ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৭ মে ২০১৫

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

কোন নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে কিছু মিডিয়ার ভূমিকা এমন হয় যে, এই নির্বাচনে সরকারের জয় হয়েছে। নির্বাচন প্রাতিষ্ঠানিকতা পেল। আর আওয়ামী লীগ জয়ী হলে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। সদ্য অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে ওই মিডিয়াগুলোর ভূমিকা দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ নির্বাচনে বিএনপির সহিংসতা নিয়ে আদৌ সরব নয় মিডিয়াগুলো। ৬ মে’র ধারাবাহিকতায় আজ পড়ুন... বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচনে আনার দায় যেন বাংলাদেশে সবার এবং তারা যে সব শর্ত দেবে, তা মেনে নিতে হবে। না হলে বলা হবে তা সরকারের স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গি। বলা হবে, গণতন্ত্র রক্ষা পাচ্ছে না। ঐ সময়কার জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ ছাড়া অন্য কাগজগুলো খুলে দেখুন। শেখ হাসিনা যে শুনলেন না, মিডিয়ার ক্ষোভ সেখানেই। তারা এত ক্ষমতাবান, তাদের পিছে আমেরিকা আছে, পাকিস্তান আছে, তাদের কথা শুনবে না ‘শেখের বেটি’, এত বড় আস্পর্ধা! নির্বাচনের দিন বিএনপি-জামায়াত ৫০০ স্কুলের কেন্দ্র পুড়িয়েছে। হিন্দু ও আওয়ামী ভোটাররা আক্রান্ত হয়েছে। ধর্ষণ ও হত্যা হয়েছে। তারপরও মানুষ জেদ করে ভোট কেন্দ্রে গেছে। কিন্তু নির্বাচনের এই প্রচেষ্টা গ্রাহ্য হয়নি। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া পছন্দ হয়নি। এমনকি মহিলার কপালে সিঁদুর লাগিয়ে জাল ছবি ছাপা হয়েছে এ কথা প্রমাণের জন্য যে, হিন্দু মহিলারা ভোট দিয়েছে। এসব এথিক্যাল কিনা, এসব প্রশ্ন ওঠানো যাবে না। কারণ তাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। গত কয়েকদিন পত্রিকায় বার বার আসছে, রাষ্ট্র কর্তৃক কী ভাবে সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। আমরাও এই নিগ্রহ নির্যাতন মানতে রাজি নই। যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তাদের পছন্দ না হলে সাংবাদিকদের নিগ্রহ করবেন, তা কাজের কথা নয়। কিন্তু, সাংবাদিকদের কারণে যে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, নিপীড়ন ও অগণতান্ত্রিক প্রথা প্রশ্রয় পাচ্ছে, তার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে। এসব বিষয়ও বিবেচনায় আনতে হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন আর ১৯৯৬ সালে বিএনপির কতজন একইভাবে নির্বাচিত হয়েছিল, তা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই সময় কোন দলই নির্বাচনে যায়নি। কিন্তু এবার তো তা বলা যাবে না। এ বিষয়টি কখনও মিডিয়া উল্লেখ করে না। ২০১৪ সালে এত সব ঝামেলার পরও মানুষ ভোট দিয়েছে এবং ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। মিডিয়া সব সময় এই নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলেছে। যে ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে, যারা তা দিয়েছেন, তারা কি ভোটার বা মানুষ নন? এখনও টিভির টক শো বা পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখবেন ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের আলোচনা। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদকরাই ঠিক করবেন বাংলাদেশ কী ভাবে চলবে, কারা চালাবে। সংবাদপত্রের এথিকস এতে বিনষ্ট হয় কিনা, তার্কিকরা তা ভেবে দেখবেন। ॥ ৬ ॥ সিটি নির্বাচনে ১১টা পর্যন্ত ভোট তো ঠিকই হয়েছে। তাবিথের পক্ষে টাকা বিলাতে গিয়ে কয়েকজন ধরা পড়ে। মিডিয়া বারবার প্রচার করে খবরটিকে গুরুত্ব দেয়নি। নির্বাচনতো ঠিকই চলছিল। প্রার্থীরাও জানতেন, ভোট হচ্ছে সুষ্ঠুভাবেই। কিন্তু ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত আগেই নেয়া হয়েছিল। এই জনকণ্ঠেই নির্বাচনের আগে লিখেছিলাম, নির্বাচন বিএনপি-জামায়াতের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যে অমানবিক কাজ তারা করেছে তিন মাস, তা থেকে নিজেদের বাঁচাতেই নির্বাচনে এসেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারা দলে প্রাণসঞ্চার করতে চায়। বিএনপির বড় নেতা নজরুল ইসলাম ও একজন পাতি নেতার কথোপকথনে বিষয়টি পরিষ্কার। সে কথনে জানা যায়, তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না নির্বাচনের আগের দিন না নির্বাচনের দিন নির্বাচন বর্জন করা হবে। প্রার্থীদের কিন্তু বিষয়টি জানান হয়নি। নির্বাচনের দিন শিমুল বিশ্বাসের নির্দেশে মওদুদ নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। তাবিথ তার পিতার সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করতে চেয়েছিলেন। সে সময়ও তাকে দেয়া হয়নি। এইসব কথোপকথনের ভাষ্য কিছু টিভিতে দেখান হয়েছে এবং শুধুমাত্র জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছে। অন্য পত্রিকাগুলো তা ছাপল না কেন? খবরগুলো কি গুরুত্বহীন? মনজুর আলম নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতাকে সেন্টার খরচের সব টাকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেন্টারে সেন্টারে এজেন্ট পৌঁছে যাবে। সকালে মনজুর নিজের ভোট দিয়ে কয়েকটি সেন্টার ঘুরে দেখেন তার কোন এজেন্ট নেই। টাকাসহ নেতারাও নেই। টিভিতে শুনলাম বলা হচ্ছে, অবসর নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর তিনি মন্তব্য করেছেন, যে টাকা তিনি দিয়েছেন তাতে তিনটি হাসপাতাল হতে পারত। অর্থাৎ, পুরো বিষয়টিই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কথা; কিন্তু প্রার্থীকে প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়া হয়নি। বিএনপির স্ট্রাটেজি ছিল নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তোলা। তারা জানত মিডিয়া তাদের সহায়তা করবে। বিগ বিজনেস তাদের ছাড়া চলবে না, কেননা তাদের সময়ই তারা সম্পদশালী হয়েছে। নির্বাচনে কি অনিয়ম হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। নির্বাচনে কি হৈ হট্টগোল মারপিট হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। এবং আমাদের দাবি, ভবিষ্যতের স্বার্থে এসব বিষয়ের সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি প্রদান। কিন্তু একটি বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যেখানে এত আলোচনা, সেখানে সরকার এ কাজ করবে কেন? কারণ, এতে তাদের ক্ষতি বই লাভ নেই। সকাল ১১টা পর্যন্ত দেখা গেছে ভোট কেন্দ্রে লম্বা লাইন। যে দুজন রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের, যাদের সব ব্যাপারে বক্তব্য থাকে, তারাও সকালে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। এই বক্তব্য আসার পরই কিন্তু নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর কি সব কেন্দ্রে হাঙ্গামা হয়েছে? হয়নি। বিকেল পর্যন্ত ভোট চলেছে এবং বিএনপি-জামায়াতের কাউন্সিলররা নির্বাচনে ছিলেন। অর্থাৎ যারা ভোটার তারা বর্জন গর্জনে কর্ণপাত করেননি। তারা তাদের অধিকার প্রয়োগ করেছেন। হ্যাঁ, জালভোট দেয়া হয়েছে। তা কি শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেই হয়েছে, নাকি বিএনপির পক্ষেও? ২১০০টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৫৫টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। আগে যেসব নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরেছি, তার তুলনায় এটি শতকরা কতো ভাগ? খুব সম্ভব ৩ ভাগের কম। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, আমরা নির্বাচনে এসব অনিয়ম চাই না। আমরাও চাই না। কিন্তু বাস্তবতা কী? আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করুন। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর তুলনায় এ নির্বাচনে ভায়োলেন্সের সংখ্যা কমে আসছে বেশি ভাবে। আমাদের বলা উচিত ছিল, ক্রমান্বয়ে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ভায়োলেন্স বা অনিয়ম কম হয়েছে, এটিই ভোটারদের কৃতিত্ব। টক শোতে দেখেছি অনেক টকার বিজ্ঞভাবে বলছেন, বিদেশে তো এসব হয় না। এর উত্তর, সেখানে বিদেশে বিএনপি-জামায়াতের মতো দল নেই। যেসব দল আছে, তারা ৯২ দিন সন্ত্রাস করে ১৫০ লোক খুন করে না। বিদেশে কি এসব কা- হয় না? গতকাল কাগজে পড়লাম, লন্ডনে আসন্ন নির্বাচনের জন্য ভ্যানে করে ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পথে দুই লাখ ব্যালট ছিনতাই হয়েছে। দু’সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গে পুরসভা নির্বাচন হয়েছে। ব্যাপক গোলযোগ হয়েছে এবং সাতজন নিহত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলো এর সমালোচনা করেছে, কিন্তু পুরো নির্বাচন প্রহসন হয়েছে এমনটি বলেনি। এবং বিজয়ী-পরাজিত সবাই ফলাফল মেনে নিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচন, তা স্থানীয় বা জাতীয় যাই হোক, নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পর সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এবারের নির্বাচনের আগে তেমন কোন সহিংস ঘটনা ঘটেনি। সবাই খুবই ভদ্রভাবে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছেন। কেউ কারো চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করেননি। এরকম আশ্চর্য ঘটনা আগে ঘটেনি। এমনকি বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীরাও এসব কর্মকা- থেকে বিরত থেকেছেন। তাহলে কি বলব, তারাও সেই বিষাক্ত চক্র থেকে বেরুবার চেষ্টা করছেন? নির্বাচনের সময় ৫৫টি সেন্টারে গ-গোল হয়েছে। কিন্তু নিহত হওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। এমনকি নির্বাচনের পরও সহিংস ঘটনা ঘটেনি। অথচ, মেয়র হানিফের জয়ের পর সাতজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল। এই যে ইতিবাচক এতোগুলো দিক, মিডিয়া কিন্তু তার উল্লেখ করেনি। আসলে মিডিয়া সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করেছে, যা বলেছেন তোফায়েল আহমদ ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সভায় যে, তারা নেগেটিভ খবর চান। যত নেগেটিভ খবর তত লাভ। যে কারণে ঢাকার সুরিটোলা কেন্দ্রের ঘটনাটি ২৪ ঘণ্টা দেখান হয়েছে। এটি মিডিয়ার ইতিবাচক দিক, যুক্তিসম্পন্ন কোন মানুষ তা বলবেন না। (চলবে)
×