ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৈঠা বাওয়া পালতোলা নৌকা

জীবন নদীর জোয়ার ভাটা- প্রাচীন ইতিহাসের ধারা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ মে ২০১৫

জীবন নদীর জোয়ার ভাটা- প্রাচীন ইতিহাসের ধারা

সমুদ্র হক ---------- বৈঠা বইয়ে স্রোত আর ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করে নৌকাকে এগিয়ে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এর আনন্দই আলাদা। অনুকূল স্রোতে শুধু হাল ধরে থাকলেই হলো। প্রতিকূল স্রোতে বৈঠা বাওয়া যে কত কঠিন তা অভিজ্ঞ মাঝি ভাল বলতে পারেন। ঢেউ সামলাতে না পারলেই বিপদ। একজন দার্শনিক নৌকা বওয়াকে উদাহরণ দিয়েছেন প্রতীকীভাবে জীবন নদীর জোয়ার ভাঁটার সঙ্গে। প্রতিকূল স্রোতে যে মাঝি তরীকে তীরে ভিড়িয়ে পাড়ে উঠতে পারে সেই তো সফল, এমন কথাও বলেছেন তিনি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে নৌকা। নিকট অতীতে এ দেশে অন্তত ২০ ধরনের নৌকা ছিল। একেক অঞ্চলের নৌকার ধরন একেক রকম। চট্টগ্রাম কক্সবাজার অঞ্চলের সাম্পানের (নৌকা) সঙ্গে উপকূলীয় এলাকার নৌকার কিছুটা মিল আছে। দক্ষিণাঞ্চলের বজরা ও গয়না নৌকার সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নৌকার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। উত্তরাঞ্চলের ডিঙি নৌকা ও ছোট নৌকার ধরন আলাদা। তবে বাইচের নৌকা সব জায়গায় একই রকম। ২৫ থেকে ১শ’ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যরে ও ৩ থেকে ৫ মিটার প্রস্থের হয়। অন্তত একশ’ লোক এই নৌকায় উঠতে পারে। বড় বৈশিষ্ট্য হলো, বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতি মিশে আছে এই নৌকাকে ঘিরে। নদীর দেশে প্রতিটি অঞ্চলে মানব প্রেমের অকৃত্রিম ভালবাসা বয়ে আনে এই নৌকা। বাইচের সময় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কাঁসা বাজিয়ে দ্রুত লয়ে নৌকার বৈঠা বাওয়া জীবন চলার গতিকেই তুলে ধরে। শীত মৌসুম থেকেই নৌকা বানানোর হিড়িক পড়ে। তা ঠেকে গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার আগে। সাধারণ নৌকা বানাতে খরচ পড়ে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এর চেয়ে বড় নৌকা (ব্যবসায়ীদের নৌকা) তৈরির খরচ এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। নদী পাড়ের মানুষের জীবনের বড় সম্বল তো নৌকা, দেশের মানুষের কাছেও এই নৌকা জীবন চলার অংশ। একটা সময় নদীর তীরে থাকত খেয়া ঘাট। বটের ছায়ায় মাচাং পেতে বসে থাকত খেয়া ঘাটের মাঝি। কাছেই থাকত ঢুলিদের আবাস। উৎসব পার্বণে নৌকায় চেপে ঢাকির বাদ্যের তালে মাঝ নদীতে গিয়ে আনন্দ ধারায় মেতে উঠত দশ গাঁয়ের মানুষ। প্রাচীন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নৌকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বাঙালী সংস্কৃতির জীবন ধারা। যুগে যুগে রচিত হয়েছে কত গান কত কবিতা। গয়না নৌকার গুনটানা (মোটা রশি ধরে তীর দিয়ে হেঁটে নৌকাকে টেনে নেয়া), বাতাসের ধাক্কা থেকে রক্ষা পেতে নৌকায় পাল তুলে দেয়া হয় (কোন অঞ্চলে পালকে বাদাম বলা হয়)। জোড়া নৌকা, বজরা নৌকা, কোষা নৌকা, বিক ও বালার নৌকাসহ নানা ধরনের নৌকায় সমৃদ্ধ এই দেশ। বেদে সম্প্রদায়ের জীবন কাটে নৌকায়। লোক কাহিনীর ময়ূরপঙ্খী নৌকাও আছে। ময়ূরের মুখের আকৃতির এই নৌকার প্রকৃত নাম সওদাগরি নৌকা। হালে নৌকার প্রাচীন ইতিহাস উদঘাটিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে পঞ্চগড়ের আমতলা গ্রামে করতোয়া নদী খননের সময় লম্বা এক নৌকা উদ্ধার করা হয় বালির নিচ থেকে। এই নৌকার বৈশিষ্ট্য হলো একটি মাত্র গাছ খোদাই করে কোন জোড়া ছাড়াই বানানো হয়েছে। দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ প্রায় আড়াই ফুট, গভীরতা ২১ ইঞ্চি এবং ব্যাস ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। এই নৌকার বর্ণনায় বলা হয়েছে প্রাচীনকালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীরা এ ধরনের নৌকা ব্যবহার করত। সম্ভবত উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলের লোক এই নৌকায় চেপে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের এই অঞ্চলে এসেছিল। নৌকার বয়স ৩শ’ থেকে ৮শ’ বছর। গেল বছর জুলাই মাসে দক্ষিণের কুয়াকাটায় বালির অনেক নিচে থেকে বের করে আনা হয় একটি বিরাট নৌকা। সমুদ্রের জোয়ারে ঝাউবনে বালু যখন ধুয়ে যায় তখনই ঐতিহাসিক নৌকাটি অস্তিত্ব মেলে ধরে। মাটি খুঁড়ে বের করে আনা হয় নৌকার কঙ্কাল। যার ওপরের অংশ নেই। দশ ফুট উচ্চতার ৭২ ফুট দৈর্ঘ্যরে ও ২৪ ফুট প্রস্থের এই নৌকাটি এখন প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের সংরক্ষণে। বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন এই নৌকা ওক গাছের কাঠে নির্মিত। একটির সঙ্গে আরেকটির জোড়া দেয়া হয়েছে পিতলের পাত দিয়ে। এই নৌকা নিয়ে মানুষের অনেক কৌতূহল। কারও মতে এটি পর্তুগীজদের ব্যবহৃত নৌকা। কেউ বলেন প্রাচীন এই নৌকা স্ক্রুনার জাহাজ (সমুদ্রপথে চলাচল করা ছোট পালতোলা জাহাজ)। প্রায় ৩শ’ বছর আগে প্রচ- ঘূর্ণিপাকে জাহাজটি ডুবে গিয়ে একটা সময় বালিচাপা পড়ে। প্রাচীন ইতিহাস এভাবেই সাক্ষ্য দেয়। ইতিহাসের এই ধারায় নৌকা নিয়েই বাঙালীর জীবন। যে ধারায় সুর ওঠে ‘নাও ছাড়িয়া দে রে মাঝি পাল উড়াইয়া দে...’।
×