ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গবর্নর হিসেবে ড. আতিউরের ছয় বছরপূর্তি আজ

মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১ মে ২০১৫

মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ হচ্ছে

কাওসার রহমান/রহিম শেখ ॥ দেশের অর্থনীতিতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অবকাঠামো খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে এই ফান্ড গঠন করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নরের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। গবর্নর হিসেবে অর্ধযুগ পূর্তির প্রাক্কালে দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান একথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘কেবলমাত্র পদ্মা সেতুই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। পদ্মা সেতুর মতো কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে ‘উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ক্লাবে’ যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ।’’ গবর্নর বলেন, অবকাঠামো খাতে বিমানবন্দর বা গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো দু’একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলেই দেশের প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের ওপর চলে যাবে। এক্ষেত্রে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের কোন অভাব হবে না। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে। রিজার্ভ থেকে কিছু অর্থ নিয়ে আমরা ‘সভরেন ওয়েলথ ফান্ড’ গঠন করছি। এই ফান্ড দিয়েই বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ফান্ড থেকেও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করা হবে। আজ শুক্রবার পহেলা মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনের ছয় বছর পূর্তি হচ্ছে আতিউর রহমানের। ২০০৯ সালের পহেলা মে বর্তমান সরকার তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। প্রথম মেয়াদ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করার পর এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে গবর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন। এই ছয় বছরে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকা-ে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতে ঋণ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছেন। প্রবৃদ্ধি সঙ্গে কোন আপোস না করে পরিবেশবান্ধব ও সমাজসচেতন উন্নয়নে পুঁজি সরবরাহ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যার কৃতিত্ব হিসেবে তিনি পেয়েছেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ গবর্নরের পুরস্কার। এছাড়াও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ‘এ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন (এএফআই)’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর বাইরেও পেয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রশংসা। নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষ করে দেশের পোশাক শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার সাফল্য হিসেবেই অর্জন করেছেন এ প্রশংসা। দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ছয়টি বছর আতিউর রহমানকে অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। ফলে এসেছে বেশ কিছু অর্জন। তাই চ্যালেঞ্জের মাঝেও অর্জনে তিনি তৃপ্ত। গত ছয় বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে গবর্নর বলেন, গত ছয় বছর সময়টা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তা সত্ত্বেও এ সময়ে এত মানুষকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছি এতে আমি তৃপ্ত। এই সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দা, পুঁজি বাজারের সমস্যা, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমাকে ‘ফাইট’ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, এই ছয় বছরে চ্যালেঞ্জ ও অর্জন একসঙ্গে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম, ১৩ হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ, প্রায় ৯০ কোটি টাকা এসএমই ঋণ বিতরণ, ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খুলে এক কোটি কৃষককে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসা, সবুজ ব্যাংকিং চালু, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বৈপ্লবিক প্রসার (আড়াই কোটি মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক সৃষ্টি); এক ধরনের লড়াই করে এগুলো অর্জন করতে হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল ব্যতিক্রমী ঘটনা। ফলে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমি তৃপ্ত। আতিউর রহমান এজন্য সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারপ্রধানের সরাসরি সহযোগিতা ও সব ধরনের সমর্থনের কারণে। আতিউর রহমান বলেন, অর্থনীতিতে এখন সুবাতাস বইছে। গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নতি হচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। বাড়ছে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি। রেমিটেন্স ও রফতানিতেও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে না, বরং কমছে। এটা স্থিতিশীল অর্থনীতির লক্ষণ। সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি কমছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভাল লক্ষণ। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক অবস্থানে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই এতে সফলতা এসেছে। চলতি অর্থবছর শেষে এই হার আরও কমে আসবে। তিনি বলেন, রাজনীতি এখন স্থিতিশীল আছে। আগামী দুই মাস এই স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে ছয় দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। কারণ অর্থনীতি এখন গতিশীল হচ্ছে। গবর্নর বলেন, অস্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগ কমে যায়। তাই আমরা অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্তি চাই। অর্থনীতির স্বার্থের বিষয়টি রাজনীতিকরা বুঝবেন বলে আশা করছি। গতিশীলতা সত্ত্বেও গবর্নর অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিনিয়োগ বাড়ানোকেই চিহ্নিত করেছেন। এ জন্য তিনি আগামী বাজেটে বড় ধরনের বিনিয়োগ আনার ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। এজন্য অবশ্যই সরকারকে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগ জিডিপির ২৮-২৯ শতাংশে স্থিতিশীল। প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের ওপর নিতে হলে এই বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে টাকার অভাব নেই। কিন্তু আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিভিন্ন উন্নয়মূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব বাধা আছে তা দূর করার তাগিদ দিয়ে গবর্নর বলেন, প্রয়োজনে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রশাসনে ‘বাস্তবায়ন ক্যাডার’ গঠন করতে হবে, যাতে প্রকল্প পরিচালকদের ঘন ঘন বদলির সুযোগ না থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্মকর্তাদের আরও বেশি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ৬ মাস মেয়াদে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) জোরদার করার তাগিদ দেন এই অর্থনীতিবিদ। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে গবর্নর বলেন, দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে রাজস্ব আদায় আরও বাড়াতে হবে। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ‘ডিজিটাইজেশন’ আরও দ্রুততর করতে হবে। ডিজিটাইজেশন সম্পন্ন হলে রাজস্ব আদায় বেড়ে যাবে। সম্পদ কর বৃদ্ধির কাজ চলছে। সম্পদ কর বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে। বাংলাদেশের উন্নতিতে বিশ্বব্যাংক প্রশংসা করেছে বলে জানান গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অবকাঠামো খাতে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া বাংলাদেশের যোগাযোগ খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে চায় দাতা এই সংস্থাটি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতেও সহযোগিতা ও বিনিয়োগ করতে চায় বিশ্বব্যাংক। বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে আশুগঞ্জ বিদ্যুত প্রকল্পে গ্যারান্টি দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের মেগা উইং। আরও দুটি প্রকল্পে গ্যারান্টি দিতে চায়। এতে দেশের সভরেন কান্ট্রি রেটিংয়ে আরও উন্নতি হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যে অস্বস্তি ছিল তা অনেকটা কেটে গেছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গবর্নর। এ খাতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক। নতুন করে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত সংস্থাটি। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের সহযোগিতা করবে এটা আমাদের প্রাপ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি নিরূপণে বিশ্বব্যাংক চিন্তাভাবনা করছে। তিনি বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এই দেশগুলোতে আমাদের এক্সচেঞ্জ হাউস করতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এখন ইতিবাচকভাবে বিষয়টি দেখেছে। প্রবাসীদের আয়ের বিষয়টি নিয়ে আমরা নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। প্রবাসীদের এই আয় দীর্ঘ মেয়াদে আমানত হিসেবে রাখতে ‘পেনশন স্কিম’ চালু করা হবে। এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেন গবর্নর। তিনি বলেন, আমাদের এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল আছে। যদিও ইউরোর বিপরীতে টাকার দাম বেড়েছে। তবে এতে উদ্বেগের কিছু নেই। কারণ ইউরোতে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ঋণপত্র খোলা হয়। বাকি ঋণপত্র খোলা হয় মার্কিন ডলারে। ইউরোর সঙ্গে টাকার মান বাড়ায় বরং আমদানি ব্যয় কমেছে। অন্যদিকে বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। ব্যাংকের সুদের হার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে সুদের হার কমে আসবে। তবে ইতোমধ্যে বেসরকারী খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। সামনে সুদের হার আরও কমে আসবে। বাজারকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। মূল্যস্ফীতি কমায় সুদের হার এমনিতেই কমে আসবে।
×