ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতক ॥ শুধু দিবস পালন নয় মেধাসম্পদ রক্ষা কর

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৫

একুশ শতক ॥ শুধু দিবস পালন নয় মেধাসম্পদ রক্ষা কর

প্রতিবছরের মতো এবারও ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস পালিত হচ্ছে। অন্যদিকে ২০১১ সাল থেকে ২৩ এপ্রিল বিশ্ব গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবসও পালিত হয়ে আসছে। আইপি ডে পালন করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট ডিজাইন ও কপিরাইট অফিস। এই অফিসটির সঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বা এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, আইপি এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বেসরকারী খাতের আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এই দিনে অন্তত একটি সেমিনারের আয়োজন, সংবাদপত্রে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ, বিটিভিতে একটি টিভি অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কপিরাইট অফিস পালন করে ২৩ এপ্রিলের দিনটি। যাহোক, এই দুটি দিন ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলোতে অবশ্য মেধাসম্পদ আলোচনার কোন বিষয় হিসেবেই থাকে না। বরং উল্টোটা থাকে। পুরো বছর জুড়ে পাইরেসি থাকে এবং যারা মেধাসম্পদের মালিক তাদের ইচ্ছেমতো গালি দেয়া হয়। কাউকে কাউকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় এবং সুযোগমতো কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে চরিত্রহননের প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। সরকার বা সরকারী প্রতিষ্ঠান কারও নজরেই এই বিষয়গুলো পড়ে না। সরকারের কোন মাথাব্যথা থাকার কারণ নেই। বেসরকারী খাতেও অবস্থা এমন যেন যার পেটব্যথা কুকানিটা কেবল তার, যার সম্পদ চুরি হয়। বরং চারপাশে পাইরেসি হয়ে পড়ে একটি প্রাত্যহিক বিষয়। মতিঝিলের শিল্পভবনে অবস্থিত শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্যাটেন্ট. ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অফিস নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে বছরজুড়ে শীতের গরম উপভোগ করতে থাকে। অন্যদিকে আগারগাঁও-এর কপিরাইট অফিস ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে আরও একটি অকার্যকর নতুন প্রভাতের অপেক্ষা করতে থাকে। এরই পাশাপাশি এ দেশে যারা মেধাসম্পদ তৈরি করে তারা অপেক্ষা করে, কবে তাদের সকল অস্তিত্ব¡ একেবারে বিপন্ন হবে। টাস্কফোর্স কই : বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন কপিরাইট অফিস পাইরেসি প্রতিরোধ করার জন্য একটি এ্যান্টি পাইরেসি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। এই টাস্কফোর্স কয়েকটি অভিযান চালানোর পর এখন সম্পূর্ণ নীরব হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকারের আমলেও এটি নীরব ছিল। বর্তমান সরকারের আমলেও এর কোন কার্যক্রম আপাতত চোখে পড়ে না। গঠনের সময় টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ও সাবেক কপিরাইট রেজিস্ট্রার মঞ্জুরুর রহমানকে এ বিষয়ে খুবই সক্রিয় দেখা যেত। তিনি একক প্রচেষ্টায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি নানা দিক থেকে চাপের মুখেও ছিলেন। টেলিফোনে তাকে হুমকি-ধমকি কম দেয়া হয়নি। তিনি এককভাবে আর কত সামনে যাবেন। অবশেষে তিন হাল ছেড়ে দেন এবং নিজে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। কপিরাইটের নতুন রেজিস্ট্রার মহোদয় এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। এই সংস্থার সদস্য হিসেবে নিজেকে খুব লজ্জায় পড়তে হয়Ñ নিজের কাছে নিজেকে অপরাধীও মনে হয়। কিছুই করতে না পারার বেদনা আমাকে হতাশ করে। যখনই টাস্কফোর্সের সভা হয়, তখনই এসব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না। সভার সভাপতি সভায় বসে চরম আগ্রহ দেখান। কার্যবিবরণীতে লেখা হয় যে, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে অভিযান পরিচালিত হবে। কিন্তু সভাশেষে সভাপতি এবং তার পারিষদবর্গ বেমালুম ভুলে যান কার্যবিবরণীতে কি লেখা হয়েছে সেটি। অথচ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প পাইরেসির জন্য দেউলিয়া হতে বসেছে। এভাবে চললে নিকট ভবিষ্যতে এ দেশে কেউ সিনেমা বানাবে বলে মনে হয় না। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বই পাইরেসিতে আমরা বিশ্বের সেরা দেশে পরিণত হয়ে পড়েছি। বিদেশের বইতো এখানে পাইরেসি হয়ই, দেশের লেখকদের বইও এখানে দেদারছে চুরি হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের গঠন করা আরও একটি টাস্কফোর্স বেশ কিছুদিন অনেক ভাল কাজ করেছিল। তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে অশ্লীল ভিডিও, চলচ্চিত্র ও গানের নকল সিডি উদ্ধার করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে যে সেই আয়োজনেও ভাটা পড়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কপিরাইট আইন সংশোধন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু দিনের পর দিনে অতিক্রান্ত হলেও সেই কমিটির কোন সভা হয়নি। অন্যদিকে বছরের পর বছর কপিরাইট বোর্ডের কোন সভা হয় না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সম্ভবত কপিরাইট বিষয়টির কথা ভুলেই গেছে। অন্যদিকে খবর নেই প্যাটেন্ট আইনের। কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি একটি সমন্বিত আইপি অফিস গড়ে তোলার। প্রধানমন্ত্রী দুবার নির্দেশ দেবার পরও তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগই নেই। মেধাসম্পদের মালিক হওয়া সবচেয়ে বড় অপরাধ : সফটওয়্যারের যে কি চরম দুর্গতি সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ দেশের অবস্থাটি এমন যে, সফটওয়্যারের মেধাসম্পদ থাকাটাই এক বিপদে পরিণত হয়ে পড়েছে। আমি আমার নিজের কথাই বলতে পারি। আমি সফটওয়্যার তৈরি করেছি বলে আমার অপরাধ হচ্ছে- আমি কেন মেধাসম্পদের মালিক এবং কেন আমি অন্যকে আমার সম্পদ চুরি করতে দিই না। অবস্থা এমন : আমার মেধাসম্পদ অন্যেরা চুরি করবে, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারব না- এটাই এখন নিয়ম। আমার বিজয় কীবোর্ড আমার অনুমতি ছাড়া কেউ কারও সফটওয়্যারে পুরো বা আংশিক যুক্ত করবে বা কীবোর্ডে প্রিন্ট করা হবে, কিন্তু চোরই আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে। এখানেই শেষ নয়, সে পাইরেসি করেছে এই কথা বলার জন্য তার সমর্থকগণ আমাকেই ইন্টারনেটে গালি দিতে পারছে। এমন গালিদাতাকে ধরা যায় না- তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। যত্রতত্র ব্লগিং করছে এবং অশ্লীল-বিশ্রী ভাষায় আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে। মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে ইন্টারনেটে। দেশের আইনে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার বা দেখার কোন উদ্যোগ নেই। আমি মেধাসম্পদের মালিক হয়েছি বলে আমাকে কেউ চোর বলবে-বাটপার বলবে, ধান্ধাবাজ বলবে, ঠগ বলবে কিন্তু তার বিচার চাইবার জায়গা নেই। কিছু লোক বা প্রতিষ্ঠান কিছু লোককে কারও বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে-কারও মানহানি করার জন্য সর্বত্র অপপ্রচার চালাচ্ছে-কিন্তু কোথাও বিচার চাইবার জায়গা নেই। ২০০৯ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স কিছু পাইরেসি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতে নাতে বিজয়সহ অন্যান্য পাইরেটেড সফটওয়্যার উদ্ধার করে মামলা করেছিল। সেজন্য দায় হয়েছিল আমার। ওদের পক্ষে দোকান মালিক সমিতি তদ্বির করেছিল। শেষ পর্যন্ত সেইসব মামলার কোন তদন্ত বা রায় পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের মতো আর কোন দেশে চোরের মার এত বড় গলা আমি দেখিনি। চোরের এত বেশি সমর্থকও বোধহয় দুনিয়ার আর কোন দেশে নেই। যে লোকটি একের পর এক চুরির দায়ে অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত তার গলায় ফুলের মালা দেবার মানুষের স্রোত বয়ে যায় এই দেশে। যে লোকটি আমাকে গালি দেয় সেই লোকটি এটি ভাবে না যে, আমি প্রতিবাদ করেছি আমার সম্পদ সে চুরি করেছে বলে। কোথায় মানুষ আমার পক্ষে দাঁড়াবে- তার বদলে পরিকল্পিতভাবে আমাকে গালি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রায় সকল বাংলা লেখার সফটওয়্যারে বিজয় অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়-এটির নাম পাইরেসি। ওরা বুক ফুলিয়ে চলে- আর অপরাধী আমি। ওরা মনে করে আমাকে মাথা নিচু করতে হবে। বেশ কিছু ব্লগ সাইটে বিজয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- সেটিও অনুমতি ছাড়া। এর বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করতে পারব না। একটি সফটওয়্যারে আমার কীবোর্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং তাতে পেটকাটা ব, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দু, খ- ত এমন কয়েকটি কম ব্যবহৃত পজিশন বদলানো হয়েছে যাতে আমার মূল কীবোর্ড অবিকৃত থাকে। আমি কেন সেই কীবোর্ড অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদ করেছি তার জন্য আমার হেনস্থার শেষ নেই। এমন সব বাক্য আমার বিরুদ্ধে-ব্লগে, মেইলে, ফেসবুকে বলা হচ্ছে যা অনেকের মুখে আনাও কঠিন। সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এভাবে পাইরেসি করছে। খোদ, কম্পিউটার কাউন্সিল করেছে এই কাজ। তার বিরুদ্ধেও কোন প্রতিবাদ করা যায় না। এমনকি একটি জাতিসংঘ সংস্থা পাইরেসির সঙ্গে জড়িত তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করে কোন সুফল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নিয়ে তো কথাই বলা যায় না। সফটওয়্যার বিক্রি অপরাধ : বাংলাদেশে সফটওয়্যার বিক্রি করা অপরাধ। সফটওয়্যারের বিক্রি ঠেকাতে পারলে কেউ কেউ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কোটি কোটি টাকার বিদেশী সফটওয়্যার কেনায় কোন দোষ নেই- দোষ কেবল দেশের একশ’ টাকা দামের বাংলা লেখার সফটওয়্যার কেনায়। সফটওয়্যারের বা আবিষ্কারের কপিরাইট করা বা প্যাটেন্ট করা অপরাধ। ১৯৮৮ সালে বাংলাকে সহজভাবে লেখার যখন কোন সুযোগ ছিল না তখন কেন আমি একটি সহজ কীবোর্ড তৈরি করলাম এবং কেন সেটি কপিরাইট বা প্যাটেন্ট করলাম সেটি আমার অপরাধ। অথচ এই কথাটি কেউ বলে না যে, সফটওয়্যার যদি বিক্রিই না হয় তবে যারা সফটওয়্যার তৈরি করবে তারা বাঁচবে কি দিয়ে? আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বা এনজিওদের টাকায় কি আমাদের পুরো সফটওয়্যার শিল্প গড়ে উঠবে? শুধু স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কি ডিজিটাল দুনিয়াটা গড়ে উঠবে? এসব প্রশ্নের জবাব নেই। সেই কারণেই বলি কেবল বছরে একটি দিন বা দুটি দিন মেধাসম্পদের কথা বলে মুখে ফেনা এনে লাভ নেই। যদি দেশকে মেধাসম্পদে সমৃদ্ধ করতে হয় তবে অবশ্যই দেশীয় মেধাসম্পদের মূল্য দিতে হবে। এটি হয়ত ঠিক যে আমরা বিশ্বের সকল মেধাসম্পদ অর্থ দিয়ে ব্যবহার করতে পারব না। কিন্তু আমরা যদি নিজের দেশের মেধাসম্পদও নিজের মূল্য দিয়ে ব্যবহার করতে না শিখি তবে আমাদের কেউ নতুন মেধাসম্পদ তৈরি করেব না। ঢাকা, ২৪ এপ্রিল, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×