ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তৈরি হচ্ছে জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ এপ্রিল ২০১৫

ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তৈরি হচ্ছে জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান

এম শাহজাহান ॥ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকা রাখা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৬৪টি জেলা যাতে কন্টিনজেন্সি প্ল্যানের আওতায় আসে সে লক্ষ্যে আসন্ন ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার কথা বিবেচনা করছে সরকার। দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার কাজ শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের অতি ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার জন্য তৈরি করা হবে ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র। উল্লিখিত তিন সিটি কর্পোরেশনের বাইরে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং রাজশাহীতে অতিরিক্ত ভূমিকম্প ঝুঁকি জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এদিকে, চলতি বাজেটে খাদ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন খাতে মোট ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। যা গত অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা বেশি। আগামী বাজেটে এই খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে আভাস দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় করা হবে। বর্তমান এক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয় নেই। এ কারণে দুর্যোগ মোকাবেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে মানুষ কাক্সিক্ষত সহায়তা পায় না। এতে করে যে কোন দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হচ্ছে। তাই এবার স্থানীয় সরকার বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সমন্বয়ে অগ্নিকা-, ভবনধস ও ভূমিকম্প প্রতিরোধে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটির বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি বাজেট ঘোষণায় বলেন, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার কাজ শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ও ঝুঁকি নিরূপণ এবং ঝুঁকি হ্রাসে স্থানীয় কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যবহারিক গাইড প্রণয়নের কাজ চলছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরির প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। শুধু তাই নয়, ভূমিকম্পে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানোর লক্ষ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার জন্য কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে সারাদেশ এই পরিকল্পনার আওতায় আসবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়বে। এতে করে প্রচুর প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে রাজধানী ঢাকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন মহাপরিকল্পনায়। ঢাকা শহরে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য একটি ইমারজেন্সি অপারেটিং সিস্টেম (ইওসি) এবং সিটি কর্পোরেশনের ১০টি জোনাল অফিসের প্রতিটিতে স্যাটেলাইট কন্ট্রোল রুম চালু করা হবে। ভূমিকম্পের পর রাস্তা পরিষ্কার করতে ও বর্জ্য সরাতে কেনা হবে অত্যাধুনিক হুইল ডোজার। এক্সক্যাভেটর, ক্রেন ও মোবাইল জেনারেটরের মতো ভারি যন্ত্রপাতিও কেনা হবে। এসব যন্ত্রপাতি রাখার জন্য নির্মাণ করা হবে ওয়্যারহাউস। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়াতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা ও পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ইতোমধ্যে আরবান রেজিলিয়েন্স ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন নামের একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৭৫১ কোটি টাকা। এতে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে দেবে ৭৩১ কোটি টাকা। বাকি ২০ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ প্রকল্প শেষ করার কথা রয়েছে। ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র ॥ ভৌগোলিক অবস্থান, ভূত্তাত্ত্বিক গঠনের জন্য বাংলাদেশ তীব্র ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, সিলেট সীমান্তে সক্রিয় ডাউকি ফল্টের অবস্থান ও টাংগাইলে মধুপুর ফল্টের অবস্থান এবং উত্তর-পূর্বে সীমান্ত সংলগ্ন ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল হওয়ায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের আশঙ্কামুক্ত নয়। এ কারণে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জন্য ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। একই সঙ্গে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহীর ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ॥ ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরবর্তী অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। দ্রুত সাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন প্রভৃতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর (ডিডিএম), ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি), ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট সিটি কর্পোরেশন এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, বাখরাবাদ বিদ্যুত, স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্থার কন্টিনজেন্সি প্ল্যান তৈরি করে তার মাধ্যমে হালনাগাদ করা হচ্ছে। জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন ॥ ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের কারিগরি তথ্য সন্নিবেশিত করে প্রণয়ন ও কার্যকর করার লক্ষ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন অপরিহার্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরি ॥ বড় ধরনের কোন দুর্যোগ হলে তা সরকারের একার পক্ষে মোকাবেলা করা অত্যন্ত দুরূহ। তাই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৬২ হাজার নগর স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধারকার্য ও প্রাথমিক চিকিৎসায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি ॥ নির্মাণ কাজে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করণীয় সম্পর্কিত পোস্টার, লিফলেট ছাপিয়ে শহরগুলোতে বিতরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার ১০০ নির্মাণ কর্মীকে ভূমিকম্প সহনীয় টেকসই বিল্ডিং তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় যন্ত্রপাতি ক্রয় ॥ ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতিসমূহ ক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচী (সিডিএমপি) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর যৌথভাবে ভূমিকম্প উত্তর উদ্ধার কার্য পরিচালনার জন্য প্রায় ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। আগামীতে আরও অত্যাধুনিক যস্ত্রপাতি ক্রয় করার জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়ার কথা সরকার বিবেচনা করছে।
×