ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিরীন আখতার এমপি

রানা প্লাজা ও ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১ মে ২০১৫

রানা প্লাজা ও ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড

গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ রানা প্লাজার ক্ষত শুকানোর চেষ্টা করছে। আমরা তাজরীনের আগুন আতঙ্ক ভুলতে চেষ্টা করছি। এ রকম দৃশ্য আর কেউ দেখতে চায় না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই এই অমানবিক দৃশ্য দেখতে চায় না। সেখানে বিভিন্ন উদ্যোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি। পোশাক ক্রেতারা বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে একর্ড ও এলায়েন্স নামে দুটো সংগঠন তৈরি করেছে। তারা বছরব্যাপী বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে, তার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ দালান-কোঠা চিহ্নিতকরণ এবং তার ব্যবস্থা নেয়া। অন্যদিকে কারখানা শ্রমিক ও মালিকদের দুর্ঘটনা সম্পর্কে সচেতন করা, দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে সক্ষম করে তোলা, দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। এসব কিছুর মধ্যে জ্বলন্ত যে প্রশ্নটি তা হচ্ছে, শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? একজন শ্রমিক যে কোন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে তার ক্ষতিপূরণ কী হবে? এই ক্ষতিপূরণের সর্বোচ্চ ও সর্বনি¤œ সীমা নির্ধারণ এবং অর্থপ্রাপ্তির বিষয়ে এখনও মালিক-শ্রমিক-সরকার একমত হতে পারেনি। শ্রমিকের বন্ধু হিসেবে ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন পর্যায়ে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন। রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় অনেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের এই সহায়তার অর্থের সঙ্গে শ্রমিকের আইনগত অধিকার ‘ক্ষতিপূরণের অর্থের’ বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সহায়তা ক্ষতিপূরণ আইনের মধ্যে পড়ে না। এই টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা। মনে রাখতে হবে, অনুদান এবং ক্ষতিপূরণ এক কথা নয়। অনুদানের সঙ্গে সহৃদয় ইচ্ছা যুক্ত। ক্ষতিপূরণ হলো আইনী বাধ্যবাধকতা। ইতোমধ্যে রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর নেতৃত্বে গঠিত সমন্বয় কমিটির হিসাব অনুযায়ী ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার হলে সকল ক্ষতিপূরণ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এই টাকা এখনও যোগাড় হয়নি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল সংস্থারই এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকার কথা। এ তো গেল রানা প্লাজার চিত্র। কিন্তু সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে নির্মাণশ্রমিক, চাতালশ্রমিক উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি মংলা শিল্প এলাকায় সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ভবন ধসে ৮ শ্রমিকের মৃত্যু হলো। অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। কিছুদিন আগে ঢাকা মিরপুর-২-এ এক প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৪ শ্রমিকের মৃত্যু ও অনেক শ্রমিক আহত হয়েছে। গত কয়েক বছরে এক শ’রও অধিক চাতাল শ্রমিক বয়লার বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে এবং আহত হয়েছে। নির্মাণকাজে প্রায়ই দেখা যায়, অসাবধানবশত শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা। এছাড়া কৃষিকাজ, রাসায়নিক কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপগুলোতে বিভিন্ন শ্রমিক আক্রান্ত হচ্ছে জটিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে। এ সকল ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের হিসাব-নিকাশ নেই বললেই চলে। নামে মাত্র দয়ার বশবর্তী হয়ে কিছু টাকা শ্রমিকের হাতে তুলে দিলেই তা ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। অনেকে যুক্তি দেখাতে চান আইএলও কনভেনশন ১২১ এবং মারাত্মক দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫-এর ভিত্তিতে যদি আমরা ক্ষতিপূরণের কথা বলি, তাহলে কখনই মালিকরা তা দিতে রাজি হবে না। আমাদের মতো গরিব দেশে এ ধরনের আইন না হওয়াই শ্রেয়। তাদের উদ্দেশে বলি, কারও ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে আইন তৈরি হয় না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সেই আইনের বাস্তবায়নে দরকষাকষি হতে পারে। তবে আইনটা থাকা চাই। আইন থাকলে তা মেনে চলার মানসিকতা গড়ে উঠবে এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সেগুলো বিবেচনায় আনবে। সুতরাং ক্ষতিপূরণ আইনটি জরুরী এবং সেই আইনের ভিত্তিতে অর্থের মানদণ্ড নির্ধারণ করা সরকার-মালিক-শ্রমিক সকলেরই প্রধান এবং প্রাথমিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। ক্ষতিপূরণ শুধু নয়, একই সঙ্গে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রয়োজনে চিকিৎসা ও পুনর্বাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে সকল শ্রমিককে বীমার আওতায় আনার কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার। তাছাড়া কলকারখানা পরিদর্শকের দফতর যতক্ষণ কার্যকর ভূমিকা পালন না করবে, ততক্ষণ সকল আইন বা উদ্যোগই অকার্যকর হয়ে থাকবে। সে কারণে শ্রম অধিদফতর পরিদফতরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহির কার্যকর পরিকল্পনা খুবই প্রয়োজন। মহান মে দিবসে আমরা যখন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের কথা বলছি, তখন বাংলাদেশ জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছে পেট্রোলবোমার আগুনে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে হরতাল-অবরোধ শুধু নাশকতাই সৃষ্টি করছে এবং এর কোনটিই সফল হয়নি। গত ৩ মাসে এই সহিংসতায় ১৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৩৭ জনই পরিবহনের শ্রমিক। তাছাড়া অসংখ্য নিরীহ মানুষ, শিশু এই আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এগুলোকে কেউ দুর্ঘটনা বলে পার পাবে না। এই শ্রমিকদের এবং নিরীহ মানুষকে সহযোগিতা করা বা তার পাশে দাঁড়ানোর উপায়টা কী? বার্ন ইউনিটে পোড়া মানুষের কান্না, পুড়ে যাওয়া মাংসের গন্ধ, ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া বাস-ট্রাক, আগুনে অঙ্গার হয়ে যাওয়া গরু-মুরগি, রেললাইনে উল্টে পড়ে যাওয়া ট্রেনের বগি- এসবই ভারি করে তোলে বাংলার আকাশ-বাতাস। এই ক্ষতিপূরণ কারা দেবে এবং এই ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড কী হবে? বাঙালী জাতি সৌভাগ্যবান। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশ পরিচালনা করছেন। তাই এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি এবং আরও কিছু মানুষও এগিয়ে এসেছে যাদের মানবতাবোধ আছে। কিন্তু যাদের কারণে পুড়ছে মানুষ, জ্বলছে দেশ- তাদের কি কোন দায় নেই? তারা কি এই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নন। রাজনীতির নামে এই অপসংস্কৃতি আমরা রুখে দাঁড়াতে চাই। যেমন রুখে দাঁড়াতে চাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, মালিকের নির্যাতন, প্রশাসনের অবহেলা ও উদাসীনতা। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা জরুরী। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে আমরা এখনও এ সকল বিষয়ে ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারিনি। সবকিছুর উর্ধে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, যা আমরা অর্জন করেছি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সংবিধান আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল, যে সংবিধানে সুস্পষ্ট লেখা আছে শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি ও অধিকারের কথা। যে অধিকার পেতে রাষ্ট্র তাকে কোন কিছু থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। সংবিধানের আলোকে শ্রমিক তার অধিকার প্রাপ্তির লক্ষ্যে যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি আদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তখন সবই গুলিয়ে যায় অস্বস্তিকর অপরাজনীতির সহিংসতার কারণে। একদিকে সুস্থ ধারার রাজনীতি এবং মুত্তিযুদ্ধে লালিত স্বপ্ন ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দেশকে নাশকতা-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ। এই দুটি বিষয়ে শ্রমিকদের সোচ্চার থাকতে হয়। চোখ বন্ধ করে এক চোখা নীতিতে শুধু শ্রমিকের দাবি পূরণের কথা শ্রমিককে রক্ষা করবে না। বরং পেট্রোলবোমার আঘাতে শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে থাকবে। এবারের মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক- দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও। দেশকে জঙ্গীবাদ, নাশকতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার সকল শর্ত পূরণ করে দুর্ঘটনা ও নাশকতার মোকাবেলা কর। জয় হোক শ্রমজীবী মানুষের। লেখক : শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য
×