ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গৌরবময় অর্জনের হাতছানি টাইগারদের

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৬ মে ২০১৫

গৌরবময় অর্জনের হাতছানি টাইগারদের

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ইতোমধ্যেই বীরত্ব গাঁথা লেখা হয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ একটি সিরিজে এই প্রথম আগাগোড়া নিজেদের চেয়ে বড় প্রতিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সফরকারী পাকিস্তান দল এক মুহূর্তের জন্যও সুযোগ পায়নি টাইগার শিবিরে পরাজয়ের কালো মেঘের ঘনঘটা আনতে। ইতিহাস বলে ‘রোমনগরী একদিনে গড়ে ওঠেনি।’ প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম সমৃদ্ধ একটি নগরী ছিল রোম যা তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ দলও যেন সেভাবেই গড়ে উঠেছে। সেটার স্বাক্ষর দলের বীর সেনানিরা ইতোমধ্যেই রেখেছেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমী ভক্ত-সমর্থকদের হৃদয়ে ময়দানী লড়াইয়ে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে। খুলনা টেস্ট ড্র করার পর গৌরবের যেটুকু বাকি ছিল সেটাও করা হয়ে গেছে। এখন তাহলে বাকি থাকল কী? গৌরবটাকে আরও উজ্জ্বল করা। সেই লক্ষ্যেই আজ ‘ফাইনাল ম্যাচে’ পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে স্বাগতিক বাংলাদেশ। বুকের ভেতরে কতটা স্পৃহা, আত্মবিশ্বাস এবং তীব্র আকাক্সক্ষা থাকলে একটি টেস্ট ম্যাচ নিয়ে এমন কথা বলা যায়। আজ সকাল ১০টায় ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার আগে সেটাই বললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। পূর্ণাঙ্গ সিরিজের শেষ এই ম্যাচে ন্যূনতম ড্র করলেই শতভাগ গৌরব অর্জিত হবে। কিন্তু মুশফিক এটিকে ‘ফাইনাল’ সম্বোধন করে জয়টাই অন্যতম লক্ষ্য বলে ঘোষণা দিলেন। জিতে গেলে টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে তিন নম্বরে থাকা দলের বিরুদ্ধে সিরিজ বিজয় এই অঙ্গনের দশম একটি সদস্য দেশের জন্য বড় অর্জন আর কী-ই বা হতে পারে? আজ থেকেই সে ইতিহাস লেখার কারিগররা ময়দানী যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। মুশফিকের প্রেরণাদৃপ্ত কণ্ঠটাকে কাজে লাগিয়ে জয় দিয়ে শুরু কি হবে টাইগারদের গৌরবময় এক অধ্যায়ের? ভয়, বিশ্বাস, ক্ষুধা সবকিছুই নাকি মানুষের চোখেমুখে ফুটে ওঠে! পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পুরো সিরিজেই সেটা প্রস্ফুট হয়ে ছিল ‘টিম বাংলাদেশের’ প্রতিটি ক্রিকেটারের মধ্যে। শরীরী ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, মনোভাব, আচরণ কিংবা কথায় প্রতিপক্ষকে সমীহ নয় বরং পদানত করার যে চিত্রটা ফুটে ছিল তা অতীতে আর কখনও মনে দেখা যায়নি। টাইগারদের মধ্যে শুধু ভয়টাই দেখা যায়নি, তবে জয়ের ক্ষুধা বা তাড়না এবং আত্মবিশ্বাস টগবগ করে ফুটতে দেখা গেছে। বেশিদিন হয়নি। গত বছরও বাংলাদেশ দল টেস্ট ক্রিকেটে পদচারণা চালিয়ে যাওয়ার যোগ্য কিনা সেটা নিয়ে অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাই প্রশ্নের তীর ছুড়ে দিয়েছেন। সেখানে বর্তমান পাকিস্তান দলের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ ইউনুস খান এবং সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজারা তো ছিলেনই, আরও ছিলেন নভজ্যোত সিং সিধুর মতো অতীতের অনেক ক্রিকেট রথী-মহারথীরা। তারা এখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পাল্টে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখছেন। বার বার সমালোচনা স্বরে বিদ্ধ হতে হতে, নানামুখী বিতর্কের তোড়ে দিশেহীন হয়ে পড়া টাইগাররা এবার বিকট হুঙ্কারে কাঁপিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। অভিজ্ঞতা-শক্তিমত্তা আর কাগজ-কলমের পরিসংখ্যানে বিস্তর ফারাক পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের। কিন্তু বর্তমানটাই আসল, ইতিহাস শুধু শিক্ষারই নামান্তর। কোনভাবেই বিন্দুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি পাকরা। আর বিন্দু বিন্দু করে আত্মবিশ্বাস জমে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখন জয়ের ক্ষুধায় কাতর হয়ে উঠেছে। গত দু’দিনের অনুশীলনেও সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। খুলনা টেস্টে চরম বিপাকে ফেলেছিল তারা অভিজ্ঞতার জোরে বাংলাদেশকে। কিন্তু কোণঠাসা অবস্থায় থেকে বীরদর্পে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো আত্মতুষ্টি আর কিছুতে কী আছে? আর সেজন্যই এখন ক্রিকেটারদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, ‘হ্যাঁ, চেষ্টায় কি না করা যায়?’ অপ্রতিরোধ্য নেপোলিয়ন বোনাপার্টও তো হেরে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দলও যে কোন প্রতিপক্ষকে এখন ক্রিকেটের বাইশ গজের উইকেটে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম। সে জন্যই আত্মবিশ্বাসী মুশফিক পুরো দলের সম্মিলিত কণ্ঠেই যেন বললেন, ‘ফাইনাল ম্যাচ সেহেতু লক্ষ্য তো অবশ্যই জয়। ফাইনাল ম্যাচে জয়ের জন্য যা যা করা দরকার এই কাজগুলো যেন আমরা ফাইনাল ম্যাচে পুনরায় করতে পারি। সেটার জন্য সবাই অনেক কষ্ট করছে। আশা করব এই পাঁচটা দিন যেন আমরা কঠিন ক্রিকেট খেলে ফলাফলটা আমাদের দিকে নিয়ে আসতে পারি।’ খুলনার চেয়ে মিরপুরের উইকেট কিছুটা ব্যতিক্রম। স্পোর্টিং উইকেট থাকার কারণে ব্যাটসম্যান এবং বোলাররা সমান সুযোগ আদায় করে নিতে পেরেছেন নিজেদের প্রচেষ্টায়। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া অধিকাংশ টেস্ট ম্যাচেই এ ভেন্যুতে ফলাফল হয়েছে। এখন চাপটা পাকিস্তানের ওপরেই বেশি। কারণ এখন পর্যন্ত সফরে একটি ম্যাচও জিততে পারেনি তারা। সে জন্য মুশফিক ঘোষণা দিলেন, ‘ওরা এখন পর্যন্ত এ সফরে জয়হীন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে তারা যেন জয়হীন থাকে সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে আমরা সফল হব।’ কিন্তু কাগজ-কলমের হিসেবটা একেবারেই ফেলে দেয়া যায় না। পাকরা টেস্ট ক্রিকেটে অনেক এগিয়ে, এমনকি বর্তমান দলটাও। তাই ৫ দিনের প্রতি সেশন (১৫ সেশন) ক্ষণে ক্ষণে ম্যাচের ভাগ্য হেলে পড়তে পারে যে কোন দলের পক্ষে। এ কারণে প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে যথেষ্ট সম্মান জানিয়ে মুশফিক বললেন, ‘আমার মনে হয় সম্ভাবনা দু’দলেরই সমান। এখানে কোনভাবেই বলা যাবে না আমরা ফেবারিট কিংবা তারা। ম্যাচ হবে ফিফটি-ফিফটি।’ মুশফিকের কথারই অনুসরণ পাক অধিনায়ক মিসবাহ-উল-হকের কণ্ঠে, ‘ফেবারিট কেউ নেই। আর চাপ কী? আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবসময়ই চাপ থাকে। নিজেদের বোলিং পারফর্মেন্সে উন্নতি ঘটাতে চাই।’ প্রথম টেস্টে বোলিংটা বেশ ভুগিয়েছে উভয় দলকেই। ব্যাটসম্যানরাই রাজত্ব করেছেন। এ কারণে উভয় দলের বোলিং বিভাগেই এ টেস্টে বড় পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। আট ব্যাটসম্যান, দুই পেসার আর এক স্পেশালিস্ট স্পিনার না খেলিয়ে বাংলাদেশ দল দু’জন বিশেষায়িত স্পিনার নিয়ে নামতে পারে। সেক্ষেত্রে তরুণ লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখনকে একাদশে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে খুলনা টেস্টে অভিষেক ঘটা সৌম্য সরকারের ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর ইনজুরিতে পড়া রুবেল হোসেনের জায়গায় দুই বছর পর আবার টেস্ট খেলার জন্য নামতে পারেন ডানহাতি পেসার আবুল হাসান রাজু। আপাতত এ দুটি পরিবর্তন টাইগার শিবিরে প্রায় নিশ্চিত। তবে প্রথম টেস্টে আঙ্গুলে ব্যথা পাওয়া মুশফিক কিপিং না করতে পারলে শেষ মুহূর্তে অভিষেক হয়ে যেতে পারে তরুণ উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান লিটন দাসের। পাকরা দ্বিতীয় টেস্টের জন্য উড়িয়ে এনেছে তরুণ পেস-অলরাউন্ডার বিলাওয়াল ভাট্টিকে। আর অভিজ্ঞ অফস্পিনার সাঈদ আজমলের খেলার সম্ভাবনা বেশি। ২০০৩ সালে মুলতানে দারুণ সুযোগ এসেছিল পাকিস্তানকে টেস্ট ম্যাচে হারিয়ে দেয়ার। তবে ইনজামাম-উল-হকের ১৩৮ রানের অপরাজিত ইনিংসে সে যাত্রা ১ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস জয় তুলে নিয়েছিল স্বাগতিক পাকরা। এছাড়া বাকি ৭ টেস্টে অনায়াস অপ্রতিরোধ্যতায় জিতে গেছে পাকিস্তান। তবে হোঁচট খেয়েছে খুলনায় পরস্পরের নবম টেস্টে এসে। খুলনায় অবিশ্বাস্য একটি ড্র হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কারণে। নিজেদের ৯০তম টেস্টে নামবে বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত দুটি মাইলফলক রয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ওপেনার তামিম ইকবাল ও বিশ্বসেরা টেস্ট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের সামনে। আর ৫৩ রান করলেই বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সর্বাধিক রান সংগ্রাহক হবেন তামিম। আর সাকিব দুটি উইকেট নিতে পারলেই দেশের মাটিতে দেশের পক্ষে প্রথম বোলার হিসেবে ১০০ উইকেটের মালিক হবেন। সেটা তারা করতে পারলে পুরো দলের জন্যই হবে সুখকর। ধারাবাহিকতা রাখাটাই চ্যালেঞ্জ। যেভাবে টাইগাররা এখন পর্যন্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছে টেস্ট জয়টা অনেকেই চোখের সামনে ঘুরতে দেখছেন। মিরপুরে জিতলেই ৮ টেস্ট জেতা হয়ে যাবে। আর সঙ্গে সিরিজ বিজয়। ২০০৫ ও গত বছর জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে, ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের পর এবার সবদিক থেকে বড় দলের বিরুদ্ধে বিজয়ের গৌরব। সর্বশেষ ১০ টেস্টের পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার বাংলাদেশ দল সেটা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম। সর্বশেষ ১০ টেস্টে ৩ জয়, ৪ ড্র আর ৩ পরাজয় দেখেছে টাইগাররা। জয়ী হতে পারবেন তো মুশফিকবাহিনী? যোগ হবে গৌরবময় একটি অর্জন? আগামী ৫ দিনের মধ্যেই হয় তো পুরো জাতিকে উচ্ছ্বাস আর উৎসবে ভরিয়ে তুলতে যাচ্ছেন মুশফিকবাহিনী। দেখা যাক কি করেন টাইগাররা।
×