ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র উৎসব কাল শুরু

মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৭ মে ২০১৫

মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক

জনকণ্ঠ ডেস্ক “ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্তধুলির ঘাসে ঘাসে। সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক- এলো মহাজন্মের লগ্ন”। “চির নতুনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ”। “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসব কবিতা এবং তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীগুলো যেমন দম্ভহীন, তেমনই অহঙ্কারমুক্ত- যা মানুষ-মানুষে শ্রদ্ধা আর ভালবাসার বন্ধন মজবুত করে। দূরে সরিয়ে দেয় সমস্ত হিংসা-নিন্দা। সেই অহঙ্কারমুক্ত জনমানুষের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মজয়ন্তী আগামীকাল ২৫ বৈশাখ। বাঙালী জীবনে এক স্মরণীয় দিন। তাই পুরনো দিনের সকল জরা-জীর্ণতা পেছনে ফেলে নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সব ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত করা হয়েছে কবির স্মৃতিময় নওগাঁর পতিসরের কাছারি বাড়ি, কুষ্টিয়ার কুঠিবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি আলাদা আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে অপরূপ বর্ণিল সাজে। প্রতি বছরের মতো এবারও এসব স্থানে আসবেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, উর্ধতন কর্মকর্তাসহ দেশবরেণ্য শিল্পী ও রবীন্দ্রভক্ত এবং গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও মেলাসহ জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে বিশ্বকবির এবারের জন্মোৎসবে। শাহজাদপুরে ব্যাপক প্রস্তুতি ॥ বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর কাছারি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী পালনের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও দিবসটি পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া বসবে রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রমেলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত জমিদারি দেখাশুনার কাজে শাহজাদপুর কাছারিতে আসতেন এবং সাময়িকভাবে বসবাস করেছেন। তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারি একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির একটি অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় এ জমিদারি কিনে নেন। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়। শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬ দশমিক ৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০ দশমিক ২০ মিটার এবং উচ্চতায় ৮ দশমিক ৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতি তলার সিঁড়িঘর ব্যতীত বিভিন্ন আকারের মোট সাতটি করে কক্ষ আছে। ভবনটির উত্তর ও দক্ষিণে একই মাপের প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দায় গোলাকৃতির জোড়ামাপের থামের উপরাংশের অলঙ্করণ বড়মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের উপরের প্যারাপেট দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯৬৯ সালে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় ভবনটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এক তলা দোতলার ছাদ পুনর্নির্মাণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে ভবনটি রবীন্দ্র জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র ও এ বাড়িতে প্রাপ্ত আসবাবপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি জাদুঘরের রূপ দেয়া হয়েছে। এই জাদুঘরের আসবাবপত্র সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার্য। আছে কবিগুরুর পিয়ানো, পাল্কি, খাট, পালং, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি প্রাঙ্গণে নির্মাণ করা হয়েছে অডিটরিয়াম। সেখানে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের দফতর। রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি স্মৃতি জাদুঘরে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী আসেন। আসেন দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীও। পতিসরে পর্যটনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত ॥ বিশ্বজিৎ মনি নওগাঁ থেকে জানান, প্রতি বছরই এইদিনে পতিসরে নামে রবীন্দ্রভক্তের ঢল। পরিণত হয় জনমানুষের মিলনমেলায়। সরকারীভাবে ১ দিনের কর্মসূচী নিলেও এ মিলনমেলা চলে সপ্তাহজুড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে কবিভক্তরা ছুটে আসেন তাদের প্রিয় কবির পতিসর কাছারি বাড়ি প্রাঙ্গণে। একে অপরের সান্নিধ্যে এসে স্মৃতিচারণে লিপ্ত হন কবিভক্তরা। কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি হাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধণ্য কবির নিজস্ব জমিদারি নওগাঁর পতিসর যেন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কাছারি বাড়িতেই কবিগুরুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পতিসরে নাগর নদের পাড়কে মনোমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিনেও পতিসরের তেমন উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন না হলেও এবার যেন হাঁটি হাঁটি পা-পা করে উন্নয়নের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। কবিগুরুর নিজস্ব জমিদারি এলাকা কালিগ্রাম পরগনার সদর দফতর এ পতিসর। আর এ পতিসর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ মাধুর্যঘেরা কবির স্মৃতিবিজড়িত পতিসর আজও সাহিত্যের অঙ্গনে সাড়ম্বরে বিরাজিত। কবির যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়, তখনও তিনি বিরাজ করেছেন পতিসরে। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৩৬ কিলোমিটার ও আত্রাই উপজেলা থেকে ৪৬ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক চলে গেছে নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীতে, কবিগুরুর কাছারি বাড়ি জেলার আত্রাই উপজেলার মনিয়ারি ইউনিয়নের পতিসর গ্রামে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত পাকা সড়ক হোক আর নিঝুম-নিস্তব্ধ-নিভৃত পল্লীই হোক, তাতে কি আসে যায়! তিনি যে আমাদের প্রাণের কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নওগাঁ এবং আত্রাই থেকে মাইক্রোবাস, বাস, সিএনজি যোগে পতিসরে যাওয়া যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নওগাঁর আত্রাইয়ের এই পতিসরে এসে তাঁর কাছারি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’। যদিও বর্তমানে নাগর নদের তলদেশ জলশূন্য। এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত কবিতা “তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে”, “দুই বিঘা জমি” “সন্ধ্যা”সহ অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন এই পতিসরের কাছারি বাড়িতে বসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার পুরস্কারের অর্থ তিনি এই পরগনার প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার জন্য ৭৫ হাজার টাকা তৎকালীন সময়ে এখানে স্থাপিত কৃষিব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ॥ এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে জানান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার যে গ্রামে বসবাস করেছিলেন সেই গ্রামটির নাম ‘শিলাইদহ’। কুমারখালী উপজেলার অন্তর্গত শিলাইদহ গ্রামটির দূরত্ব কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার। এ গ্রামেই রয়েছে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহসিক ‘কুঠিবাড়ি’। অবশ্য বর্তমানে যে স্থানে কুঠিবাড়ি রয়েছে সে গ্রামটির নাম ‘খোরসেদপুর’। কুঠিবাড়িসহ শিলাইদহ গ্রামটিকে প্রমত্তা পদ্মা বহু পূর্বেই গ্রাস করলে পরে দরবেশ শাহ মখদুম মৌলুক খোরসেদের নামানুসারে খোরসেদপুর মৌজাতেই ১৮৬২ সালে পুনরায় কুঠিবাড়ি ডকাঘর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু স্থানটির নাম শিলাইদহ থেকে যায়। এবার কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনেও কোন কমতি নেই এখানে। এ উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিলাইদহে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান। ২৫, ২৬ ও ২৭ বৈশাখ রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীর এসব আয়োজনে থাকছে আলোচনা, সেমিনার, আবৃত্তি, নাটক ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন জানান, সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্নের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ভিআইপিসহ সকল অতিথিদের নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শিলাইদহে তিন দিনব্যাপী এ আয়োজনের প্রথম দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিকেলে থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×