ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দক্ষ মুদ্রা ব্যবস্থাপনার অর্থনীতির সব সূচকেই উল্লম্ফন ঘটছে;###;দেশ-বিদেশের বৈরী পরিস্থিতির মাঝেও অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে

অর্ধযুগে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে ব্যাংকিং খাতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৬ মে ২০১৫

অর্ধযুগে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে ব্যাংকিং খাতে

কাওসার রহমান/রহিম শেখ ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষ মুদ্রা ব্যবস্থাপনার কারণেই অর্থনীতির সূচকগুলোর উলম্ফন ঘটছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মন্দার মাঝেও দেশ ধারাবাহিকভাবে সমর্থ হচ্ছে ছয় শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনে। গত অর্ধযুগে বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু বিচক্ষণ মুদ্রানীতিই প্রণয়ন করেনি, বেশ কিছু সংস্কার এনেছে আইন ও বিধিবিধানে। নেয়া হয়েছে যুযোপযোগী ও সুদূরপ্রসারী প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম এবং উপযুক্ত নীতি পদক্ষেপ। ফলে শক্তিশালী হয়ে ওঠা ব্যাংকিং খাতের সুফল বইছে দেশের অর্থনীতিতে। ব্যাংক ও অর্থনীতির বিশ্লেষকদের মূল্যায়নে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উপযুক্ত নীতি-পদক্ষেপের কারণেই ব্যাংকিং খাতে গত অর্ধ-যুগে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। দেশ-বিদেশের নানা বৈরী পরিস্থিতির মাঝেও অর্থনীতির সূচকগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশে নীরব বিপ্লব ঘটছে। দেশে শুরু হয়েছে অংশগ্রহণমূলক, মানবিক, জনহিতৈষী ও সবুজ ব্যাংকিংয়ের যাত্রা। এগুলো সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নরের দায়িত্বে থাকা একজন সফল ‘ইকোনোক্রেট’ ড. আতিউর রহমানের কারণে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘দক্ষতার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনার কারণেই দেশে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে উঠেছে। দেশের রেটিং ভাল আসছে। মূল্যস্ফীতিকে নিম্নগামী রেখে প্রত্যেক সূচক অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। যার সুফল বইছে অর্থনীতিতে।’ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর আতিউর রহমানকে একজন দক্ষ ‘ইকোনোক্রেট’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, একজন ইকোনোক্রেট হিসেবে আতিউর রহমান বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কৃষক, খুদে ও নারী উদ্যোক্তাসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার আওতায় এনে তাদের সব ধরনের উৎপাদনমুখী উদ্যোগে অর্থায়নে ব্রতী করেছেন। অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালাও পোড়াওয়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ কারণেই দেশে এখন আর্থিক নীতির চেয়ে মুদ্রা নীতি অনেকটা এগিয়ে আছে। এটা সম্ভব হয়েছে দক্ষ মুদ্রা ব্যবস্থাপনার কারণেই। ড. আলী মনে করেন আর্থিক নীতি যেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যর্থ সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সফলতার সঙ্গে স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) এমএসএমই’র মাধ্যমে আরও প্রসারিত করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এতে দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে নীরব বিপ্লব সাধিত হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আব্দুস সবুর খান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডিসিসিআই প্রথম বারের মতো একসঙ্গে কাজ করছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকার একটি পুনর্অর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক এসএমই পুনর্অর্থায়ন তহবিল চালু করেছে। যা দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, একটি স্থিতিশীল আর্থিক খাত গড়ে তুলতে গত ছয় বছরে ব্যাংকিং সেবায় মানবিক ধারণা প্রসারের উদ্যোগ নেয়া হয়। কৃষি, এসএমইসহ উৎপাদনমুখী ও পরিবেশবান্ধব খাতগুলোতে ঋণের যোগান বাড়ানো, কৃষক ও হতদরিদ্রদের ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেয়া, বর্গাচাষীদের জন্যে বিশেষ ঋণ, আমদানি-নির্ভর ফসল চাষে কমসুদে ঋণ, খুদে ও নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ সৃষ্টি, সামাজিক দায়বদ্ধ কর্মকা- প্রসারে বিভিন্ন ব্যাংককে তাগিদ দেয়া, দ্রুত ও কম খরচে টাকা পাঠানোর জন্যে মোবাইল ব্যাংকিং প্রবর্তন, উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা ও বাংলাদেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবুজ ব্যাংকিং প্রবর্তন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকই প্রথম সবুজ ব্যাংকিংয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ছয় বছরে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন পূরণের ধারাবাহিকতায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড ও পেপারলেস প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সকল ব্যাংকিং কার্যক্রম, তথ্য সংগ্রহ, নিয়োগ, টেন্ডার, এক্সেস কন্ট্রোল সবই করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড করতে হাতে নেয়া হয়েছে নানা কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব কার্যক্রম প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’এর সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত অনেক বেশি ভাল অবস্থানে রয়েছে। মোবাইলে লেনদেনের মাধ্যমে দেশী ব্যাংকগুলো এখন ভালভাবেই এগুচ্ছে। এসব সম্ভব হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বশীল ভূমিকার কারণে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। তবে সেগুলো ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে শক্ত ব্যাংক হিসাবে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে ব্যাংকিং খাতও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তিনি মনে করেন ব্যাংক ঋণের সুদের হার একক অঙ্কে নামিয়ে আনা উচিত। এটা এখন গোটা ব্যবসায়ী সমাজের দাবি। ইতোমধ্যে ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেছে। তবে কিছু কিছু ঋণের সুদের হার এখনও একটু বেশি। বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ঋণের সুদ কমিয়ে আনার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন। দেশের সমগ্র ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালের পহেলা মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর হিসেবে নিয়োগ পান অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। ৩ মে তিনি গবর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে কার্যকালের ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ে তিনি প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতে ঋণ সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছেন। সতর্ক ও সংযত কিন্তু উৎপাদনবান্ধব মুদ্রা ও আর্থিক নীতি দ্বারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে, টাকার বৈদেশিক মূল্যমান জোরালো রেখে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি এনে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি মন্দার পরিবেশেও গড় বার্ষিক ছয় শতাংশের বেশি প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক অবদান রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার বলেন, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংককে অংশগ্রহণমূলক, মানবিক ও সবুজ ব্যাংকিং উপহার দিয়েছেন গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি দেশের আর্থিক খাতে ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং কাঠামো আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেছেন। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, কঠোর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক সুশাসন নিশ্চিত করার নজরদারি জোরদার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণেই ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফরিদ উদ্দিন বলেন, আগের তুলনায় ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকাংশেই শক্তিশালী হয়েছে। গত ছয় বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারভিশনেও আনা হয়েছে কৌশলগত পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়া। ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা কাঠামো শক্তিশালীকরণ, সঞ্চিতি কাঠামো পুনর্নির্ধারণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা মডেল শক্তিশালীকরণ, স্ট্রেস টেস্টিং কৌশল প্রবর্তন এবং তথ্য প্রকাশে অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যে আইনী, নিয়ন্ত্রণমূলক ও তদারকী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক দুর্নীতির উদ্ঘাটনে জোরদার সুপারভিশনের ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্যাংকিং খাতকে দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও এসএমইসহ উৎপাদনমুখী খাতগুলোতে অর্থ যোগানে বিভিন্ন সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা একটি স্থিতিশীল ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
×