে তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রধান ও সরকার প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাজ থেকে। ফলশ্রুতিতে ১৮৬৩ সালের ২৬-২৯ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে ‘রেডক্রস’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সুইজারল্যান্ডের পতাকা লাল জমিনে সাদা ক্রস, এটাকে বিপরীত করে সাদা জমিনে লাল ক্রসকে এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালে মানবতাবোধ, নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছামূলক সেবা, একতা ও সার্বজনীনতাÑ এই ৭টি নীতিকে রেডক্রসের মূল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়; যার ওপর ভিত্তি করে রেডক্রস তার সকল কর্মকা- পরিচালনা করে থাকে। মূলত যুদ্ধাহত সৈন্যদের সেবাদানের ব্রত নিয়ে রেড ক্রসের জন্ম হলেও জেনেভা কনভেনশনের বিস্তৃত কার্যক্রম, দুস্থ সাধারণ লোকের স্বাস্থ্য সেবা, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা, দারিদ্র্যমোচন, যুব নেতৃত্ব গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, সমাজ উন্নয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করায় রেডক্রসের কার্যক্রমের পরিধি অনেক ব্যাপকতা লাভ করেছে, উপকারভোগীদের সংখ্যাও অনেক অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৬টি দেশ নিয়ে রেডক্রস তার যাত্রা শুরু করলেও রেডক্রস রেড ক্রিসেন্টের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৮৮ এবং বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৯৮ মিলিয়ন সমান সংখ্যক নিবেদিত নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক সম্পৃক্ত রয়েছে রেডক্রসের সঙ্গে। রেডক্রস একত্রিত করেছে সাদা, কালো, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও ধনী গরিবকে। রেডক্রস তার সফল মানবিক কর্মকা-ের জন্য ১৯১৭, ১৯৪৪ ও ১৯৬৩ সালে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তও হয়েছে। এই রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা যিনি, তার নাম ‘জিন হেনরি ডুনান্ট’। ডুনান্ট ১৮২৮ সালে ৮ মে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ণগঈঅ সহ ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। ছেলেবেলা থেকেই ডুনান্ট মানবদরদী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তার পারিবারিক পরিম-লও ছিল মানবসেবার অনুকূলে। ডুনান্টের বাবা জিন জ্যাকুয়েস ডুনান্ট কাউন্সিল সভা ও ব্যবসায়ী চেম্বার সদস্য ছিলেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের কল্যাণে কাজ করা, গরিবদের সহায়তা করা ও জেলখানা পরিদর্শন করা বাবার দায়িত্ব ছিল। এই সূত্রে ডুনান্ট ১৮ বছর বয়সেই বাবার সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে জেলখানায় গরিব ও অনুতাপকারী কয়েদিদের দেখতে যেতেন ও তাদের জন্য কাজ করার সুযোগ পান। মা এ্যানি এন্টনি ফ্রান্সের বিখ্যাত কোলাডন পরিবারের সদস্য ছিলেন। ডুনান্টের নানা হেনরি কোলাডন ছিলেন জেনেভার একটি বিখ্যাত হাসপাতালের পরিচালক ও পার্লামেন্ট সদস্য। ধর্মের প্রতি ডুনান্টের দুর্বলতা ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে পড়াকালে তিনি একাধিকবার ধর্ম বিষয়ে ক্লাসে সর্বোচ্চ নাম্বার পান। বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে তার জানার আগ্রহ ছিল। ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় তাকে কাজে কয়েকবার আলজিরিয়ায় যেতে হয়েছিল। সেখানে তিনি মুসলমানদের সভ্যতা, ভদ্রতা, আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আরও জানতে ও শিখতে আরবী ভাষাও শিখে নেন। আরবীতে তার লেখা একটি চিরকুট এখনও জেনেভার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরক্ষিত আছে। ডুনান্ট বিশ্বাস করতেন-পশ্চিমের সভ্যতা ও কৃষ্টির মূল শিকড় পুবে। ডুনান্ট ১৯১০ সালের ৩০ অক্টোবর ৮৩ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডের নিভৃত পল্লী হেইডেনে ইহকাল ত্যাগ করেন। ছোট বড় অনেক সৃষ্টির মধ্যে রেডক্রস প্রতিষ্ঠা তার সবচেয়ে বড় অবদান; এই জন্য তিনি ১৯০১ সালে সর্বপ্রথম শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত হন। প্রতিবছর তার জন্মদিন ৮ মে কে ‘বিশ্ব রেডক্রস/রেড ক্রিসেন্ট দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। লেখক : প্রাক্তন উপ-মহাসচিব, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি
×