ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৬ মে ২০১৫

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত,  আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, হাতে গোনা দু-তিনটি পত্রিকা ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো দেখেনি। ৫ মে’র পর আজ পড়ুন ... ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে যে নির্যাতন চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে নির্মূল কমিটি প্রকাশিত, শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ৩ খ-ের দু’হাজার পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে। উৎসাহী পাঠক দুষ্প্রাপ্য এই খণ্ড তিনটি দেখে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, প্রথম দিকে এই অত্যাচারের কথা বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে জনকণ্ঠ, সংবাদ ও ভোরের কাগজে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য পত্রিকার মূলত ভাষ্য ছিল, কিছু হাঙ্গামা হয়েছে বটে তবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে শাহরিয়ার, সাবের চৌধুরী ও আমাকে গ্রেফতারের পর যখন অ্যামনেস্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিবাদ হওয়া শুরু করল, তখন ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে থাকে। এমনকি মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান আমাদের গ্রেফতার নিয়ে সরকারের সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় লেখেন। তখন থেকে ডেইলি স্টার নিয়মিত ঐ সব ভায়োলেন্সের ঘটনা প্রকাশ করেছে। যা হোক, শাহরিয়ার ও আমাকে যে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার কারণ, নির্বাচনের পরে দেয়া ঐ বিবৃতি। ঐ সময়ের আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটি পার্টিতে আমার সঙ্গে এক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার দেখা। নির্বাচনের পরপরই। তিনি আমার সমসাময়িক। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলেন, নির্বাচন কেমন হয়েছে। তিনি আমাকে বিএনপিবিরোধী হিসেবেই জানেন। সঙ্গে আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। আমি বললাম, আপনি তো সবই জানেন। এই দেখেন আমার হাতে আপনার অফিসারের লাঠির দাগ। একজন কর্মকর্তা ত্বরিত বললেন, আপনি তো এমন বলবেনই। নির্বাচন চমৎকার হয়েছে। আমার সমসাময়িক কর্মকর্তা ঐ অফিসারকে থামিয়ে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ পাড়লেন। আমি তাদের বললাম, একটা কথা বলি। আপনি তো চিরজীবন এই পদে থাকবেন না। অবসর নেয়ার পর যখন একজন ক্যাপটেন আপনাকে লাঠির বাড়ি দেবে, তখন বুঝবেন আমি কী কথা বলতে চেয়েছিলাম। তিনি বুঝেছিলেন অবসরের পরে। সে অন্য প্রসঙ্গ। এর আগে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করি। আমার বাবা মিসবাহউদ্দিন খান দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হয়ে কচুয়ায়। এলাকাটি একদিকে মাদ্রাসা অধ্যুষিত, অন্যদিকে হিন্দু ভোটারও তুলনামূলকভাবে বেশি। সেই নির্বাচনেও হিন্দুদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি। অনেক জায়গায় জুলুমবাজি হয়েছে। কিন্তু ১৯৯০-৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির কুশাসন ও নির্বাচনী পরিস্থিতি দেখে আওয়ামী লীগ সর্বতোভাবে ভোট কেন্দ্র রক্ষার চেষ্টা করেছে। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি আওয়ামী লীগ। আমাদের এলাকায় সাচার ও আরেকটি কেন্দ্রের সমস্ত ভোট মাঠে গড়াগড়ি খেতে লাগল। পুকুরে ব্যালটবাক্স পাওয়া গেল। পরে মাঠে পাওয়া অনেক ব্যালটে দেখা গেছে নৌকার সিল। তারপরও সামান্য ভোটের ব্যবধানে আব্বা হেরেছিলেন। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন আবু হেনা। এই অভিযোগ গ্রাহ্য হয়নি। আওয়ামী লীগ এসব অনিয়ম সত্ত্বেও ফলাফল মেনে নিয়েছিল। কারণ, ঢালাও অভিযোগ করে নির্বাচন বাতিল চাইলে বিএনপিই লাভবান হতো। ২০০১ সালের পরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জেতার কোন সুযোগ ছিল না। এতো অত্যাচার, এতো কলঙ্ক বাংলাদেশের ওপর আর কেউ আরোপ করেনি। এরপর ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যেতে বিএনপি সব সময় অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং জিতেছেও প্রভূত পরিমাণে। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই গোলযোগ হয়েছে। কিন্তু বিএনপি যখন জিতেছে তখন কোন মিডিয়া বলেনিÑ সরকারের জয় হয়েছে, কারণ নির্বাচন প্রাতিষ্ঠানিকতা পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা যখনই জয়লাভ করেছে, তখনই জানানো হয়েছে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। সিলেট, গাজীপুরে নির্বাচনে বিএনপি জিতেছে। গাজীপুরে যথেষ্ট সহিংসতা হয়েছে, কিন্তু বিএনপি প্রার্থী জেতার পর নির্বাচন নাকচের কথা বিএনপিও বলেনি, মিডিয়াও বলেনি। ॥ ৫ ॥ তিনটি সিটি নির্বাচনের আগে হয়েছে জাতীয় নির্বাচন। ২০১৪ সালের এই নির্বাচনকে মিডিয়া কখনও মেনে নেয়নি। ১৫ জন সম্পাদিত পত্রিকা এখনও তা মানতে রাজি নয়। এই নির্বাচনকে তারা সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, একতরফা নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছে। জামায়াত-বিএনপি বা বাঙালী পাকিস্তানীরা নির্বাচনে না এলে তা একতরফা হবে কেন? বাঙালী পাকিস্তানীদের তো রাজনীতি করতে দেয়াই উচিত নয়। আমি জানি, এ মন্তব্য অনেককে ক্রোধান্বিত করবে মনের মধ্যে একটুকরো হেজাবি থাকার কারণে। জামায়াত তো নিষিদ্ধ ছিল। জিয়া অবৈধভাবে তা সিদ্ধ করেন। যাক সে প্রসঙ্গ- অন্যরা বা অন্যান্য দল কি নির্বাচনে যায়নি? অনেক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, অনেক আসনে তো হয়েছে। এর দায় কেন ১৪ দলের ওপর বর্তাবে? নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ডেকেছে, যার ইচ্ছা সে আসবে, জোর-জবরদস্তির তো কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু মিডিয়া বিষয়টিকে এভাবে দেখতে চায়নি, কারণ তা হলে তাদের মালিকদের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়। একটি ঘটনার উল্লেখ করি। বেনজীর ভুট্টো যখন বেঁচেছিলেন, তখন একদিন তার সঙ্গে ১৯৭০ সালের নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি আমাকে পাকিস্তানের ন্যারেটিভ শোনাচ্ছিলেন। যার মূল কথা হলো, নির্বাচন হয়েছে। শেখ মুজিব, ভুট্টো জিতেছেন। প্রেসিডেন্টকে তাদের সঙ্গে আলাপে ঠিক করতে হবে কী কী সমস্যা আছে। কারণ, মুজিব যেমন পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন, ভুট্টো তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। আমি বললাম, আপনি যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন, তখন কি প্রেসিডেন্ট সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে আপনাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। তা কেন হবে, জানালেন বেনজীর। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন ডেকেছে। আমরা নির্বাচনে গেছি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছি। তাই সংবিধান অনুসারে আমিই তো প্রধানমন্ত্রী হব। তা হলে, আমি জানাই, ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছিল। আমাদের এখানে প্রধান একটি দল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জয়লাভ করেছেন। প্রেসিডেন্ট সরাসরি তাঁকে নিয়োগ করলেন না কেন? তিনি কেন সংখ্যালঘিষ্ট পার্টির নেতার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেন এবং আলোচনায় ভুট্টো না মানলে কিছুই হবে না, এমন ইঙ্গিত কেন দিলেন? বলা বাহুল্য, বেনজীর এক মিনিট চুপ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এখানেও ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সব ব্যাপারে খালেদার [ও জামায়াত] সঙ্গে আলাপ করতে হবে। বাঙালী পাকিস্তানীর সঙ্গে আলাপ না করে বাংলাদেশে কিছুই করা যাবে নাÑ এটিই হচ্ছে মিডিয়া, মিডিয়াসংশ্লিষ্ট ও বাঙালী পাকিস্তানী বা আটকেপড়া বাঙালী-পাকিস্তানীদের মনোদর্শন। আসলে গোলাপী নেশা একেবারে হিরোইনের মতো। একবার ধরলে তাতে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত কী করেছিল, তা নিশ্চয় ভুলে গেছেন। মিডিয়া তো ভুলেছে বটেই। এখানকার মানুষজনের মিডিয়ার একটি অংশ বোধহয় ডাইনোসরের মতো, যার কিছুই মনে থাকে না। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনে বাধা দেয়ার জন্য সারা বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আওয়ামী লীগ কর্মীসহ সাধারণ অনেক মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। একই কায়দায় হিন্দু নারী ও হিন্দুদের টার্গেট করা হয়েছিল। সাতক্ষীরা তো বিএনপি-জামায়াতের মুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। গাইবান্ধাও। সাতক্ষীরায় আমি নিজে গিয়ে দেখেছি কী ভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খুন করা হয়েছে। মিডিয়া এটিকে সন্ত্রাসী কর্মকা- হিসেবে বিবেচনা করেনি। বিবেচনা করেছে ভোটের অধিকার প্রবর্তনের আন্দোলন হিসেবে। এত বড় আত্মপ্রবঞ্চনার উদাহরণ খুব কম। সারা বিশ্ব দেখেছে কী হয়েছে। যে কারণে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরে সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। মার্কিন কংগ্রেসেও জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এখানকার মিডিয়া কি তা মনে করেছে? (চলবে)
×