ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৫০ লাখ দরিদ্রের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৩০ এপ্রিল ২০১৫

৫০ লাখ দরিদ্রের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এ লক্ষ্যে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (২০ কোটি মার্কিন ডলার) ঋণ দিচ্ছে সংস্থাটি। সহজ শর্তে এ ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। আগমী ৫ মে সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ইতোমধ্যেই এ ঋণ অনুমোদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। নতুন জীবন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় অনুষ্ঠানে সরকারের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ক্রিস্টিন কাইমস। এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম জনকণ্ঠকে বলেন, দারিদ্র্য ম্যাপ অনুযায়ী যে সব এলাকায় দারিদ্র্য হার বেশি সে সব এলাকা এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমকে আরও ত্বরান্বিত করবে। তিনি বলেন, বর্তমানে দারিদ্র্য নিরসনে আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। এ সাফল্য ধরে রাখতে নতুন জীবন প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা রাখবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, দারিদ্র্যদের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প ‘নতুন জীবন’-এর আওতায় এসব অর্থ দেশের ২১ জেলার দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয় করা হবে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি এ ঋণ সরবরাহ করেছে। ৩৮ বছর মেয়াদি এ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ছয় বছর। শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউহানেস জাট এ বিষয়ে বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। গত দশকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষকে দারিদ্রের বাইরে এনেছে। দারিদ্র্য এখনও বড় উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ। গ্রামীণ অঞ্চলে প্রায় চার কোটি ৭০ লাখ মানুষ দরিদ্র। নতুন জীবন প্রকল্প দারিদ্র্য মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তিনি জানান, এ প্রকল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকায়ন এবং ব্যবসায়িক অংশীদারির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশে সহায়তা করবে। এ প্রকল্প থেকে ক্ষুদ্র গ্রামীণ অবকাঠামোতেও অর্থায়ন করা হবে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্ররা প্রকল্পের আওতায় সহায়তা পাবে, যারা বেশির ভাগ সময় ক্ষুদ্রঋণ সুবিধার বাইরে থাকছে। সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেছিলেন, দ্রুত দারিদ্র নিরসনে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক একসঙ্গে কাজ করবে এবং একই সঙ্গে সুশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রতিটি ডলারই দরিদ্র জনগণকে সাহায্যের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়। ওই সময় ওয়াশিংটনে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি এসব কথা বলেছিলেন। বৈঠকে দারিদ্র্য দূরীকরণে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অগ্রগতির ব্যাপক প্রশংসা করেন তিনি। বৈঠকে জিম ইয়ং কিম বলেন, বাংলাদেশে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) দারিদ্র্য নিরসনসূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এক দশক ধরে বার্ষিক উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এ প্রবৃদ্ধির কারণে এক দশকে ১ কোটি ৬০ লাখ লোকের দারিদ্র দূর হয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, তারপরও বাংলাদেশে গরীব মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে রয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ৪ কোটি ৭০ লাখ লোকের দারিদ্র্য দূর করতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এর আগে গত বছরের এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনে গড়ে ৭ দশমিক ৬ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এজন্য সরকারী, বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নে তথা দারিদ্র্য বিমোচন, প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া দরকার। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালে একযোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে উন্নয়ন সহায়তাকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অবকাঠামো সমস্যা কমিয়ে আনতে হবে, বিষয়টি কঠিন হলেও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তা অসম্ভব নয়। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলের মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো সমস্যা দূর করতে সরকারী ও বেসরকারী যৌথ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নে খাতভিত্তিক বিনিয়োগের একটি তালিকা দেয়া হয় রিপোর্টে। এতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৬ থেকে সর্বোচ্চ ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়। খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে, ট্রান্সপোর্টে সর্বোচ্চ ৪৫ বিলিয়ন নিম্নে ৩৬ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুতে ১৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন থেকে ১১ বিলিয়ন, স্যানিটেশন খাতে ১৮ থেকে ১২ বিলিয়ন, বিশুদ্ধ পানিতে ৪.২ থেকে ২.১ বিলিয়ন, টেলিকম খাতে ৫ বিলিয়ন, সেচ খাতে ১১.৬ থেকে ৭.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। সূত্র জানায়, আগামী পাঁচ বছরে দেশের দারিদ্র্য ১৬ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। বর্তমান দারিদ্র্য (২০১৪ সাল পর্যন্ত) ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কমিয়ে নিয়ে আসার এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। অতি দারিদ্র্যের হার বর্তমানের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে বলে জানা গেছে। দারিদ্র্য নিরসনের এ লক্ষ্য পূরণে এ লক্ষ্যে আগামী পাঁচ বছরে দেশের গড় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। পরিকল্পনা তৈরির দায়িত্বে নিয়োজিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে দেশ। শুধু দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রেই নয় ধনী-দারিদ্র্যের বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। যে হারে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে এটি অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণ। তিনি জানান, গত পাঁচ বছর গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। সার্বিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দুটি দেশ জার্মানী ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কেবলমাত্র বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় অব্যাহত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যাচ্ছে। তাই দারিদ্র্য কমছে এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা অর্জিত হলে দারিদ্র্য সাড়ে ১৬ শতাংশে নেমে আসবে।
×