ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুই মহানগরের নির্বাচন রাজনীতি কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১ মে ২০১৫

দুই মহানগরের নির্বাচন রাজনীতি কোন্ পথে

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগর চট্টগ্রামের তিনটি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচন হয়ে গেল গত ২৮ এপ্রিল। যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের বিধান নেই, তারপরও বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে সামর্থ্য অনুযায়ী সব রাজনৈতিক দলই দলীয়ভাবে প্রার্থী বাছাই করে এবং গোটা দল সেই প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে। স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে পারেন না। বছরের শুরুতে বিএনপি-জামায়াত জোট ৯২ দিন লাগাতার অবরোধ এবং সাময়িক বিরতি দিয়ে টানা হরতাল ডেকে শতাধিক নিরীহ মানুষ জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে, হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ও জনসম্পদ ধ্বংস করে আন্দোলনের নামে যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস করেছে, দুটি মহানগরের তিনটি কর্পোরেশনের নির্বাচন তাতে মানুষকে যথেষ্ট স্বস্তি দিয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির নিজস্ব কোন রাজনৈতিক সত্তা অথবা সরকারের বিরুদ্ধে দলীয় কোন কর্মসূচী নেই; দিচ্ছে না, বা দিতে পারছে না। কারণ, বিএনপির কাঁধে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হয়েছে জামায়াত। এই দৈত্যের প্রভু পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। প্রভুর নির্দেশে ঘাড়ে বসা দৈত্য যা বলছে, বিএনপি তাই করছে। মাঝে মাঝে এক আধটু ঝাঁকুনি দিয়ে দৈত্যকে ঘাড় থেকে নামানোর মৃদু চেষ্টা করে বটে, কিন্তু ফল হয় না। ঝাঁকুনি খেয়ে দৈত্য আরও চেপে বসে। বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরতিহীন হরতাল ও অবরোধে দলের বহু নেতাই অসন্তুষ্ট ছিলেন। বিএনপির কেন্দ্র, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা ব্যবসায়ী এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা। বিএনপির চেয়ে শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর সংখ্যা আওয়ামী লীগে অনেক কম। টানা হরতাল-অবরোধের সময় বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের মালিকানাধীন কোন শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল না। তারা গাড়িতে চেপেই কারখানা বা অফিসে গেছেন। মরেছে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ চলন্ত যানবাহনে পিকেটারদের ছুঁড়ে মারা পেট্রোলবোমায় জ্যান্ত দগ্ধ হয়ে। শতাধিক নিহত হলেও কয়েক শ’ মানুষ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। শত শত পরিবার নিস্ব হয়ে পথে বসেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন ও আদর্শ ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাবার জন্য জন্মের পর থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে জামায়াত, যার প্রধান সঙ্গী ও ছত্রধারী বিএনপি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত করার জন্য জামায়াতের প্ররোচনায় বিএনপির একটানা হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যখন চরমে পৌঁছেছিল, যখন দলের ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসার পথ খোঁজা হচ্ছিল তখনই সরকার দুই মহানগরে দীর্ঘ প্রত্যাশিত পৌর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, নির্বাচন কমিশন যথারীতি প্রস্তুতি নিয়েছে এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পৌর কর্পোরেশন অধিকাংশ সময় ছিল বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। এবার বিএনপি প্রথমে একটু গড়িমসি করলেও পরে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। যদিও গত কয়েক বছর ধরে তারা তোতাপাখির মতো বলেছে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে তারা যাবে না। বিএনপির জন্ম হয়েছে ক্ষমতার গর্ভে। বেশিদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিএনপির নাভিশ্বাস ওঠে, ডাঙায় তোলা মাছের মতো হাঁসফাঁস করে। এই সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শহরে তারা জয়ীও হয়েছে। বিএনপি যখনই জয়ী হয়, তারা বলে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। পরাজিত হলে তারা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। কখনও পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখলেও সরকারের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিএনপি নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এবার দুই মহানগরে মেয়র নির্বাচনের ঘোষণা বিএনপির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। একটানা ৯২ দিন অবরোধ-হরতালের নামে সন্ত্রাস ও নরহত্যার দায়ে যখন কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত বহু নেতাকর্মী জেলে বা হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, যখন দলের সাংগঠনিক কাঠামো ধসে পড়েছিল তখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ভাঙাঘর মেরামত ও গোছানোর সুযোগ পেয়েছিল। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৯২ দিন নিজেকে দলের কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ রেখে যে যন্ত্রণায় ছিলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তাকে সরকারই করে দিয়েছিল। প্রথম জীবনে সামরিক কর্মকর্তা ও জেনারেলের পতœী, তারপর বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দুবারের বিরোধী দলের নেত্রী এবং অন্তিমে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জীবনে যা করেননি- গোলাপি রঙের শিফন শাড়ি পরে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে কারও বাড়িতে, কারও দোকানে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট চেয়েছেন। যদিও তাঁর বিশাল গাড়ি বহরের নিচে মানুষ চাপা পড়েছে, তার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৯২ দিনের আগুন-সন্ত্রাসের বিক্ষুব্ধ ভিকটিমরা প্রহৃত হয়েছে, তারপরও সরকার চেয়েছে বিএনপি নির্বাচনে থাকুক। নইলে যেভাবে হরতাল-অবরোধের নামে লাগাতার হত্যা ও সন্ত্রাসের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি সমূহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, সরকারের পক্ষে তার দায় বহন দিন দিন দুরূহ হয়ে উঠছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ত্রাণ তহবিল থেকে অগ্নিদগ্ধ নিহত ও আহতদের পরিবারকে প্রায় প্রতিদিন যেমন আর্থিক সাহায্য করেছেন, একইভাবে যাদের পরিবহন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, তাদেরও ক্ষতিপূরণ প্রদান অব্যাহত ছিল। মেয়র নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছিল, বিএনপির প্রার্থীরা তত উৎসাহ নিয়ে প্রচারকার্য পরিচালনা করেছেন। যদিও মাঝে মাঝে গতানুগতিক অভিযোগ করেছেন- সরকারী দল তাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে, কর্মীদের মারধর করছে ইত্যাদি, যা বাংলাদেশের সব নির্বাচনে সরকারের বিরুদ্ধে করা হয়। তবে এবারের নির্বাচনে দুই প্রধান দলের মেয়র প্রার্থীরা একে অপরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেননি, যা অতীতের নির্বাচনে দেখে আমরা অভ্যস্ত। বিশেষভাবে ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের আনিসুল হক এবং বিএনপির তাবিথ আউয়াল নির্বাচনে প্রচারণায় যে সংযম ও বিনয়ের পরিচয় দিয়েছেন, সাধারণ মানুষকে তা আকৃষ্ট করেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সনের গাড়ি বহরে যখন হামলার ঘটনা ঘটেছে, আনিসুল হক তার নিন্দা করে প্রশংসিত হয়েছেন। বলা যেতে পারে, প্রধানত প্রার্থীদের সংযমী আচরণের কারণে নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা অতীতের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে এবার কম ছিল। নাটকীয় সব ঘটনা ঘটল ২৮ এপ্রিল। সকাল থেকে মানুষ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিচ্ছিলেন। দু’ঘণ্টার ভেতর ঢাকা দক্ষিণের কয়েকটি কেন্দ্রে গোলযোগের সংবাদ টেলিভিশনে বলা হলো এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হলো ব্যাপক কারচুপি ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। দেশের সব টেলিভিশনে সুরিটোলায় ভোট কেন্দ্র ভাঙচুরের একটি দৃশ্য কয়েক মিনিট পর পর যেভাবে দেখানো হচ্ছিল তাতে কারও মনে হতে পারে সর্বত্রই বুঝি একই ঘটনা ঘটছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, তাদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, যারা ঢুকেছিল তাদের বের করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, বহু কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্ট দেয়নি। আমরা কোন্্ ভাষ্য গ্রহণ করব? আমি ১৯৭০ সাল থেকে ভোট দিই মহাখালীর তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রে। গত ৪৫ বছরে আমাদের কেন্দ্রে বা মহাখালী, বনানী, গুলশান এলাকায় নির্বাচনের দিন অনিয়ম বা সন্ত্রাসের ঘটনা কখনও ঘটেনি। বিএনপিও করেনি, আওয়ামী লীগও করেনি। আমি সকাল এগারোটায় সপরিবার ভোট দিতে গিয়েছি। ’৯১-এর পর এই প্রথম দেখলাম বুথে বিএনপির এজেন্ট নেই। চারজন এজেন্টের ভেতর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট থাকলেও, তিতুমীর কলেজের ভোটকেন্দ্রে বিএনপির কোন এজেন্ট কেন নেই জানতে চাইলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, সকাল থেকে বিএনপির কোন এজেন্ট আসেননি। অন্য সময় ভোটকেন্দ্রের বাইরে বড় দলগুলোর অভ্যর্থনা কেন্দ্র থাকে, যেখান থেকে ভোটার তালিকা ঘেঁটে ভোটদাতাদের ক্রমিক নং লিখে স্লিপ দেয়া হয়। এবার দেখেছি তিতুমীর কলেজ কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির তরুণ কর্মীরা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে ভোটদাতাদের ক্রমিক নম্বর খুঁজে বের করতে সাহায্য করছে। বিএনপির কোন অভ্যর্থনা কেন্দ্র ছিল না। দুই মহানগরে প্রায় ২৭০০ ভোট কেন্দ্রের প্রতি বুথে এজেন্ট দিতে হলে প্রয়োজন হবে কমপক্ষে দশ হাজার কর্মীর। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মী ৯২ দিনের সন্ত্রাসের মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে এলাকাছাড়া, যে কারণে কর্মী স্বল্পতা থাকা স্বাভাবিক। তারপরও ঢাকা দক্ষিণের যে সব ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তাদের অধিকাংশ ছিল একই দলের দুই প্রার্থীর বিরোধজনিত। ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগে ছিল আওয়ামী লীগের দুই বা তিন প্রার্থী। অনেক জায়গায় বিএনপির এজেন্টরা আগের মামলার ভয়ে যেমন ভোটকেন্দ্রে যায়নি এটা যেমন সত্য, তেমনি অনেক জায়গায় বিএনপির এজেন্টদের যে বের করে দেয়া হয়েছে- যা গণমাধ্যমে প্রদর্শিত বা প্রকাশিত হয়েছে। তবে নির্বাচনের দিন বা তার পরদিনও বিএনপির প্রার্থীরা বা তাদের নির্বাচন পরিচালনাকারীরা বলতে পারেননি, কোন্্ কেন্দ্রে তাদের কোন্্ কোন্্ এজেন্টকে ঢুকতে দেয়া হয়নি বা বের করে দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিতভাবে করতে হয়, যা বিএনপি করেনি। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে, এমনকি সংবাদ সম্মেলনে ঢালাওভাবে অভিযোগ করলেও কোন মামলা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিধি অনুযায়ী না করা হয়। আওয়ামী বিদ্বেষী দৈনিকগুলো ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও সন্ত্রাস নিয়ে পরদিন যে হুলস্থ’ূল কাণ্ড করেছে, মনে হয় অতীতে কোন নির্বাচনে এমনটি হয়নি। আমি নিজে ২০০১ সালের নির্বাচনে শুধু পর্যবেক্ষকই ছিলাম না, ভুক্তভোগীও বটে। চাঁদপুর ও ফেনীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে তখন যে সন্ত্রাস ও খুনোখুনি দেখেছি, তা নিয়ে ‘জনকণ্ঠ’ ও ‘ভোরের কাগজ’-এ ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলাম। নির্বাচনের পরদিন ভোরের কাগজে ফেনী থেকে পাঠানো আমার খবর প্রথম পাতায় সেকেণ্ড লীড ছিল, যার বিষয় ছিল- বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম ও জাল ভোট প্রয়োগ, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ফেনীতে ৬০ হাজার সংখ্যালঘু ভোটার ভোট দিতে পারেনি, প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দুদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা ইত্যাদি। চাঁদপুরেও একই সন্ত্রাস দেখেছি, যা শুধু নোট করিনি, ক্যামেরায়ও ধারণ করেছি। এ নিয়ে পরে প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেছি- ‘আমাদের বাঁচতে দাও’ নামে, যার জন্য আমাকে বিএনপি-জামায়াত সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দু’বার জেলে ঢুকিয়েছিল। ২৯ এপ্রিল দৈনিক ‘প্রথম আলো’র শিরোনাম ছিল- ‘জিতল আওয়ামী লীগ, হারল গণতন্ত্র।’ ‘নয়া দিগন্ত’র শিরোনাম ছিল ‘ভোট জালিয়াতির মহোৎসব : বিএনপির বর্জন’। ‘ইনকিলাব’-এর শিরোনাম- “নজিরবিহীন ‘অভিনব’ ভোট।” জামায়াত-বিএনপি সমর্থক এসব দৈনিক পড়লে যে কারও মনে হবে, ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে যে অনিয়ম, কারচুপি ও সন্ত্রাস ঘটেছে অতীতে বুঝি তেমনটি ঘটেনি। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় যে ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল, যে বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল, তখন কিন্তু ‘প্রথম আলো’ গণতন্ত্রের পরাজয় দেখেনি। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে সন্ত্রাস ও কারচুপির প্রতিবাদ করলেও কখনও বলেনি জামায়াত-বিএনপির সরকার অবৈধ। নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জয়ী হলে গণতন্ত্রের জয় হয় আর আওয়ামী লীগ জয়ী হলে গণতন্ত্রের পরাজয় হয়, এই মানসিকতার উৎস খুঁজতে হলে আমাদের ’৭১-এ ফিরে যেতে হবে। গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের মনোজগতে এই বোধের জন্ম দিয়েছে জামায়াত, যার প্রধান অবলম্বন এবং শিকারও বিএনপি। ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মীরা দলীয় ও বিদ্রোহীর পক্ষ নিয়ে যে যেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে এর মাসুল আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে। তবে বিএনপি যে কারণে নির্বাচন বর্জন করেছে, তার মূল অনুসন্ধান করা এখন সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। টেলিভিশনে রাতের ‘টক শো’-এ দেখছি রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ নিয়ে অনেক সারগর্ভ মন্তব্য করছেন। একটি বিষয় স্পষ্টভাবে কেউ বলছেন না- ঘাড়ের ওপর চেপে বসে থাকা সিন্দবাদী দৈত্যকে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে বিএনপি কখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপিকে যে কারণে জামায়াত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি, একই কারণে বিএনপি এবার নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে এখন আঙ্গুল কামড়াচ্ছে। অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা যায় নির্বাচন বর্জন করে, কারচুপি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে কিংবা নির্বাচনের আগের দিন বা নির্বাচনের দিন প্রার্থী প্রত্যাহার করে। যে প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হোক আখেরে বিএনপি-জামায়াত জোট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে বাদ নিয়ে একতরফা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, তারা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে। নির্বাচনের পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন- ‘কারচুপি হলে বিএনপি মেয়রপ্রার্থীরা লাখ লাখ ভোট পেলেন কিভাবে?’ (জনকণ্ঠ, ৩০ এপ্রিল ২০১৫) ভোটগ্রহণ আরম্ভের চার ঘণ্টার ভেতর বিএনপি চট্টগ্রাম ও ঢাকায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও ঢাকা উত্তরে তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির মির্জা আব্বাস পেয়েছেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। চট্টগ্রামে বিএনপির মনজুর আলম পেয়েছেন ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৩৭ ভোট। এত ভোট পেয়ে তারাও বিস্মিত। প্রত্যাহারের পরও ঢাকায় বিএনপির ৮ কাউন্সিলর জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়ররা সোয়া লাখ থেকে সোয়া দু’ লাখের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হলেও প্রদত্ত ভোটের ৩৬ ভাগেরও বেশি পেয়েছে বিএনপি, যা বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলকেই ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি এজেন্ট বের করে, বুথ দখল করে জাল ভোট দিলে ভোটের হার ৮০ বা ৯০ নয়, ১০০ ভাগও অতিক্রম করে। অথচ এত ভোট ডাকাতির কথা বলা হলেও দুই মহানগরের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৪৪%। বেলা দশটার সময় বিএনপি যখন বলছে, সব ভোট কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি হচ্ছে তখন শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা নয়, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হচ্ছে, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক। বেলা বারোটায় বিএনপির প্রত্যাহারের পর পর্যবেক্ষকদের অনেকে ভোট ডাকাতি ও সন্ত্রাসের কথা বলেছেন, টেলিভিশনে আমরাও দেখেছি। এ কথা তখন বলা হয়নি বিচ্ছিন্ন যে সব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে সেগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের ভেতর। ৯২ দিন অবরোধ-হরতালের নামে এত সব হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে এবং নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণের চার ঘণ্টার ভেতর নির্বাচন থেকে মেয়র প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে বিএনপি যে পরিমাণ ভোট পেয়েছে, সেটি বিবেচনায় রাখলে দুই প্রধান দলকেই তাদের আগামী দিনের রাজনীতির কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। এভাবে জামায়াতের জিম্মি হয়ে থাকলে বিএনপি অচিরেই মুসলিম লীগের মতো হারিয়ে যাবে। তখন মাঠে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে থাকবে জামায়াত বা অন্য যে কোন নামে মওদুদীবাদ ও ওহাবিবাদ। এটি জামায়াত ও আইএসআই’র কাম্য হতে পারে বটে কিন্তু কখনও আওয়ামী লীগের কাম্য হওয়া উচিত নয়। ৩০ এপ্রিল, ২০১৫
×