ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বজ্রের আঘাতে আহত এখন বিএনপি নেতাকর্মী!

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩ মে ২০১৫

বজ্রের আঘাতে আহত এখন বিএনপি নেতাকর্মী!

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গত ৬ জানুয়ারি থেকে তিন মাসেরও বেশি সময় লাগাতার অবরোধ এবং মাঝপথে কখনও ২৪ ঘণ্টা কখনও ৪৮ ঘণ্টা আবার কখনও ৭২ ঘণ্টার হরতাল, আবার কখনও এলাকাভিত্তিক হরতাল দিয়ে সফলতার ঘর শূন্যই থেকেছে। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কিছু কাউন্সিলর পদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনের দিন মাঝ সময়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে আরও একটি শূন্য যোগ হয়েছে। গত চার মাস সময়ে দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অপরাজনীতি ও সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘটনায় দেশের রাজনীতি সচেতন মহল রীতিমতো হতবাক ও বিস্মিত। লাভের হিসাবের খাতা বরাবরই শূন্য থাকায় এ যেন বিএনপির ওপর শনির দশার ভর। গত চার মাস সময়ের বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দেশজুড়ে নাশকতামূলক কর্মকা- ও পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যাযজ্ঞের ঘটনাবলীর পর বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষ ও সচেতন রাজনৈতিক মহলগুলো একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ তেমনি অপরদিকে তাদের রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ। এমনি অবস্থায় গত ২৮ এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি এ নির্বাচনে তাদের প্রার্থিতা সমর্থন দিয়ে অপরাজনীতি থেকে সরে আসা এক্সিট পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছিল বলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের ধারণা। কিন্তু সিটি নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণের মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে তাদের সমর্থিত তিন মেয়র প্রার্থীদের দিয়ে নির্বাচন বর্জনের আকস্মিক ঘোষণাটি রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছেই শুধু নয়, বিএনপির সমর্থকগোষ্ঠীর মাঝেও বজ্রাঘাত সমতুল্য হয়েছে। খোদ খালেদা জিয়াসহ নিজেরা এ নির্বাচনে নেমে এবং তাদের নেতাকর্মী সমর্থকদের মাঠে নামিয়ে ভোটের দিন হঠাৎ করে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা রীতিমতো একটি হাস্যকর ঘটনায় পরিণত হয়েছে। মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এবং পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ধোপে টিকছে না। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তিন সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের বর্জনের ঘোষণা এলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ঠিকই শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন এবং এতে তিন সিটিতে বিএনপি সমর্থিত কিছু কাউন্সিলর জয়লাভও করেছেন। এছাড়া তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য শরিক দলগুলোর অধিকাংশ থেকে বর্জনের কোন ঘোষণা আসেনি। তিন সিটি নির্বাচনে জামায়াত কোন মেয়র পদে প্রার্থী যেমন দেয়নি, তেমনি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক সমর্থনও দেয়নি। তবে জামায়াত তিন সিটিতে কাউন্সিলর পদে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনে ছিল। তিন সিটিতে জামায়াত সমর্থিত ৫ কাউন্সিলর প্রার্থী জয়লাভও করেছেন। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি শুধু মেয়র পদে নাকি পুরো নির্বাচনই বর্জন করেছে? নির্বাচনের পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিএনপি নেতৃবৃন্দের পক্ষে এ নির্বাচনকে কারচুপি ও প্রহসনের রাজনীতি আখ্যায়িত করে পুনঃনির্বাচন দাবি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত যেসব কাউন্সিলর বিজয়ী হয়েছেন তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মেয়র প্রার্থীরা দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচনের মাঝপথে সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু তাদের কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচন করে কেউ কেউ জয়লাভও করলেন। বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন তারা কি করতে পারেন? দলীয় সিদ্ধান্ত মানলে তারাও নিশ্চয় নির্বাচন বর্জনের পক্ষে থাকবেন। আর যদি না থাকেন তা হতে পারে দলীয় সিদ্ধান্ত না মানার সমতুল্য। ইতোমধ্যে সিটি নির্বাচনের চার দিন অতিবাহিত হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে তিন সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েই ক্ষ্যান্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। তাদের এবং শরিক দল জামায়াত সমর্থিত বিজয়ী কাউন্সিলর প্রার্থীরা কি নিজেদের বিজয়কে বাদ দিয়ে গুটিয়ে নেবেন? রাজনীতিক বোদ্ধাদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, এক্ষেত্রে বিএনপির কোন বক্তব্য যেমন নেই, তেমনি কোন সিদ্ধান্ত আসবেও না। দেশের রাজনীতিতে বিজয়ী হলে সুষ্ঠু আর পরাজিত হলে কারচুপির অভিযোগ দীর্ঘসময় জুড়ে চলে আসছে। এক্ষেত্রেও এর কোন ব্যত্যয় হবার সম্ভাবনা নেই বলে প্রতীয়মান। সরকারবিরোধী আন্দোলন চালাতে গিয়ে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট লাগাতার অবরোধ ও হরতালের নামে মানুষ হত্যা, জ্বালাও পোড়াওসহ ধ্বংসাত্মক যেসব কর্মকা- ঘটিয়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন সুযোগ বিএনপির নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি যে খেসারত দিয়ে চলেছে তার অবসান না হতেই ২৮ এপ্রিলের তিন সিটি নির্বাচন শুধু তিন মেয়রদের মাধ্যমে বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে শূন্য ছাড়া আর কিছুই যোগ হয়নি। সিটি নির্বাচন বর্জন রীতিমতো জগাখিচুড়ির মতো। এ নির্বাচন বিএনপি ও তাদের ২০ দলীয় জোট প্রার্থী সমর্থন দিয়েছে। আবার নির্বাচনের দিন বর্জন করেছে শুধু মেয়র প্রার্থীরা। সঙ্গতভাবে লাগাতার অবরোধ-হরতালের পরও বিএনপি কোন সফলতা যেমন আনতে পারেনি, তেমনি সিটি নির্বাচনেও প্রশ্নবোধক বর্জনের ঘোষণা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক অর্জনের সফলতার ঘরটি শূন্যই রয়ে গেল বলে আলোচিত হচ্ছে। এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচনে সরকারী দল সমর্থিতদের জয় জয়কার হওয়ায় বিএনপির আগামী রাজনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। কেননা, তিন সিটিতে নির্বাচিত হয়েছেন সরকার সমর্থিত তিন মেয়র। নগর রাজনীতিতে মেয়রদের প্রভাব কোন অংশে কম নয়। বরঞ্চ একটু বেশি, যা বর্তমান সরকারদলীয় রাজনীতিকে বেগবান করতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে। বিষয়টি বিএনপি রাজনীতির জন্য মাইনাস পয়েন্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। এক্ষেত্রে ২০১৪ সাল থেকে বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট যে প্রক্রিয়ায় রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে এ দলটির ওপর শনির দশা ভর করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত। ’১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং গত ২৮ এপ্রিল দুই মহানগরীর তিন স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে শনির দশা বিএনপিকে ছাড়ছে না বলেই প্রতীয়মান। রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও আলোচনা চলছে, বিএনপি এ নির্বাচনে প্রার্থী সমর্থন দিয়ে এবং তাদের পক্ষে প্রচারে নেমে তাদের অতীতের ভুল রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেলেও ভোটের দিন মাঝপথে বর্জনের ঘোষণা দিয়ে আবারও আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সমতুল্য হয়েছেÑ যা ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন’ এর মতোই হলো বলে রাজনৈতিক সূত্রগুলোর পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হচ্ছে।
×