ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি বিএনপির তিন মেয়র প্রার্থী

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৫

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি বিএনপির তিন মেয়র প্রার্থী

শরীফুল ইসলাম ॥ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি হলেন বিএনপি দলীয় ৩ মেয়র প্রার্থী। ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের কারণেই তাঁরা নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হয়েছেন। জিততে পারবে না নিশ্চিত হয়েই ভোট শুরুর সোয়া ৪ ঘণ্টা পর বিএনপি তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে হঠাৎ করে কেন্দ্র থেকে বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় তারা হতাশ হয়েছে। আর এভাবে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। বিদেশী কূটনীতিকরাও বলেছে বিএনপির নির্বাচন বর্জন দুঃখজনক। জানা যায়, আগের দিন রাতে ভোটারদের মাঝে টাকা বিতরণ করতে গিয়ে বিএনপি দলীয় ৩ সিটি মেয়র প্রার্থীদের সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর থেকেই দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। তবে দলীয় হাইকমান্ড আশা করেছিল ভোটের দিন সকালে বিএনপি জোট সমর্থিত ভোটাররা ঠিকই কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হবে। ভোট শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি সমর্থক কিছু ভোটার কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হলেও জামায়াতসহ জোটের অন্য শরিক দলের ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যায়নি। এ ছাড়া বিএনপি সমর্থক প্রার্থীদের এজেন্টরা অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে না যাওয়া এবং অধিকাংশ কেন্দ্রের পাশে দলীয় ভোটারদের ভোট প্রদানের জন্য সহযোগিতা করতে কেউ না থাকায় দলীয় নেতাকর্মী ও প্রার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে। তবে দলীয় হাইকমান্ড মনে করেছিল শঙ্কা কাটিয়ে হয়ত কোন এক সময় বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হবে। কিন্তু ৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই সরকার সমর্থকদের জয়জয়কার লক্ষ্য করা যায় তখনই বিএনপি হাইকমান্ড বুঝতে পারে এ নির্বাচনে তাদের জেতা সম্ভব নয়। তাই খালেদা জিয়ার নির্দেশে বেলা সোয়া ১২টায় নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ওপর থেকে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টিকে যে বিএনপি ভালভাবে নেয়নি তা চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থী মনজুর আলমের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। ভোট বর্জনের ঘোষণার সময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে বিভিন্ন এলাকায় তার সমর্থকদের ওপর হামলা করায় নির্বাচন বয়কট করতে বাধ্য হয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে প্রথমে বললে এক পর্যায়ে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্টে বলেন, ‘আমি আর রাজনীতি করব না।’ জানা যায় চট্টগ্রামের সাবেক এ মেয়র এবারও বিজয়ের ব্যাপারে আাশাবাদী ছিলেন। কিন্তু ওপর থেকে তাঁকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাই তিনি নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হন। আর যেহেতু তাঁর অনিচ্ছায় নির্বাচন করতে বাধ্য করা হয়েছে তাই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন আর রাজনীতি করবেন না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল বিএনপি। দীর্ঘদিনের নেতিবাচক আন্দোলনের পর নির্বাচনে অংশ নিলে ভোটারদের সাড়া পাবে না এমন আশঙ্কা ছিল তাদের। এ কারণেই ১৮ মার্চ ৩ সিটি কর্পোরেশনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকে তাদের আন্দোলন দমনের জন্য নাকি এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর ক’দিন পর থেকে তারা অভিযোগ করতে থাকে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এর পর তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ করতে থাকে। এর পর তারা অভিযোগ করে আন্দোলন চলাকালে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে আর ঢালাওভাবে মামলা করায় অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। এক পর্যায়ে তারা কারাবন্দী নেতাদের মুক্তি এবং যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা আছে তাদের গ্রেফতার না করার দাবি জানাতে থাকে। তবে সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের নাজুক অবস্থা কাটিয়ে তুলতে ৫ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে আদালত থেকে জামিন নিয়ে দীর্ঘ ৯২ দিন পর বাসায় ফিরে যান। এরপর এক এক করে বিএনপির কারাবন্দী নেতাকর্মীরা মুক্তি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাকর্মী সিটি নির্বাচন কার্যক্রমে অংশ নিতে থাকে। এবার বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় তাদের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না। এর পর বিএনপি অভিযোগ করতে থাকে বিভিন্ন এলাকায় তাদের নেতাকর্মীদের প্রচারনায় বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের পোস্টার-লিফলেট ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোট কেন্দ্রে সরকারী দল প্রভাব বিস্তার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে অভিযোগ করে প্রতি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা দেয়ার দাবি জানায়। এরপর তারা নির্বাচনী এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও দাবি জানায়। নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করলে বিএনপি সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে রিজার্ভ রেখে প্রয়োজনের সময় স্ট্রাইকিংফোর্স হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয় সরকারের নির্দেশেই নির্বাচন কমিশন এভাবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক পর্যায়ে জনমত যাচাই করতে ১৮ এপ্রিল থেকে মাঠে নেমে ভোটারদের হাতে হাতে দলীয় প্রার্থীদের লিফলেট বিতরণ করা শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এতে ভাল সাড়া পেয়ে ৩ সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন তিনি। তাই নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নেমে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে গিয়ে হাজির হওয়া এবং ভোটদান থেকে ভোট গণনা না হয়ো পর্যন্ত কেন্দ্র ত্যাগ না করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু ভোটের দিন খালেদা জিয়ার এ আহ্বানে দলীয় নেতাকর্মীরা সাড়া না দেয়ায় তিনি হতাশ হন। আর এ কারণেই ৩ সিটি নির্বাচনের খোঁজখবর নিয়ে তিনি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে বর্জনের ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেন। ১৮ এপ্রিল প্রথমদিনের মতো বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নির্বিঘেœ ভোটারদের হাতে হাতে লিফলেট বিতরণ করে ভোট চাইতে পারলেও দ্বিতীয় দিন উত্তরা এলাকায় বাধার মুখে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। সেই সঙ্গে তারা ওই এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে খালেদা জিয়া ওখান থেকে ফিরে বাড্ডা এলাকায় এসে ভোট প্রার্থনা করেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে সরকার বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তৃতীয় দিন কাওরান বাজার এলাকায় ভোট চাইতে গেলে স্থানীয় লোকজন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করে। ওই দিনও খালেদা জিয়া এ হামলার জন্য সরকার দায়ী বলে অভিযোগ করেন। চতুর্থদিন ফকিরাপুল এলাকায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাও সরকারী দলের লোকেরা ঘটিয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। ৫ম দন বাংলামোটর মোড়ে আবারও খালেদা জিয়ারগাড়িসহ তার বহরের বেশ ক’টি গাড়ি ভাংচুর করে হামলাকারীরা। এ ঘটনার পর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় খালেদা জিয়াকে হত্যা করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। তবে ৬ষ্ঠ দিনে বসুন্ধরা, নদ্দা, বাড্ডা ও বনানী এলাকায় বিনা বাধায় খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচার চালান। ২৬ এপ্রিল গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া ৩ সিটির ভোটারদের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিশোধ নিতে বলেন। সেদিন বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন বলেই তিনি এমন কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভোটের দিন দলীয় ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখানোতে ৪ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি বুঝে ফেলেন এ নির্বাচনে বিএনপি জিততে পারবে না। এ কারণেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে তিনি মওদুদকে নির্দেশ দেন। এদিকে বিএনপি ৩ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করার ঘটনাকে বিদেশী কূটনীতিকরাও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। মঙ্গলবার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ঢাকায় কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, বিএনপির নির্বাচন বর্জন দুঃখজনক। মঙ্গলবার অনুরূপ এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনও বিএনপির নির্বাচন বর্জনকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যায়। এর পর টানা আন্দোলন করতে গিয়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে তারা জনরোষে পড়েন। আর এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও ৩ সিটি নির্বাচন বর্জন করায় রাজনৈতিকভাবে আরও বেকায়দায় পড়ে দলটি। ৬ সিটি কর্পোরেশনে বিজয়ের পর দলের যে ইমেজ বেড়ে ছিল এবার বর্জনের মধ্য দিয়ে তারা রাজনৈতি অপরিপক্বতারই প্রমাণ দিল। আর বিএনপি বর্জনের পরও অনেক কেন্দ্র লম্বা লাইন ধরে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা গেছে। বিএনপিদলীয় কোন কোন কাউন্সিলর প্রার্থীও দলের বর্জনের সিদ্ধান্ত না মেনে কেন্দ্রে সরব ছিল।
×