ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাফর ওয়াজেদ

এত বড় রঙ্গ জাদু

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৪ মে ২০১৫

এত বড় রঙ্গ জাদু

প্রচার-প্রচারণায় প্রার্থীরা কেউ কারো বিরুদ্ধে একটি কটুবাক্যও উচ্চারণ করেননি, রাজনৈতিক বক্তব্যেও নয়। তারা নির্বাচিত হলে কী করবেন, সেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। নির্বাচনী প্রচারকালে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, মারদাঙ্গা, ক্যাম্প ভাঙ্গা, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাকার ঘটনাগুলো এদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে খুনোখুনির ঘটনা এন্তার। সমর্থকদের সংঘর্ষ শুধু নয়, প্রার্থী খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। আর ভোটের দিনের চিত্রও একই হাঙ্গামার, কোথাও কোথাও ঘটে আসছে। ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট, ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধাদান ইত্যাদি ঐতিহ্য হিসেবেই যেন প্রতিষ্ঠা পেয়ে আসছিল। নির্বাচন এলেই সন্ত্রাসী, মাস্তানদের কদর বাড়ত, অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যেত। দুই দু’জন সামরিক জান্তা শাসনকালে ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রয়োজন হতো না। মিডিয়া ক্যু, মার্শাল ক্যু’র মাধ্যমে প্রস্তুত করা ফলাফলেই ঘোষণা করা হতো। এই চর্চার রেশ নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর স্তিমিত হলেও মাঝে মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। গণরোষে কিংবা জনগণের সংঘবদ্ধতার কারণে ভোটের ফলাফল উল্টে দেবার দিন ফুরিয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের স্থানীয় আধিপত্যের কারণে ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা সত্ত্বেও বোমাবাজি, গোলাগুলি, মারামারির ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। নির্বাচন তখন একটা যুদ্ধে পরিণত হয়। ভোটযুদ্ধ আসলেই এক চরম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাঠে নেমে পরাজয়ের পূর্বাভাস পেলে অনেকে রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। সাহস তাদের লড়াই করার প্রেরণা হয়ে আসে না। তাই দেখা যায়, অনেকে যুদ্ধের বা খেলার ময়দান থেকে নানা খোঁড়া অজুহাত তুলে সরে যায়। তখন প্রতিপক্ষের গিবত গাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না। ২৮ এপ্রিলের তিন সিটি নির্বাচন ছিল এক শান্তির্পূণ নির্বাচন। প্রচারণাকালে বা ভোট গ্রহণের দিন একটি ভোটার বা প্রার্থীর সমর্থকদের আহত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়নি। কেউ কারো পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেনি, প্রচারণায় বাধা দানও করেনি। বরং এই প্রথম মেয়র প্রার্থীরা এক সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন শ্রোতা ভোটারদের সামনে। এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায়নি এদেশে। তারা সচেষ্ট ছিলেন অধিক সংখ্যায় ভোটারের কাছে পৌঁছাতে। প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার কাজ জড়িত বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, তারা জামিনও নেয়নি এবং পুলিশও তাদের গ্রেফতার করেনি। বোমাকারখানাসহ গ্রেফতার হয়েছে, কাউন্সিলর পদে এমন প্রার্থীও ছিল। জামিনে ছাড়া পেলেও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়নি। আত্মগোপনে থাকলেও তার সহযোগীরা প্রচারণা চালিয়েছে। কোথাও তাদের বাধা দিয়েছে, এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থককে হুমকি প্রদান বাংলাদেশের ভোটের ঐতিহ্য বটে। ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দেখা গেছে, প্রার্থীর নিজের এলাকার ভোটকেন্দ্রে প্রতিপক্ষের ভোটারদের না আসার হুমকি দেয়া স্বাভাবিক বিষয় যেন। ভোট লড়াইয়ের ময়দানে নামা প্রার্থী ও সমর্থকদের অবস্থা যেন বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।’ জালভোট দেবার প্রবণতাও পুরনো। কিন্তু ২০০৮-এর আগে জালভোটের যে সুযোগ ছিল, ভোটার আইডি কার্ড চালুর পর ভুয়া ভোটার যেমন নেই, তেমনি জালভোটের সুযোগও নেই। যদিও কোন কোন কেন্দ্রে অসাধু পন্থা অবলম্বনের খবর মেলে। তবে তা নামমাত্র। এই ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে, কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করতে। কেন্দ্রে ভোটার আসা বিরত রাখার জন্য বোমা ফাটানো হতো। মহিলাদের দিয়ে জালভোট দেবার ঘটনা নিয়ে অনেক গল্পগাথা রয়েছে এদেশেই। অন্য মহিলার হয়ে জালভোট দিতে গিয়ে স্বামীর নাম বলতে না পারার কত কাহিনীই আছে। এদেশের নির্বাচনে প্রার্থীর কর্মীদের ঝুঁকি নিতে হতো। ভোটের মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কত ধরনের কৌশলই অবলম্বন করতে হয়েছে। এসব কারণে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে শুরু করে খুনোখুনির ঘটনাও রয়েছে। খোদ ঢাকার লালবাগে প্রতিপক্ষের ৭ জনকে গুলি করে হত্যার নজিরও রয়েছে। আবার নির্বাচন কমিশনারও খুন হয়েছে। এসব ছাপিয়ে এবারের নির্বাচনে খুন বা হাঙ্গামার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। বরং এক ধরনের উৎসবের আমেজ ছিল। জনগণ সবসময়ই নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তার জীবনধারণে নির্বাচন কোন পরিবর্তন আনবে কি আনবে না, তার চেয়েও প্রার্থী পছন্দ করে ভোট প্রদানকে ভাবে তার একান্ত নিজস্ব অধিকার। যেখানে তার মতের, ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে অন্যের চাপে বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পছন্দ নয়, এমন প্রার্থীকেও ভোট দিতে হয়। ২৮ এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচনে উৎসবের ঘাটতি ছিল না। অত চমৎকার স্বস্তিদায়ক অভূতপূর্ব নির্বাচনী প্রচারণা অতীতে দেখা যায়নি। একজন ছাড়া মেয়র পদে সব প্রার্থীই ছিল নবাগত এবং তারুণ্যে ভরপুর। তাদের মধ্যে যে সহনশীলতা, উদারতা, সহযোগিতা দেখা গেছে পরস্পরের প্রতি, তাও নজিরবিহীন। রাজনৈতিক বক্তব্যেকে পাশ কাটিয়ে মেয়র প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকেই সামনে এনেছেন। যা অতীতে কখনো ঘটেনি। ভোটের দিনও সচিত্র পরিবেশ ছিল বেশ উৎসবমুখী। ভোট গ্রহণের প্রথম চারঘণ্টা প্রচুর ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, সে নিয়ে ভোটাররা খুব যে সরব ছিলেন, তা নয়। মেয়র প্রার্থীদের চেয়ে কেন্দ্রগুলোতে কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের সমর্থক কর্মীদের আধিপত্যেই বেশি ছিল। কাউন্সিলররা তৎপর ছিল ভোটার নিয়ে এসে তাদের পক্ষে ভোট প্রদানের আয়োজনে। রিকশা ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের যানবাহন চলাচল এবার বন্ধ রাখায় কোন কেন্দ্রেই সন্ত্রাসীদের আনাগোনা দেখা যায়নি। পাড়ার মাস্তানদেরকেও দেখা গেছে, ভদ্র, নম্রভাবে ভোটারদের দৃষ্টি আর্কষণে। ভোটদান সুষ্ঠুভাবে চলাকালে ঢাকার তিনটি কেন্দ্র কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। এই কেন্দ্রগুলোর ভোট গ্রহণসহ দুটি ওয়ার্ডের ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছে। এসব আসনে পুনরায় নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন যথাসম্ভব শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় এবং অনিয়ম রোধে সক্রিয় ছিল। এটা স্পষ্ট হয়, কোন কেন্দ্রেই গোলযোগে কেউ আহত না হওয়ায়। বচসা, ব্যালট সিল মারার মতো হাতেগোনা যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা পুরো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। ভোটগ্রহণের চারঘণ্টা পর বিএনপি জোট নির্বাচনটিকে রাজনৈতিক আদল দেয়ার জন্য এবং প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যেই বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোটযুদ্ধের ময়দান থেকে সরে দাঁড়ায়। পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে অপারগ বিএনপি-জামায়াত খোঁড়া অজুহাত তোলে যে, ভোট কারচুপি হচ্ছে এবং কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কেন্দ্রে কোন এজেন্টকে বের করা হয়েছে, তার তালিকাও তারা দিতে পারেনি। ঢাকার দুটি সিটির ১৯৯৩টি কেন্দ্রে যেখানে প্রতিটিতে রয়েছে ২০টি বুথ, সেখানে এজেন্ট প্রয়োজন ২০ হাজারের মতো। কিন্তু সেই এজেন্টদের মধ্যে অধিকাংশই কেন্দ্রে হাজির হয়নি। প্রচার রয়েছে, এজেন্টরা তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ নিয়ে গেলেও কেন্দ্রে আসেনি। তারা উৎসাহিত হলে, তবে হুমকির প্রশ্ন আসে। যারা উপস্থিত ছিল, বেলা ১২টায় বর্জন ঘোষণার পর তাদের অনেকে চলে যায়। তবে বিএনপি জোটের কাউন্সিলরদের এজেন্টরা যথারীতি ছিল। নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের দলীয় রাজনীতির অপছায়া উৎসবী পরিবেশকে বিঘিœত করেছিল সেদিন, সামান্য দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে। ভোটগ্রহণ শুরু হলেও বর্জন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সবপক্ষের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার অপমৃত্যু ঘটানো হয়েছিল পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই। বিশেষত, মেয়র পদের নির্বাচনটি যে আলোড়ন তৈরি করেছিল নগরবাসীর কাছে, তার সব আবেদনই যেন ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু এই বর্জনের পরও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে এসেছেন। বিএনপি মেয়র পদে বর্জন করলেও কাউন্সিলর পদ থেকে সরে দাঁড়ায়নি। যে কারণে দেখা যায়, বিএনপি ও জামায়াতের কাউন্সিলররাও নির্বাচিত হয়েছে। ভোটকেন্দ্র দখল হলে সরকারী দলের প্রার্থীর কাছে এদের হেরে যাবার কথা। কাউন্সিলদের মধ্যে সরকারী দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় রেষারেষি ছিল তীব্র কয়েকটি ওয়ার্ডে। অনেক ওয়ার্ডে ভোটের আগের দিন বিদ্রোহীরা সরে দাঁড়িয়েছিল। এমন প্রচারও কিছু কেন্দ্রে আলোকচিত্রীরা ব্যালটে সিল মারার জন্য কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে তার চিত্র গ্রহণ করে প্রচার করেছে। কর্মীরা তাদের এই মনোবৃত্তি সম্ভবত বুঝতে পারেনি। তবে যেসব কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে, তা সরকারী দল প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। তবে কোন সন্ত্রাস সংঘর্ষ বা হানাহানির ঘটনা ঘটেনি। যা অতীতে ছিল স্বাভাবিক প্রায়। বিএনপির বর্জনের পরও ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি, অবশ্য নির্বাচনের যে পরিবেশ ছিল, তাতে ধারণা করা হয়েছিল কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ ভোট পড়বে। তাদের সরে আসায় ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে ভোট প্রদান অর্ধ শতাংশের বেশি যেতে পারেনি। অথচ অতীতের ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশের মতো কিন্তু মেয়র পদে কারচুপি বা জালভোট না পড়লেও ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতির কারণে তিন সিটিতে বিএনপি-জামায়াত জোট ৯ লাখ ভোট পেয়েছে। যা অভাবনীয়। ভোট গ্রহণের একদিন আগে বেগম জিয়া নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের, যেন তারা ভয় না পেয়ে সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার পর ফলাফল ঘোষণা না করা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্র পাহারায় থাকেন। এমনকি ভোটের ফল বুঝে নেবারও পরামর্শ দেন। কিন্তু তার এই নির্দেশ কার্যকর হতে হতেই তিনি মাঠ ছেড়ে গেলেন। ভয়হীন পরিবেশকে ভয়ার্ত করে তুলতে সচেষ্ট হলেন। কিন্তু পুরো সিটিতে তেমন কোন অবস্থাই তৈরি হয়নি। বিএনপি যে জয়লাভের জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তা পরিষ্কার জলের মতোই স্বচ্ছ। তিন মাসের অপকর্ম থেকে সরে আসার একটা পথ পেলেও ঘুরে ফিরে আবারও জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের দিকে ধাবিত হতে চাইবে, নির্বাচনে জঙ্গীদের ব্যবহার করার কোন পরিকল্পনা থাকলেও তাতে যে সুবিধা হয়নি, তার কারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যে কারণে বোমাবাজি, গোলাগুলির সুযোগ ঘটেনি কোন পক্ষেরই। সহিংসতা, নাশকতার প্রকাশও ঘটতে পারেনি। সহিংসতাকে আশ্রয় করে বিগত কয়েক বছর কাটিয়ে দেয়ার পরও বিএনপির পক্ষ যতই মিডিয়ার সমর্থন থাক না কেন, স্বাভাবিক রাজনীতির পথে ফিরে আসার দুষ্কর, যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত এবং সহযোগী হেফাজতের চাপের কারণে। অবশ্য বিএনপি এই দুটি দলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তাদের স্বার্থ দেখাটাই বিএনপির প্রধান কাজ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম জিয়া যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তা মাঠে মারা গেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে গাড়ি বহর নিয়ে প্রচারণাকালে তিনি ক্ষুব্ধ জনতার মুুখোমুখি হন কয়েকদফা। তার গাড়িবহর ভাংচুর করা হয়। একে কেন্দ্র করে তিনি তাকে হত্যার প্রচেষ্টা বলে আলোড়ন তুলতে চেয়েছিলেন। কতিপয় মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার সত্ত্বেও তা ধোপে টিকেনি। কারণ তার গাড়ি বহরের নিচে যুবকের চাপা পড়া, তার নিরাপত্তা রক্ষীর ক্ষুব্ধ জনতার প্রতি গুলিবর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হবার পর তিনি চুপসে গেছেন। ভোট গ্রহণের একদিন আগে বলেছেন, বিএনপি টেস্টকেস হিসেবে এই ভোটকে নিয়েছে। নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে প্রতিশোধ নিতে বলেছিলেন ভোটারদের। প্রতিশোধ শব্দে তিনি বেশ প্রাণ ফিরে পান। ৯২ দিনের অবরোধ হরতালে পেট্রোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যা করে এক ধরনের প্রতিশোধ নিয়েছেন। ভোটারদের ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিশোধ নেবার আহ্বানকারী বেগম জিয়া নিজেই নীরবে ভোটযুদ্ধ থেকে সরে গেছেন। এখানে তিনি সুবিধা করতে পারেননি। অত্যন্ত দুর্বলভাবে হলেও বেগম জিয়া এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন, যা তিনি আগেই ঘোষণা করেছিলেন। বলেছেন, নির্বাচন হতে যাচ্ছে সে সরকারের অধীনে, যারা ভোটারবিহীন নির্বাচনী প্রহসনে রাষ্ট্র ক্ষমতা কব্জা করেছেন। নির্বাচন হচ্ছে ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়, নির্বাচনী দায়িত্বপালনে রয়েছে দলীয়করণ করা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, সেটা প্রমাণ করতেই বিএনপি তার মেয়র প্রার্থীদের জবেহ করেছে। বর্জন না করলে তাদের দু-একজন প্রার্থী জেতার সম্ভাবনা কম ছিল না। বেগম জিয়া নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে নিজের দলের নেতা-কর্মী সমর্থকদেরই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন যে, দলটি নির্বাচনকে ভয় পায়। যে টেস্টকেস হিসেবে নির্বাচনকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, অর্থাৎ পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যার বিষয়টিকে চাপাদানের পথ ও পন্থা বের করতে, সেখানে তিনি নিজ দলের প্রার্থীদেরকেই বলি দিলেন। ফলে নির্বাচন বর্জনের জের ধরে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেয়া বিএনপি এবং যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত দিশেহারা প্রায়। বিএনপিতে ফাটল বাড়ছে তাই। দলের নেতৃত্বের প্রতি, কর্মসূচীর প্রতি ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, অনীহা ক্রমশ বেড়ে উঠছে। কর্মীরা যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ ছাড়া জনবিরোধী কর্মসূচী পালনে অনাগ্রহী হলেও বেগম জিয়া তা ধর্তব্যে নিচ্ছেন, তা নয়। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলার ক্ষমতা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, প্রতিপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়ানোর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রচারণা চালানোর মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে বোমা মেরে মানুষ হত্যার পর। আন্দোলন কিভাবে গড়তে হয়, সেপথ ও পন্থা বিএনপি আজো বুঝে উঠতে পারেনি। এমনকি নির্বাচনী প্রচার ও প্রচারণার স্বাভাবিক কৌশল হতেও একই কারণে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। তবে মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডায় সিদ্ধহস্ত দলটি। দিনকে রাত, রাতকে দিন বানাতে গোয়েবলসকেও হার মানায়। তাদের মিথ্যাচার নিয়ে মিথ্যার বেসাতি চালায় কথিত ‘সুশীল সমাজ’। তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, পেট্রোলবোমা মারা ও মানুষ হত্যার সঙ্গে তিনি ও তার দল জড়িত নয়। সবই সরকারী দলের কা-। আবার এও বলেছেন অবরোধ তিনি ডাকেননি, ডেকেছে ২০ দলীয় জোট। মিথ্যাকে কত সহজে সত্য বানান। ৫ জানুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের সামনে তড়িঘড়ি করে অবরোধের ঘোষণা দেন। খুব সহজেই সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করার পেটেন্ট রাইটস বেগম জিয়ার একান্তই নিজস্ব। তার অতীতের ভাষণগুলো হতে ভূরি ভূরি উদাহরণ দেয়া যায়। মিথ্যাচার তাকে অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে বেশিদিন তা ধোপে টেকেনি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় দিশাহীন নাবিকের মতো সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছেন স্রোতের বিপরীতে যেন। তাই নির্বাচনী খেলায় পরাজয়ের ভার বহন করার দায় এড়াতে বর্জন খেলায় মেতে উঠলেন। নির্বাচন ভ-ুল করার পরিকল্পনা যে ভেস্তে গেছে, তা টের পেয়েছেন পূর্বাহ্নেই, যেমন ঝড়-তুফান আগে টের পায় আরশোলা। তখন তারা দিগি¦দিক ছুটতে থাকে। বেগম জিয়াও বিদেশী প্রভুদের দ্বারস্থ হয়েছেন। বিদেশে লবিং কাজটি আপাত বেশ ভালই করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবও বেশ সরব। যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নির্বাচন হয়েছে, সে সবের অবস্থা সুখকর হয়নি। এমনকি ওনার অফিসের কাছাকাছি বাল্টিমোরে যে ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন। বান কি মুন একই সময়ে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গের পৌর নির্বাচনে খুন, হাঙ্গামা, মারদাঙ্গা, ভোটকেন্দ্র দখলসহ বহু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে ন্যূনতম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেননি। বিএনপি-জামায়াত জোটের বিদেশে লবিং পর্ব বেশ ভালই মনে হয়। বান কি মুন ভাষ্য তারই প্রতিফলন। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ব্যস্ত বিএনপি এখন বিদেশীদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছে। কত শত অভিযোগ, কত না প্রমাণপত্র নিয়ে তারা তাদের বিদেশী প্রভুদের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। বিদেশীরা উপদেশ খয়রাতেই সার। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদকে আপাত বর্জনের চাদরে ঢেকে বিদেশীদের কাছে নিজেদের পূতপবিত্র করে তোলার নাটকের এই পর্বে অর্জন হবে সামান্য। তবে তারা যাই করুক, সহিংসতা, নাশকতার জন্য ক্ষমা চাইতে হবেই। আর সরকারকেও এসবের বিচার করতে হবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়। যত রঙ্গই দেখাক না কেন বিএনপি জোট, জনগণ তার প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখাবে না। যদিও তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নয়। বিএনপির বর্জনের পরও ভোটগ্রহণ যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি নির্বাচিত হতে কারও জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন অপপ্রচারের মুখেও তাদের প্রতি অভিনন্দন থাকল। সবুজ ও মানবিক নগর গড়তে যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয়দানই তাদের কর্তব্য, যা জনগণ দেখতে চায়। আর তাতেই বিএনপি-জামায়াতের রঙ্গলীলার অবসান ঘটানো যাবে। [email protected]
×