ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড্রতেই জয়ের আনন্দ মিলল

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৩ মে ২০১৫

ড্রতেই জয়ের আনন্দ মিলল

মিথুন আশরাফ, খুলনা থেকে ॥ আশা ছিল যদি কোনভাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে ড্র করা যায়। তৃতীয় দিন শেষে যখন ২০৫ রানে এগিয়ে গেল পাকিস্তান, তখন ম্যাচ বাঁচানো নিয়ে ছিল শঙ্কাও। কেউ কি ভেবেছিল চতুর্থ দিনে এত সুন্দরভাবে ম্যাচে ফিরবে বাংলাদেশ? বাংলাদেশ শুধু ম্যাচেই ফিরল না; ম্যাচ ড্র করেই ছাড়ল। তামিম-ইমরুলের রেকর্ড ৩১২ রানের জুটিতে ম্যাচ ড্র হলো। আর সেই ড্র’র পর যেন জয়ের মতো আনন্দে মাতল বাংলাদেশ। ড্র’তেই জয়ের আনন্দ মিলল। আনন্দ, উৎসব তো হবেই। প্রথম দিন ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ছিল সমানে-সমান। দ্বিতীয় দিনে গিয়ে প্রথম সেশনেই বাংলাদেশের ইনিংসে ছন্দপতন ঘটে গেল। ৩৩২ রানেই অলআউট হয়ে গেল বাংলাদেশ। এর জবাব দিতে নেমে দ্বিতীয় দিনে যে একচেটিয়া পাকিস্তান আধিপত্য বিস্তার করল এবং তৃতীয় দিনে গিয়ে ২শ’ রানের বেশি এগিয়ে গেল; সেখানেই একটু আতঙ্ক তৈরি হলো। কিন্তু চতুর্থ দিনে গিয়ে খেলা আবার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। ৬ উইকেট নেয়া তাইজুল ইসলামের স্পিন বিষে ৬২৮ রানে অলআউট হয়ে গেল পাকিস্তান। হাফিজের ২২৪ রানে বাংলাদেশের বিপক্ষে সর্বোচ্চ স্কোর করল পাকিস্তান। বাংলাদেশ থেকে ২৯৬ রানেও এগিয়ে গেল। সবার ভেতর শঙ্কা শুরু হয়ে গেল। পারবে বাংলাদেশ এ রান অতিক্রম করে ম্যাচটাকে বাঁচাতে? তবুও আশা ছিল বিশেষ কিছু ঘটেও যেতে পারে। চতুর্থ দিন দেখা গেল বাংলাদেশের একটি উইকেটও নিতে পারল না পাকিস্তান! কী অসাধারণ ব্যাটিং করলেন দুই সেঞ্চুরিয়ান তামিম-ইমরুল। চতুর্থ দিন শেষে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে যে ২৭৩ রান জমা হলো, তাতে একটি উইকেটও হারাল না বাংলাদেশ। ২৩ রানে পিছিয়ে থেকেই পঞ্চম দিন শুরু করল বাংলাদেশ। তামিম ১৩৮ ও ইমরুল ১৩২ রানে ব্যাট করতে নামেন। সেখান থেকে যখন দল ৩১২ রানে পৌঁছে ১৬ রানে এগিয়ে গেল তখন উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গল। এর আগেই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ১৫০ রান করল ইমরুল। আর দুই বাঁহাতি ওপেনার মিলে গড়লেন সবচেয়ে বড় জুটির রেকর্ড। এরপর মুমিনুল মাঠে নামলেন। ১ রানও করলেন। তামিমের ব্যাটে তখন ১৫৯ রান। এমন সময় বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে প্রথম সেশনও শেষ হলো। বাংলাদেশ এগিয়ে গেল ১৯ রানে। একটা সময় বৃষ্টি থামে। সেখান থেকে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট পর বৃষ্টি শেষ হতেই আবার তামিম-মুমিনুল ব্যাট হাতে নেমে যেই পাকিস্তান থেকে ৪৪ রানে এগিয়ে গেল, আবার বৃষ্টি নামল। এর আগে একটি অসাধারণ ঘটনাও ঘটল। প্রথমবারের মতো টেস্টে ছক্কা মারলেন মুমিনুল। ১৩ টেস্টে ২৪ ইনিংস খেলতে নেমে মুমিনুল কী ছক্কাটাই না হাঁকালেন। বাংলাদেশ যে কিভাবে পাকিস্তানকে চেপে ধরে রেখেছে, জুলফিকার বাবরের বলে লংঅন দিয়ে মুমিনুল হকের এ ছক্কাটিই যেন প্রমাণ বহন করল। বৃষ্টির জন্য ১০ মিনিট খেলা বন্ধ থেকে আবারও খেলা শুরু হলো। তামিম-মুমিনুল এগিয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু ৩৪৫ রানে গিয়ে মুমিনুল (২১) আউট হয়ে গেলেন। এরপর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ব্যাট হাতে দলের ৪৬৩ রানের সময় ৪০ রান করে আউট হওয়ার আগেই প্রথম টেস্ট সেরা ব্যাটসম্যান তামিম আউট হয়ে যান। আউটের আগে ক্যারিয়ার সেরা ২০৬ রানের ইনিংসের সঙ্গে দেশের হয়ে মুশফিকুর রহীমের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এক ইনিংসে দ্বিশতক রান করেন। মুশফিক অবশেষে মাঠে নামলেন। কিন্তু কাজ হলো না। রানের খাতা খোলার আগেই আউট হয়ে গেলেন। ৩৩ রান করে সৌম্য সরকারও আউট হলেন। ততক্ষণে দল ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় সেশনও শেষ হয়েছে। বাকিটা সময় সাকিব আল হাসান (৭৬*) ও শুভাগত হোম (২০*) মিলেই শেষ করলেন। যখন বাংলাদেশ ৬ উইকেটে ৫৫৫ রান করল, যেটা পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান; আর ২৫৯ রানে এগিয়ে গেল টাইগাররা। তখন ২৫ মিনিট খেলার সময় বাকি থাকলেও সমঝোতায় দিন শেষ হলো। বাংলাদেশ ৮ টেস্টে টানা পাকিস্তানের কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর নবম টেস্টে এসে পাকিস্তানকে জিততে দিল না। ম্যাচ ড্র করল। ওয়ানডে সিরিজে একাধিপত্য বিরাজ করে রাখে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ‘বাংলাওয়াশ’ করে। এরপর একমাত্র টি২০ ম্যাচেও জয় তুলে নেয় টাইগাররা। দুই টেস্টের প্রথমটিতে খেলতে নেমে প্রথম দিনে নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি বাংলাদেশ; কিন্তু দ্বিতীয় দিনে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশে সিরিজ খেলতে এসে প্রথমবারের মতো কর্তৃত্ব দেখাতে পারল পাকিস্তান। তৃতীয় দিনেও একক আধিপত্য করেছে পাকিস্তান। মোহাম্মদ হাফিজের ২২৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে তৃতীয় দিনেও কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখল পাকিস্তান। চতুর্থ দিন আসতেই পুরো চিত্রই পাল্টে গেল। ৩৪ রানেই ৫ উইকেট হারাল। এরপর শুরু হলো বাংলাদেশের ব্যাটিং। পরের চিত্র শুধুই বাংলাদেশকে নিয়ে আঁকা হলো। পাঁচ দিনের ম্যাচের পরের বাকি সময়টা শুধুই বাংলাদেশের হয়ে থাকল। যে কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়ে গেল তামিম-ইমরুলের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে, তা আবার ফিরিয়ে নিল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো বিশ্ব ক্রিকেট দেখল ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে দুই ওপেনারই ১৫০ রান করল। ইতিহাস গড়লেন তামিম-ইমরুল। শুধু কী তাই, তামিম-ইমরুল যখন ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে ৩০০ রানের জুটি গড়লেন, প্রথম উইকেটে এ রানের জুটি বিশ্ব ক্রিকেটেই ছিল না! এ দুইজন তাই করে দেখালেন। ১৯৬০ সালে কলিন কাউড্রে ও পুলারের উদ্বোধনী জুটিতে করা ২৯০ রানকে অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়লেন। অবশেষে ৩১২ রানে মিডঅনে আউট হয়ে যান ইমরুল। আউট হওয়ার আগে টেস্ট ক্যারিয়ারের তৃতীয় ও টানা দ্বিতীয় ম্যাচে শতক করেন ইমরুল। টানা চার ম্যাচের তিনটিতেই আবার শতক করেন; ২০ টেস্টে ২৬.৭২ গড়ে এক হাজার রান পূর্ণ করেন ১০৬৯ রান করা এই ওপেনার। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে নামার আগে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ। নবেম্বরে চট্টগ্রামে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে উদ্বোধনী জুটিতে যে ২২৪ রান যোগ করেছিলেন তামিম-ইমরুল, সেটিই পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টের আগে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটিতে সর্বোচ্চ রান ছিল। সেই টেস্টেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুই ওপেনারের শতক দেখেছিল। টানা দুই টেস্টে এবারও দুই ওপেনারকেই শতক রান করতে দেখল বাংলাদেশ। এ জোড়া শতক এবার যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা জুটিরই দেখা মেলাল। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে পঞ্চম উইকেটে ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মুশফিকুর রহীম ও ১৯০ রান করা মোহাম্মদ আশরাফুল ২৬৭ রান করেছিলেন, যা এতদিন যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল, তা ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়লেন তামিম-ইমরুল। ইমরুল ১৫০ রান করে আউট হয়ে গেলেন। তবে তামিম ঠিকই ব্যাট হাতে উইকেট আঁকড়ে থাকলেন। শেষপর্যন্ত ডাবল শতকও করলেন। দুইজনের অসাধারণ ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশও ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে সর্বাধিক রান করল, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ড্র করতে পারল। হারের শঙ্কায় পড়ে যাওয়া টেস্ট ড্র করায় জয়ের আনন্দই মিলল।
×