ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ৩ মে ২০১৫

আওয়ামী লীগ জিতলে গণতন্ত্র পরাজিত, আর বিএনপি জিতলে গণতন্ত্রের জয় !

বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে যেভাবেই জিতুক না কেন, তারা বিজয়ী হলে গণতন্ত্র রক্ষা পায়। যদি জেতে আওয়ামী লীগ, তাহলে পরাজিত হয় গণতন্ত্র। সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে তিনটি মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করলে অধিকাংশ সংবাদপত্রের শিরোনাম দেখে তাই মনে হতে পারে। নির্বাচনের পরদিন দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনাম- ‘জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র’; জামায়াতের মুখপত্র নয়া দিগন্তের শিরোনাম- ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব : বিএনপির বর্জন’। দৈনিক সমকালের শিরোনাম- ‘প্রশ্নবিদ্ধ ভোট, বিএনপির বর্জন’। শুধু তাই নয়, তাদের আরেকটি শিরোনাম- ‘বেপরোয়া জালিয়াতি’। আমাদের সময়ের শিরোনাম- ‘দখলে বর্জনে প্রশ্নবিদ্ধ’। দৈনিক যুগান্তরের শিরোনাম- ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব’। ইংরেজী পত্রিকাগুলোর শিরোনামও কমবেশি একই রকম। দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ এবং দৈনিক ভোরের কাগজের শিরোনামের সঙ্গে শুধু ওই ধরনের শিরোনামের মিল নেই। বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান যখন তার সম্পাদিত কাগজ দৈনিক আমার দেশ- এ বছরখানেক আগে জামায়াত-বিএনপির হিংসাত্মক কার্যকলাপ, খুন ও অগ্নিসংযোগ এবং জঙ্গীবাদের সমর্থনে মিথ্যা প্রচার করছিলেন তখন সরকার বাধ্য হয় তাকে গ্রেফতার করতে। এতে কিছু পত্রিকার সম্পাদক এত ক্ষুব্ধ হন যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এই জিগির তুলে তাঁরা সরকারের সমালোচনায় নেমে পড়েন। শুধু তাই নয়, ১৫ জন সংবাদপত্র মালিক কাম সম্পাদক এক যৌথ বিবৃতিতে ঐ গ্রেফতারের নিন্দা জানান। যেন সংবাদপত্রের কাজ হচ্ছে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা, খুন-জখম ও জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করা। যেন এগুলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্তর্গত। বর্তমানে একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে এই যে- সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সমালোচনা করা যাবে না। তারা কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়। তবে, হ্যাঁ, শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার সবার কাছে দায়বদ্ধ। খালেদা নয়। যে সব সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি চেয়েছিলেন, তাঁদের সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো আগে উল্লেখ করেছি। যে সব সম্পাদক স্বাক্ষর করেননি বিবৃতিতে, তাঁদের সংবাদপত্রের শিরোনাম ঐ রকম নয়। এর অর্থ বাংলাদেশের মানুষের মতো, সম্পাদক-মালিকরাও বিভক্ত। তাঁরা অসাধারণ কোন ব্যক্তি নন। তাঁদের বদ্ধমূল কিছু পূর্ব ধারণা আছে। ইংরেজীতে যাকে বলা যেতে পারে মাইন্ডসেট। বিদ্যুতায়িত মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল একই রকম। আমরা জানি, জেনারেল জিয়া বাঙালীদের যখন বিভক্ত করেছিলেন, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের লাইসেন্স প্রায় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান নয়, কে মালিক তা দেখে দেয়া হয়। বিএনপি-জামায়াত আমলে আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন এমন ব্যক্তি লাইসেন্স প্রায় পাননি। আওয়ামী লীগ আমলেও সেরকম। বিএনপি-জামায়াত মালিকানাধীন কোন পত্রিকা বা টিভিতে ২০০১ সালের নির্বাচন সম্পর্কে কখনই বলা হয়নি গণতন্ত্র পরাজিত হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ আমলে যে সব নির্বাচনে তারা জিতেছে, সে সময়ও বলা হয়েছে নির্বাচন সঠিক হয়নি, কিন্তু জনগণ পক্ষে থাকায় ফল ছিনিয়ে নেয়া যায়নি। আমাদের এখানে সুজন টাইপের যেসব ব্যক্তি আছেন বা এনজিও আছে, তাদের বক্তব্যও একই রকম। আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী বা ১৪ দল সমর্থক হিসেবে যারা লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁরা কিন্তু কখনও আওয়ামী লীগের কর্মকা- সমর্থন করেননি। তাঁদের ঝোঁকও কিন্তু খালেদাকে সমর্থন। বেগম জিয়া যখন ক্ষমতায়, তখন কিন্তু আওয়ামী আমলে লাইসেন্স পাওয়া কোন সাংবাদিক বা সম্পাদক খালেদার সঙ্গে খোশগল্প করতে পারেননি। খালেদা জিয়া কোন পত্রিকা/টিভির সাংবাদিককে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেন না, মানুষ হিসেবেও গণ্য করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনাকে তুলোধোনা করা ব্যক্তিবর্গ প্রায়ই দেখা যায় শেখ হাসিনার সঙ্গে খোশগল্প করার সুযোগ শুধু নয় মঞ্চে বসারও অধিকার পান। আমার এই প্রবন্ধের ভূমিকা বা বক্তব্য এই সব সংবাদপত্রের পাঠকদের বা যাঁরা বিপক্ষে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নেন তাঁদের সন্তুষ্ট করবে না, বরং একপেশে মনে হবে। আচ্ছা, তাহলে আরও দু’একটি উদাহরণ দিই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সমর্থক কিছু দুর্বৃত্ত যখন বিশ্বজিত নামে নিরীহ এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে, সে সংবাদ তখন মাসখানেকজুড়ে সংবাদপত্রের আলোচনার বস্তু ছিল। কয়েকটি বাদে সব টিভি এক সপ্তাহ কিছুক্ষণ পর পর এই দৃশ্য দেখিয়েছে এবং প্রায় মাসখানেক সংবাদ দৃশ্যমান রেখেছে। অন্যদিকে, হেফাজত জামায়াত বিএনপি যখন ঢাকা দখলের নামে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস, কোরআন শরীফ পোড়ানো, মানুষ হত্যা করে তার দৃশ্য কিন্তু এক সপ্তাহ কেন বার বারও দেখায়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে হেজাবীদের নৃশংস কর্মকা- কি টিভি দেখায়নি বা সংবাদপত্র ছাপেনি? ছেপেছে এবং দেখিয়েছে, কিন্তু ঐভাবে বার বার দেখায়নি, বরং উস্কানিদাতা মাহমুদুর রহমানের মুক্তি চেয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে বুয়েট কর্তৃপক্ষ বুয়েটের জামায়াতী শিক্ষক যখন আলবদর কামারুজ্জামানের ফাঁসি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছে এবং তার প্রতিবাদ করায় দু’জন ছাত্রলীগ নেতাকে আজীবন বহিষ্কার করেছেÑ তখন সে সংবাদ মাত্র একবার বা দু’বার ছাপা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক ঐ ব্যক্তি যে প্রকাশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন, তাঁর গায়ে ফুলের টোকাটিও পড়েনি। এ বিষয়ে কিন্তু কোন সংবাদপত্র ফলোআপ করেনি। আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, সংবাদপত্র বা টিভি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সমর্থন করেনি বা মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে ছিল। বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের অনেক অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা-কে তারা তুলে ধরেছে, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরেছে। এমনকি ২০০২ সালে সাবের হোসেন চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির বা আমাকে গ্রেফতার করলে অধিকাংশ সংবাদপত্র এর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু, আবার বিভিন্ন টক-শোতে মানবতাবিরোধী অপরাধকে লঘু বা বিতর্কিত করার জন্য আওয়ামী আমলে লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিভিগুলোই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বিএনপি যখন মানবতাবিরোধী অপরাধকে সমর্থন করে তখন কোন টিভি বা সংবাদপত্রে এমন শিরোনাম করা হয়নি যেÑ এটি পাকিস্তানী রাজনীতির সমার্থক। প্রকারান্তরে পাকিস্তানকে সমর্থন। বরং বিএনপিকে গণ্য করা হয়েছে গণতান্ত্রিকমনা বাংলাদেশমনা একটি বৃহৎ দল হিসেবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ যে সমর্থন করে সেও তো এর পক্ষে, এই সত্য তাদের কাছে সত্য মনে হয়নি। আমাদের আপত্তি সেখানে। যে সব পত্রিকার কথা উল্লেখ করলাম [নয়াদিগন্ত বাদে], সে সব পত্রিকার সম্পাদক কি মুক্তযুদ্ধের পক্ষের নন? তারা কি গণতন্ত্র সমর্থন করেন না? অবশ্যই এ সব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক অর্থাৎ তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তাঁরা বঙ্গবন্ধু হত্যারও প্রতিবাদ করেন। কিন্তু, একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার অগ্রপথিক ও গণতন্ত্র রক্ষাকারী বলে মনে করেন। আমরা মনে করি, বাধ্য হয়ে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং তারপর এর প্রায়শ্চিত্তকরণে বাংলাদেশের যা কিছু শুভ, তা ধ্বংস করেছিলেন, জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন, অন্তিমে আর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। পার্থক্যটা এখানেই। এবং আমাদের মানসিক সঙ্কটের উৎসও তা। এর মধ্যেই নিহিত আত্মপরিচয়ের সঙ্কট। বাঙালী না মুসলমান, না, মুসলমান বাঙালী না বাঙালী মুসলমান। আমার একটি মন্তব্য অনেকেই মনে করেন বাড়াবাড়ি। সেটি হলোÑ আমাদের প্রত্যেকের মনে এক টুকরো হেজাবী রয়ে গেছে, কখনও তা স্পষ্ট, কখনও অস্পষ্ট। পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে শুনলে কেন জানি একটু খারাপ লাগে। চাঁদতারা দেখলে কেন জানি ভাল লাগে। পাকিস্তানের কথা শুনলে মনটা কেন জানি উথাল-পাতাল করে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ জিতলে ভাল লাগে, কিন্তু পাকিস্তান হারলে খারাপ লাগে। ভারত হারলে ভাল লাগে। তাদের প্রতিনিধি বা তাদের রাজনীতির ধারক বিএনপি-জামায়াত বা হেফাজতের কর্মকা- তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য মনে না হলেও, একেবারে নিন্দা করতেও খারাপ লাগে। হেফাজত যখন দাবি করেছিল, তাদের হাজারখানেক মানুষ মারা গেছে, তখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো তা সমর্থন করেছে, টিভির টক-শোতে হেফাজতকে সমর্থন করা হয়েছে, যদিও সবাই জানত যে, তা মিথ্যা। যখন হিন্দু মেরে সাফ করে দেয়া হয়, হেজাবীরা লংকাকা- বাধায়, তখন কোন সুজনকে উচ্চস্বরে বক্তব্য দিতে শুনিনি। গত এক সপ্তাহের পত্রিকা দেখুনÑ এই সব সুজনরা কেমন সক্রিয়। ॥ ২ ॥ আমাদের এই মনোভঙ্গি যে আছে, তা বোঝাবার জন্য এত দীর্ঘ ভূমিকা দিতে হলো। আমি এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। কারণটি যে সঠিক, এমন সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো মেধা আমার নেই। কিন্তু, কারণটি যে বেঠিক, সেটি বলার মতো যুক্তিও খুঁজে পাই না। বাঙালী ইসলাম গ্রহণ করেছে অনেক দিন। কিন্তু, ইসলাম কী তা বুঝতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন এবং সেই অন্বেষা এখনও চলছে। জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, দেড়শ’ বছর আগে, যে, ঈদের দিন শীতলক্ষ্যার তীরে এক গ্রামের মুসলমানরা একত্রিত হয়েছেন নামাজ পড়বেন। কিন্তু, কিভাবে তা পড়তে হয় তা তাঁরা জানেন না। ঐ সময় নৌকা করে শহর থেকে এক মুসলমান যুবক যাচ্ছিলেন গ্রামে। তাঁকে থামানো হলো। তিনি জানতেন কিভাবে ঈদের নামাজ পড়াতে হয়। তিনি ইমামতি করলেন। আবুল মনসুর আহমদ বা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মজীবনী পড়লে আরও বিচিত্র সব তথ্য জানবেন। তাঁরা দু’জনই ময়মনসিংহের। আবুল মনসুর জানাচ্ছেন, বাঁশের চোঙ্গায় সকালে ফুঁ দিয়ে মনে করা হতো রোজা বন্ধ করা হলো। তারপর নিত্যদিনের কাজকর্ম। কৃষ্ণকুমার জানাচ্ছেন, মুসলমানরা গরু পূজাও করতেন। শরীয়তউল্লাহ ও দুদুমিয়া ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে ‘শুদ্ধ’ ইসলাম প্রবর্তনের ডাক দেন। কিন্তু সেটা বৃহত্তর ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর নানা সংস্কারক ইসলাম সংস্কারে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু লোকায়ত ইসলাম ও ওয়াহাবী ইসলামের দ্বন্দ্ব থেকে আমাদের মানস জগৎ মুক্তি পায়নি। মুসলমানত্ব আমাদের প্রকট হয়ে উঠতে লাগল মুসলিম লীগ হওয়ার পর থেকে; চল্লিশ দশকে তা ইসলাম বা মুসলমানের সমার্থক হয়ে উঠল। কংগ্রেসী কর্মকা- মুসলমানদের আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। বাঙালী মুসলমান যেভাবে মুসলমানত্ব গ্রহণ করেছিল, তা আর আগে কখনও করেনি। বাঙালী মুসলমানরা বলতেন, পাকিস্তান তাঁরাই এনেছেন। পাকিস্তান আমলেও পাকিস্তানই যে ইসলাম, এই বোধ আরও তীব্র করা হয় প্রচার মাধ্যমে, ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে। এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের শৈশবে ‘কায়েদে আযমের’ প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা তৈরি করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমাদের আচ্ছন্ন করেছিল। মুসলিম লীগ বা ‘ইসলামপন্থী’ দলগুলোই ছিল মূল ধারার রাজনীতির ধারক। এই রাজনীতির বিরোধীরা ছিল পাকিস্তান বা ইসলামের শত্রু। যখন আওয়ামী মুসলিম লীগ হয় তখন এটিকে ইসলামপন্থী মুসলিম লীগের বিরোধী একটি পক্ষ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠও এটিকে পছন্দ করেনি। আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতেও কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের কথা ছিল, কিন্তু তা কেউ আমলে নেয়নি। চাপা পড়ে গেছে সেই দাবি। আর রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টো পড়েই বা কয়জন? কিন্তু ঐ যে পাকিস্তান হওয়ার পর পর মুসলিম লীগের বিপরীতে এটি প্রতিষ্ঠা করা হলো, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ পছন্দ করেনি। এস্টাবলিশমেন্ট বা পাকিস্তানী শাসকরা তো নয়ই। সেই আওয়ামী লীগও ইসলামী রাষ্ট্র চেয়েছিল। কিন্তু জমিদারী প্রথা বিলোপ, তেভাগা গ্রহণ ও ‘পাকিস্তানের ইউনিটগুলো’র ‘আত্মনিয়ন্ত্রণ’ও চেয়েছিল। এস্টাবলিশমেন্টের কাছে এ সব দাবি গ্রহণযোগ্য ছিল না। মুসলিম লীগ সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করত, আওয়ামী লীগ [মুসলিম] শুরু থেকেই গরিবদের জন্য রাজনীতি করতে চেয়েছিল। ইসলাম চাওয়ার পরও এই সূক্ষ্ম তফাত শাসকদের চোখ এড়ায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের এক নীতিনির্ধারক আমাকে বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী এস্টাবলিশমেন্টের মূল উদ্বেগ ছিল, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদারী প্রথা বিলোপ করবে। নূরুল আমীন ১৯৪৯ সালের ৮ জুলাই ডেমরার এক জনসভায় বললেনÑ ‘এটা শুধুমাত্র মুসলমানদের দেশ। তবে সংখ্যালঘুরা আমাদের পবিত্র আমানত। মুসলমানদের রাষ্ট্র বলে একমাত্র মুসলিম লীগেরই অধিকার আছে শাসন করার। আমরা জেনেশুনে বৃহৎ বাংলা আন্দোলনের নেতাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে দিতে পারি না। কঠোর হস্তে ষড়যন্ত্র দমন করা হবে। আপনারা নতুন একটি রাজনৈতিক দলের নাম শুনছেন আজকাল। তারা হালে পাকিস্তানের দরদি হয়েছে। আমরা জানি তারা কারা।’ পাকিস্তানীদের এই একটি গুণ তারা জানে তাদের শত্রু কারা। এ গুণটি আওয়ামী লীগের নেই। হালের বিএনপি-জামায়াত বা হেজাবীরা জানে তাদের শত্রু কারা। আওয়ামী লীগ জানে না। যেমন, বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত অন্তিমে তাজউদ্দীন বা নজরুল ইসলামের চেয়ে খোন্দকার মোশতাককে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন। হালের একটি উদাহরণ দিই। প্রধানমন্ত্রী নববর্ষ উপলক্ষে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন ভোজসহ। এটি লোক দেখান কোন ব্যাপার ছিল না। তিনি সাংবাদিক-লেখক-শিল্পীদের পছন্দ করেন। আমি বলব, একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সত্যিই শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নন, ‘নেত্রী’ বা ‘আপা’ হিসেবে মেশেন। এবং আনন্দ পান। কারণ, এখানে রাজনীতির কূটকচাল নেই, এদের কেউ ক্ষমতায়ও আসক্ত নন। মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বললেন, যে দুঃখের কথা, গত কয়েকটা বছর যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আপনার সমালোচনা করেছে এবং প্রকারান্তরে হেজাবীদের সমর্থন করেছে আজ তাদের সঙ্গে আমাদের স্পেস শেয়ার করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা আপনাকে সমর্থন করেছি কারণ আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। আর এরা বা এদের পক্ষের মানুষজন আমাদের হুমকি দিয়েছে।’ শ্যামল দত্তের বক্তব্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রবল করতালি দিয়ে সবাই সমর্থন করলেন। অন্য কোন বক্তব্যের সময় করতালি শোনা যায়নি। এবং শ্যামল দত্ত মিছে কোন কথা বলেননি। তারা উচ্চাসনে ও নিচাসনে বসেছিলেন। এর অর্থ প্রধানমন্ত্রীর চারপাশে যারা আছেন বা যারা এই সব নিমন্ত্রণ বিলি করেন, তাদের মাঝেও একটুকরো হেজাবী বসবাস করছে। তো এই অসন্তোষ পরে ক্ষোভে পরিণত হবে। খালেদা জিয়া যদি এ ধরনের কোন সভা আহ্বান করেন, তাহলে কি মুনতাসীর মামুন আমন্ত্রিত হবেন না সৈয়দ আবুল মকসুদ আমন্ত্রিত হবেন না অধ্যাপক এমাজউদ্দীন হবেন? যা হোক, শত্রু চেনা, না চেনা নিয়ে কথা হচ্ছিল। পাকিস্তানীরা তখন থেকেই আওয়ামী বলে যে কোন জিনিস অপছন্দ করা শুরু করল। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগ হলে, সেই-ই প্রধান শত্রু হিসেবে পরিগণিত হলো। ১৯৫৪ সালের জয়লাভের কারণ, অত্যাচার এত চরমে পৌঁছেছিল যে, এস্টাবলিশপন্থীদের অনেকেও ক্ষুব্ধ ছিল। আর আওয়ামী নেতারা কৃষকদের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। ফজলুল হক ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন। তাঁদেরও একটা ইমেজ ছিল। কিন্তু সেই জয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। ঐ সময় যাঁরা ছিলেন যুক্তফ্রন্টে, পরে তাঁরা পাক-বাংলার কালচারের পক্ষে দাঁড়ান যেমন, আবুল মনসুর আহমদ। পাকিস্তানীরা এবং বাঙালী পাকিস্তানীরা শেখ মুজিবুর রহমান বা বঙ্গবন্ধুকে প্রথম থেকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ১১ বছর ছিলেন তিনি জেলে। ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী বা ভাসানী নন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই শত্রুকে দমন করতে চেয়েছেন পাকিস্তানী ও বাঙালী পাকিস্তানীরা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যখন ধরে নেয়া বঙ্গবন্ধু বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তখন ভোট পড়েছিল ৫৫ ভাগ, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ৭৫ ভাগ। ৪৫ ভাগ এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোট দেয়া প্রয়োজন মনে করেনি বা স্বাধীনতার জন্য তীব্র আবেগ বোধ করেনি বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল বা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা পছন্দ করেনি। বাকি ২১ ভাগের মধ্যে ১ ভাগ যদি বামপন্থীরা পায়, তাহলে ২০ ভাগই পেয়েছিল পাকিস্তানীরা। এই ৭৫ ভাগের মধ্যে সবাই পাকিস্তান ভাংতে চেয়েছিলেন, তাও তো নয়। শুদ্ধ বাঙালী আমরা ছিলাম ৪ বছর। ১৯৭৫ থেকে একটানা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যদি ধরেন, তাহলে ফের ২১ বছর আধা পাকিস্তানী শাসনে ছিলাম, এ কথা বললে কি অত্যুক্তি হবে? ১৯৭৫ সালে পুরনো ২০ ভাগের সঙ্গে যুক্ত হলো আওয়ামী বিরোধী ও বঙ্গবন্ধু বিরোধী রাজনীতিবিদ ও মানুষজন। সেই নিশ্চুপ ৪৫ ভাগের হিসাব আর করলাম না। পাকিস্তানী মানস ফিরিয়ে আনার জন্যই নিষিদ্ধ জামায়াত ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে একত্রিত করা হয়। যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেন, তারা ছিলেন সবাই পাকিস্তান প্রশিক্ষিত। পুরো সেনাবাহিনী এই হত্যা সমর্থন করেছে। এটি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি আমার লেখা ‘বাংলাদেশী জেনারেলদের মন’ নামক গ্রন্থে। এই ২১ বছর বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি শব্দগুলো যে নির্বাসিত ছিল, এ কথা অস্বীকার করবেন কিভাবে? যে সব পত্রিকার কথা উল্লেখ করেছি, তাদের সম্পাদকরাও তা অস্বীকার করবেন না। বিএনপি-জামায়াত তাদের সমর্থকদের চুরি-চামারির মাধ্যমে বিশাল আর্থিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। এই সব টাকার উৎস খেলাপী ঋণ। ইসলামের ভিত্তিতে, সেই পাকিস্তানী মানসের ভিত্তিতে একটি ‘শ্রেণী’ই গড়ে তোলা হয়েছে, যারা সরাসরি বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কনফেডারেশন না চাইলেও আওয়ামী লীগ চায় না। সেই পাকিস্তানী ঐতিহ্য মস্তিষ্কে এখনও খেলা করে। গত ৪০ বছরে এই সংখ্যা যদি ২০ ভাগও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তাহলে পুরনোর সঙ্গে মিলে এটি এখন ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ। অর্থাৎ বলতে পারেন এরা পাকিস্তানী বাঙালী বা অধ্যাপক আবদুল মান্নান যেমন বলেছিলেন আমাকে, ‘স্ট্রানডেড পাকিস্তানী’। আটকে পড়া পাকিস্তানী। এরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। জেনারেল মঈনের মিলিটারি আমলে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেফতার করা হয়, তখন তাদের অনেককে যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে প্রথম যে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা হলোÑ কি আওয়ামী লীগ করেন? আমাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন পুলিশ অফিসার প্রথম যে প্রশ্ন করেন তা হলোÑ আপনি কয়বার ইন্ডিয়া গেছেন? ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা জিজ্ঞেস করতেনÑ তোম মুক্তি হ্যায়, তোম আওয়ামী হ্যায়? সব ধরনের মিডিয়ার মালিক অর্থ করেছেন সেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। তাদের এক টুকরো ভালবাসা রয়ে গেছে বিএনপি-জামায়াতের প্রতি। এদের অনেকে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন। কিন্তু অন্তিমে এক পক্ষ বেছে নিতে হলে তারা আওয়ামী বিরোধীদেরই বেছে নেন। গোলাপী নেশায় তারা পাগল হয়ে যান। চারদিকে খালি গোলাপী শাড়ি দেখেন। আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল এখনও মুক্তিযুদ্ধের ধারক বা গণতন্ত্রের ধারক, এটি তাঁরা মানতে পারেন না। তাঁরা বিএনপি-জামায়াতকেও গণতন্ত্রের ধারক ও বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধের ধারক না হলেও বিরোধী মনে করেন না। আমেরিকা যেমন জামায়াতকে মনে করে মডারেট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। আর চামচা পুঁজি যে এখন বাংলাদেশের চালিকাশক্তি, তা কে না জানে। এই সম্পাদকদের সবাই চান আমেরিকা থাকুক। তফাৎটা এখানেই হয়ে যায়। এই বর্ণনা করলাম আমাদের ৪০ ভাগ প্রভাবশালী ও অপ্রভাবশালী নাগরিকদের মনোজগৎ বর্ণনা করতে। এটি হলো ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন। (চলবে)
×