ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিটি নির্বাচন বুয়েট ও আলবদরের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৭ এপ্রিল ২০১৫

সিটি নির্বাচন  বুয়েট ও আলবদরের ফাঁসি

রাত পোহালেই তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই লেখার মূল বিষয়বস্তু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচনী হালচাল। উঠে এসেছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাসি পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহও। আজ পড়ুন এই লেখার শেষাংশ। কামারুজ্জামানের ফাঁসিকে যিনি অন্যায় বলেন, তিনি জামায়াত সমর্থক বলা বাহুল্য। আলবদর কমান্ডারের ফাঁসিতে একজন শিক্ষক ‘ইনজাস্টিস’ বলবেন এবং শিক্ষক ও উপাচার্য তা সমর্থন করবেন, তা মেনে নেয়া যায় না। প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক যে প্রতিবেদন দিয়েছেন তাই মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থকরা গ্রহণ করেছেন। তরুণ এই সাংবাদিকের পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনের প্রথম ছত্র দেখুন- “সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে জামায়াতের নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির সমালোচনা করে মন্তব্য করায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল রবিবার বেলা দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ কক্ষ থেকে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বের করে ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এনে অপদস্থ করা হয়। লাঞ্ছনার শিকার ওই শিক্ষক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। ছাত্রলীগের নেতাদের অভিযোগ, তিনি ফেসবুকে কামারুজ্জামানের ফাঁসি হওয়াকে অবিচার হিসেবে অভিহিত করেছেন। শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে মুঠোফোনে জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, আমাকে অপমানিত ও নাজেহাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ জানতে চাইলে ফেসবুকে মন্তব্যের কথা স্বীকার করেন তিনি। কারা এ কাজ করেছেÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চেহারায় চিনি। ওরা বুয়েটেরই ছাত্র। তবে অন্য বিভাগের।” [১৩-০৪-২০১৫] তিনি আরও জানানÑ “এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জাহাঙ্গীর আলমের কক্ষে যান। সেখানে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসা হয়। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে তাঁর গায়ে হাত তোলা হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জ্যেষ্ঠ নেতারা তাঁকে উপাচার্যের কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাঁরা উপাচার্যের কাছে অভিযোগ জানান।” [ঐ] প্রথমেই তিনি মন্তব্য করেছেন, শিক্ষক ‘ফাঁসির সমালোচনা’ করেছেন। এটি সমালোচনা নয়, ব্যঙ্গ এবং সমর্থন। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা হয়েছে বলে তাকে কিছু শিক্ষার্থী জানিয়েছে। খবর নিয়ে জেনেছি, এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বরং জাহাঙ্গীর বলেছেন, তিনি ভুল করেছেন। খুব সম্ভব এই মন্তব্যের রেকর্ডিংও আছে। জনকণ্ঠের একই দিনের রিপোর্ট দেখুন, যা প্ররোচনামূলক নয়। সেই রিপোর্টের একটি অংশÑ “প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রবিবার দুপুর একটার দিকে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা উপলক্ষে নবগঠিত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ৪০-৫০ জন নেতাকর্মী বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের মিষ্টিমুখ করাতে যান। এর অংশ হিসেবে তাঁরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই শিক্ষকের কক্ষে যান। তাঁদের দেখে ওই শিক্ষক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন ও কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এর পর তিনি একজন শিক্ষার্থীকে চড় মারলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর হাতাহাতি হয়। তখন উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা তাঁকে কক্ষ থেকে বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার সামনে নিয়ে যায় এবং ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে বলেন। পরে অন্য জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা এসে তাকে নিরাপদে নিয়ে যায়। এতে নেতৃত্ব দেন বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদার, সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ কনক প্রমুখ।” এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়। রিপোর্টে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে একজন শেষ বর্ষের ছাত্র। যদি ‘অপরাধ’ করেও থাকে, একজন শেষ বর্ষের ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কার করা যে কী নিষ্ঠুরতা ও প্রতিহিংসার ব্যাপার, তা বলার নয় এবং একমাত্র বুয়েট শিক্ষকদের পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব। কারণ তারা আলবদরদের পক্ষের। আলবদরদের নিষ্ঠুরতা সর্বজনবিদিত। এ ঘটনার পর জামায়াতের মুখপত্র বাঁশের কেল্লা [২১.০৪.২০১৫] মন্তব্য করেÑ “শিক্ষকের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বুয়েট প্রশাসনকে অভিনন্দন! দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ ঘটনা হবে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।” বুয়েট শিবির সভাপতি এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের ফেসবুকে লেখেÑ “ছাত্রলীগ যেন এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে আর কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- না করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও অনুরোধ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘বুয়েটের মাটিতে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন হবেই ইনশাআল্লাহ’।” শিবির ছাড়া আর কোন সংগঠন ঐ শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়নি। জনকণ্ঠের ১১.১১.২০১২ সালের এক রিপোর্টে জানা যায়, ওই সময় শিবিরের ছাত্ররা যে তা-ব চালিয়েছিল বুয়েট ও সারাদেশে এবং শিক্ষক সমিতি ‘আন্দোলন’ করছিল সরকারের বিরুদ্ধে তাতে জাহাঙ্গীর আলমসহ বুয়েটের জামায়াতী শিক্ষকরা জড়িত ছিলেনÑ “দেখা গেছে, সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনের সময় বাইরে থেকে শিক্ষার্থী আনা, অর্থের যোগান দেয়া, প্রচার চালানো, পোস্টার ছাপানো ও বিলিসহ সব কর্মকা- চলেছে আটক শিবির ক্যাডারের কক্ষ থেকে। ফেসবুক ও ই-মেইল যোগাযোগ চলেছে তার মাধ্যমেই। জামায়াতী শিক্ষকরাও গোপনে তাকে চিঠি লেখে, মেইল পাঠিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। তার ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ও মেইলে প্রবেশ করে দেখা যায়, শফিকুল ইসলাম বিভিন্ন জনকে সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনের সময় বলছেন, ‘নো ম্যাটার, ডোন্ট ওরি। আমি শিবির করি এটা অনেকেই জানে, ভয়ে কেউ প্রকাশ করে না।’ আন্দোলনে অংশ নেয়া শিবিরের আরেক ছাত্র তা জেনে হতবাক হয়ে বলেছেন, সাবধানে থেকো। ফি আমানিল্লাহ। এই শিবির ক্যাডারের মেইল ও ফেসবুকে যত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত চার শিক্ষকের সম্পৃক্ততা। যেখানে শিবির ক্যাডারকে বিতর্কিত সেই শিক্ষকরা পরামর্শ-নির্দেশনা এমনকি অর্থনৈতিক যোগান দেয়ার কথাও বলেছেন নিজেরাই। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বডিগার্ড ছিলেন এমন অভিযোগ আগেই উঠেছিল শিক্ষক মাহবুব রাজ্জাকের বিরুদ্ধে। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে শিবির ক্যাডার শফিকুলের ব্যক্তিগত মেইল ও ফেসবুক এ্যাকাউন্টে। শিবিরের আন্দোলন নিয়ে কথোপকথনের এক পর্যায়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষককে শিবির ক্যাডার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘সালাম স্যার! কিন্তু আপনার লাস্ট আপডেটের প্রথম লাইনটা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। আমি জাহাঙ্গীর স্যারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, স্যার কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করুন।’ জানা গেল শফিকুলের এই জাহাঙ্গীর স্যার হলেন সিভিল বিভাগের শিক্ষক ড. জাহাঙ্গীর আলম। সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনে যিনি ছিলেন ব্যাপক সক্রিয়। তাকে শিবির ক্যাডার বলেছেন, সামনে ভিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচী আসছে। আর আমি ছাত্রশিবিরের হল কমিটির জন্য আবেদন করেছি। বুয়েটে উগ্রবাদী কর্মকা- চালানোর অভিযোগ অনেক আগেই উঠেছিল সিভিলের শিক্ষক স্নিœগ্ধা আফসানার বিরুদ্ধে। তিনি সব সময়ই অন্য তিন শিক্ষকের মতো শিবির ক্যাডারকে সাপোর্ট দিয়ে চলেছেন।” জাহাঙ্গীর সেই সময় ১০০০ টাকা তুলে দেন শিবিরকে। বুয়েটের রানা নামে আরেক শিক্ষক শেখ হাসিনাকে হুমকি দিয়ে লেখেনÑ “হায়েনা ওই হায়েনা তুই দেশকে খেয়েছিস, এখন তুই বুয়েটকে খাবি... পারবি না... আমরা বুয়েটের শিক্ষকরা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হচ্ছি শিকারি। প্রথমে তোর মাথাতে গুলি করব, তারপর তোর পেটে। তারপর তোর মাথা কেটে বুয়েটের গেটের সামনে টানিয়ে রাখব। যাতে আর কোন হায়েনার আক্রমণে বুয়েট আক্রান্ত না হয়। এর আগে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বুয়েটে শিক্ষকদের মধ্যে ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, ৭০ ভাগ শিক্ষক বিএনপি-জামায়াত-হিযবুত তাহ্্রীরের আদর্শের অনুসারী। অবশিষ্টরা নিরপেক্ষ মনোভাবাপন্ন এবং যেদিকে পরিবেশ অনুকূল মনে করেন সেদিকেই অবস্থান নেন।” [ঐ] পুলিশ এইসব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল। তবে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এইসব শিক্ষক শিক্ষকতা করবেন এবং তা মেনে নিতে হবে, এটি ন্যায্য কোন কথা নয়। শিক্ষকের ক্ষমতা আছে দেখে তা অপপ্রয়োগ করবেন, তাও আমরা মানতে বাধ্য নই। ক্ষমতা ছাত্রদেরও আছে। আমি মনে করি ছাত্র রাজনীতির যদি কোন আদর্শ এখনও থেকে থাকে, তা হলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে, অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনকেও। দক্ষিণে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে নববর্ষে। এটিও সমর্থনযোগ্য নয়। তবে আমার ধারণা, সেটি ভুলও হতে পারে, এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জড়িত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের এভাবে তরুণী লাঞ্ছনার প্রয়োজন হয় না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে পড়াশোনা করছে, আন্দোলন করছে। পরস্পর দোষারোপ না করে, অপরাধীকে যেন ধরা হয়, সে বিষয়ে নজর রাখা বরং জরুরী। আমি যদি বলি, এর সঙ্গে মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠনগুলোর যুক্ততা আছে, তা হলে আপনারা বলতে পারেন এটি অবাস্তব বিষয়। হেফাজত ইসলামীর প্রধান আহমদ শফী বলেছেন, “পহেলা বৈশাখের নামে নারীদের পর্দাহীন করা হচ্ছে। বিধর্মীদের সংস্কৃতি দ্বারা বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রভাবিত হচ্ছে।” শাহরিয়ার কবির ২৫ এপ্রিল জনকণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘নববর্ষের অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতন ॥ দায় কার, কে দায়ী’ প্রবন্ধেও একই ইঙ্গিত করেছেন। বক্তব্য একটিই। দক্ষিণের জনছাউনি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠরা এতদিন অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক আবহটা ধরে রেখেছে। সেটি তারা সমুন্নত রাখবে এবং তাদের প্রতিনিধি মেয়র এমন একজনকে নির্বাচিত করতে হবে, যিনি এই ধারাকে সমুদিত রাখবেন। উত্তর অপেক্ষাকৃত সাম্প্রদায়িক, গরিববিরোধী, স্বৈরাচারের পক্ষে। উত্তর রক্ষণশীল হলে আপত্তি নেই। উদারতার বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতা গ্রহণযোগ্য, কিন্তু মানবতাবিরোধীদের সমর্থকরা গ্রহণযোগ্য নয়। উত্তর যখন দক্ষিণের মতো হবে, ততই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, ফেরেববাজি হ্রাস পাবে। হয়ত আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন সেই ধারা এগিয়ে নিতে পারবেন।
×