ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিলেট ফল্ট ও ইন্ডিয়ান প্লেট বড় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৮ এপ্রিল ২০১৫

সিলেট ফল্ট ও ইন্ডিয়ান প্লেট বড় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে

রশিদ মামুন ॥ নেপাল কেন্দ্রে আবারও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই। তবে যে কোন সময় যে কোন স্থানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে। ভূমিকম্পের কোন আগাম পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়াটা স্বাভাবিক। এক সপ্তাহ থেকে তিন মাস পর্যন্ত এ ধরনের ছোট ভূমিকম্প হতে পারে। প্রথম দফার বড় ভূমিকম্প থেকে পরবর্তী ভূমিকম্পের মাত্রা এবং স্থায়িত্ব কম হয়ে থাকে। এতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তুলনামূলভাবে কম। নেপালে গত আট দশকের মধ্যে সব থেকে বড় ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি এবং ধ্বংসলীলায় গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশের মানুষও আতঙ্কে রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ আতঙ্ককে আরও উস্কে দিচ্ছে। মসজিদের মাইকে পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে ভূমিকম্পের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। মোবাইল ফোনের কল্যাণে তা দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সাধারণের মনে ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও পর্যন্ত এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি, যার সাহায্য নিয়ে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া যায়। তবে বাংলাদেশকেও ভূমিকম্পপ্রবণ উল্লেখ করে বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন তাঁরা, যার সঙ্গে নেপালে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কোন যোগসূত্র নেই বা কবে এই ভূমিকম্প আঘাত হানবে তাও বলা সম্ভব নয়। ওই সংবাদমাধ্যম বলছে, কাঠমান্ডু যে ঝুঁকির মুখে রয়েছে, সে বিষয়ে বার বার সতর্কবাণী এসেছে। এবারেরটা নিয়ে সেখানে গত ২০৫ বছরে অন্তত পাঁচটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এরমধ্যে ১৯৩৪ সালের আঘাত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা সংগঠন জিওহ্যাজার্ডস ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সমন্বয়ক হ্যারি ঘি ভূমিকম্পের পর সাক্ষাতকারে এ কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা আমাদের এখানে ভূমিকম্পের আশঙ্কা সম্পর্কে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের মাথা ঘেঁষে অবস্থিত বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশ বাংলাদেশ, যা ইন্ডিয়া প্লেটে উত্তর-পূর্বদেশ নিয়ে গঠিত এবং ইন্ডিয়া-বার্মা-তিব্বত প্লেটের সংযোগস্থলের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। মহাদেশীয় সঞ্চারণের ফলে ইন্ডিয়া প্লেট বছরে ছয় সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে তিব্বত ও বার্মা প্লেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এরকম ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ ভূমিকম্প ও সুনামির জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে ভূমিকম্পগুলো ও উত্তর সুমাত্রার সুনামি বাংলাদেশের জন্য আগাম সতর্ক বার্তা বহন করছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৬, ১৭ বা ১৮ শতকের দিকে বাংলাদেশে অনেক বড়মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। বড় ভূমিকম্পগুলো সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ বছর পর পর ফিরে আসে। সেদিক দিয়েও আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে গোটা দেশ। দেশের অভ্যন্তরে যে প্রধান চারটি ফল্ট (চ্যুতি) আছে সেগুলোই ভূমিকম্পের মূল উৎসস্থল। এখানে অতীতে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে তার মাত্রা ৭-এর বেশি, কোথাও ৮ বা ৯-এর উপরেও ছিল। তিন শ’ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ডাউকি ফল্টে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়েছিল। সীতাকু--মিয়ানমার ফল্টের ব্যাপকতা দেখে অনুমান করা হয়, সেখানে ১৭৬২ সালে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এসব ভূমিকম্প ১০০ থেকে ১৫০ বছর কিংবা আরও আগে ২৫০ বছর আগে আমাদের এই অঞ্চলে আঘাত হানে। সীতাকু--মিয়ানমার অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের পর আড়াই শ’ বছর পার হয়ে গেছে। ডাউকি এবং মধুপুরে ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। আসাম-সিলেট ফল্টে ৪০০ বছরের উপরে পার হয়ে গেছে। এখন আরেকটা বড় ভূমিকম্পের জন্য যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হওয়া দরকার তা সঞ্চিত হয়ে আছে। এখন যে কোন সময় এ অঞ্চলগুলোতে বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা ফল্টগুলোয় ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট দোহার্তি আর্থ অবজারভেটরি ২০০৩ সাল থেকে যৌথ গবেষণা চালাচ্ছে। এ গবেষণার আওতায় বাংলাদেশে ১৮টি জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) বসিয়ে প্লেটের গতি রেকর্ড করা হচ্ছে। এসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে আমাদের এই অঞ্চলটা (বাংলাদেশে) চার থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার বেগে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আবার ইন্ডিয়ান প্লেটের মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। ইন্ডিয়ান প্লেট অগ্রসর হচ্ছে ছয় সেন্টিমিটার বেগে। কিন্তু উত্তরে প্লেটের সংযোগস্থলের কাছাকাছি এসে গতি কমে যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে প্লেট এখানে লক্ড হয়ে আছে এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। যে কোন সময় এটি আনলক্ড হয়ে গেলে বিরাট ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ডিফারেন্সিয়াল মুভমেন্ট বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, সিলেট এবং ঢাকার দূরত্ব কাছাকাছি চলে আসছে অর্থাৎ দুটি অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে। এখানে নতুন করে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, শিলারাশির ভেতরে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে যে কোন সময় ভূমিকম্প হতে পারে। সেই হিসাবে আমরা ইতোমধ্যে ১০০ বছর পার করে এসেছি এবং বড় বড় ভূমিকম্পগুলো ১০০ থেকে ৩০০ বছরের মধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আসে। যাবতীয় তথ্য ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি করলেও কখন বা কিভাবে কোথায় এই ভূমিকম্প হবে তা বলা সম্ভব নয়। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক মোঃ শাহ আলম এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে বলছি বড় ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এখানেও তাই হচ্ছে। এরমধ্যে মাত্রা ৪-এ নেমে এসেছে, যা আামদের এখান থেকে সেভাবে অনুভূত হচ্ছে না। এখন নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি হতে হলে তার উৎপত্তিস্থল ভিন্ন হবে। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো এ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কেটে যায়। তবে ভূমিকম্পের কোন পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব না হওয়ায় কোথায় কখন কিভাবে তার সৃষ্টি হবে বলা যায় না। এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আমাদের সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে, যাতে ভূমিকম্পর সময় করণীয় বিষয়ে তারা সজাগ হয়। অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে বিপর্যয়ের আগেই বিপত্তিতে না পড়েন সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
×