ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

২ সালে সংশোধিত নতুন আইনে ফাঁসি ও যাবজ্জীবনের বিধান রয়েছে

ধর্ষণ করে হত্যায় একমাত্র মৃত্যুদণ্ড সাজা অসাংবিধানিক ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৬ মে ২০১৫

ধর্ষণ করে হত্যায় একমাত্র মৃত্যুদণ্ড সাজা অসাংবিধানিক ঘোষণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ করে হত্যা মামলায় একমাত্র সাজা মৃত্যুদ-ের বিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন আপীল বিভাগ। আপীল বিভাগের রায়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধানটিকেই অসাংবিধানিক বলছেন আদালত। একই সঙ্গে আইনটির ৬(৩) ও ৬(৪) ধারা এবং ২০০০ সালের সংশোধিত আইনের ৩৪(২) ধারাকেও অসাংবিধানিক বলা হয়েছে রায়ে। মঙ্গলবার একটি রিট মামলার নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন। এ সময় আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট এমআই ফারুকি, আব্দুল মান্নান খান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। আপীল বিভাগের রায়ে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ এর ২, ৩, ৪ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। ঐ ধারাগুলোতে ধর্ষণ ও হত্যার ক্ষেত্রে সাজা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। তিনটি ধারায় সাজা হিসেবে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হলেও ৬(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার দায়ে কেবল মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল। ২০০০ সালে আইনটি সংশোধন করা হলে পুরনো আইন রহিত হয়ে যায়। নতুন আইনের ৯(২) ধারায় ধর্ষণ করে হত্যার ক্ষেত্রে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রাখা হয়। কিন্তু ২০০০ সালের আইনের ৩৪-এর ২ ধারায় বলা হয়, এ ধরনের অভিযোগে ১৯৯৫ সালের আইনে যেসব মামলা বিচারাধীন, সেগুলো ওই আইনেই চলবে। আপীল বিভাগের রায়ে এই ধারাটিও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে শুধু মৃত্যুদ-ের বিধান আর থাকছে না। রায়ের পর আইনজীবীরা বলছেন, ১৯৯৫ সালের আইনে বিচারাধীন মামলাগুলোর ভবিষ্যত এখন কী হবে তা আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর জানা যাবে। এই মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। আপীল বিভাগের রায়ের পর দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, সাধারণ জ্ঞানে বুঝি শুধু ফাঁসির বিষয়টি বলা হয়েছে। নতুন আইনে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রয়েছে। শুধু ফাঁসি দেয়ার বিধানে বিভ্রান্তি ছিল। ১৯৯৫ সালের অধীনে চলমান মামলাগুলো কী ভাবে চলবে এর উত্তরে প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় বের না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়টি বলা যাবে না।একই সঙ্গে শুকুর আলীর সাজা কার্যকর হবে কী হবে না, তাও পূর্ণাঙ্গ রায় বের না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়। মাহবুবে আলম বলেন, তবে আমার মত হচ্ছে, পুরনো আইনে চলা মামলাগুলো এখন ২০০০ সালের আইনে চলতে পারে। কারণ, ২০০০ সালের আইনে ধর্ষণ ও হত্যার শাস্তি যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদ- দুটোই আছে। ১৯৯৫ ঐ বিধান বাতিল হলে বর্তমান আইনে বিচার করতে কোন বাধা নেই। অপরাধ করলে বিচার হবে। তিনি আরও বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) ১৯৯৫ সালের আইনের ৬(২) ধারায় কেউ যদি কোন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে, তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। ৬ (৩) ও (৪) ধারায় দলবদ্ধভাবে কেউ যদি ধর্ষণ করে, তাহলে তাদের যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদ- এবং ধর্ষণের পর হত্যা করলে তাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। আদালত এ বিধানগুলোকে অসাংবিধানিক বলেছেন। এছাড়া ২০০০ সালের আইনের ৩৪(২)বলা হয়েছে, ‘উক্তরূপ রহিতকরণের অব্যবহিত পূর্বে উক্ত আইনের অধীন অনিষ্পন্ন মামলাসংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে এবং অনুরূপ মামলায় প্রদত্ত আদেশ, রায় বা শাস্তির বিরুদ্ধে আপীল সংশ্লিষ্ট আদালতে এমনভাবে পরিচালিত ও নিষ্পত্তি হইবে যেন উক্ত আইন রহিত করা হয় নাই।’ অন্যদিকে আবেদনকারীপর পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী এম আই ফারুকী বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখা পর্যন্ত পুরনো আইনের মামলাগুলোর ভবিষ্যত বলা যাবে না। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)এর আইনজীবী আব্দুল মান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেছেন, রায় ভাল হয়েছে। এটা একটা মাইলফলক জাজমেন্ট। বাংলাদেশে এমন ঘটনা কমই হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় ছাড়া কিছু জানা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি দ্রুত পূর্ণাঙ্গ রায় বের হবে। তিনি আরও বলেন, রায়ে একজনের সাজা কমিয়ে দিয়েছেন আপীল বিভাগ। আমাদের ধারণা শুকুর আলীর আপীল এ্যালাউ হয়েছিল। সে অনুযায়ী আমাদের ধারণা শুকুর আলীর দ- কমিয়ে দিয়েছেন। মামলার ঘটনা থেকে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার শিবরামপুর গ্রামে শুকুর আলী নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। ২০০১ সালের ১২ জুলাই বিচারিক আদালত শুকুর আলীকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট মৃত্যুদ- বহাল রাখে। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপীল বিভাগেও সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। শুকুর আলী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ওই বছরের ৪ মে তাও খারিজ করে দেয় আপীল বিভাগ। এরপর শুকুর আলী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।২০১০ সালের ২ মার্চ হাইকোর্ট ৬-এর ২ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তবে আপীল বিভাগে শুকুর আলীর মৃত্যুদ- বহাল থাকায় হাইকোর্ট তাতে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। সাজা না কমায় ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবারও আপীল বিভাগে আসেন শুকুর আলী ও ব্লাস্ট। এছাড়া ওই আইনে দ-প্রাপ্ত আরও ১০টি আবেদনের শুনানি করে গত মাসে আপীল বিভাগ বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। মঙ্গলবার আপীল বিভাগ ওই আপীল মঞ্জুর করে ১৯৯৫ সালের আইনের তিনটি ধারা বাতিল করেন।
×