ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ে দ্বারে দ্বারে খোলা চিঠি বিতরণ

নির্বাচনে সুবিধা আদায়ের কৌশল ॥ সরকারকে অভিযোগের চাপে রাখতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৫ এপ্রিল ২০১৫

নির্বাচনে সুবিধা আদায়ের কৌশল ॥ সরকারকে অভিযোগের চাপে রাখতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ সরকারকে অভিযোগের চাপে রেখে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সুবিধা নিতে চায় বিএনপি। এ জন্য ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অভিযোগ করে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে তিন সিটি কর্পোরেশনের দলীয় মেয়র প্রার্থীদের নামে একটি খোলা চিঠি ছেড়েছে বিএনপি। দলীয় কর্মীদের দিয়ে এ খোলা চিঠি প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে ভোটারদের সহানুভূতি পাওয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে। ১৮ মার্চ তিন সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকেন। তাদের আন্দোলন দমনের জন্যই নাকি এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এর ক’দিন পর থেকে তারা অভিযোগ করতে থাকেন দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। এরপর তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা ও নির্যাতনের অভিযোগ করতে থাকে। এরপর তারা অভিযোগ করেন আন্দোলন চলাকালে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে আর ঢালাওভাবে মামলা করায় অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। একপর্যায়ে তারা কারাবন্দী নেতাদের মুক্তি এবং যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা আছে তাদের গ্রেফতার না করার দাবি জানাতে থাকে। ৫ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে আদালত থেকে জামিন নিয়ে দীর্ঘ ৯২ দিন পর বাসায় ফিরে যান। এরপর একেক করে বিএনপির কারাবন্দী নেতাকর্মীরা মুক্তি পেতে থাকেন। সেই সঙ্গে আত্মগোপনে থাকা অনেক নেতাকর্মী সিটি নির্বাচন কার্যক্রমে অংশ নিতে থাকেন। এবার বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় তাদের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে দেয়া হচ্ছে না। এরপর বিএনপি অভিযোগ করতে থাকে বিভিন্ন এলাকায় তাদের নেতাকর্মীদের প্রচারে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের পোস্টার-লিফলেট ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। একপর্যায়ে বিএনপি ভোটকেন্দ্রে সরকারী দল প্রভাব বিস্তার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে অভিযোগ করে প্রতিকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা দেয়ার দাবি জানায়। এরপর তারা নির্বাচনী এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও দাবি জানায়। নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করলে বিএনপি সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে রিজার্ভ রেখে প্রয়োজনের সময় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয় সরকারের নির্দেশেই নির্বাচন কমিশন এভাবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৮ এপ্রিল থেকে মাঠে নেমে ভোটারদের হাতে হাতে দলীয় প্রার্থীদের লিফলেট বিতরণ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ভোট চাওয়া শুরু করেন। প্রথম দিন তিনি নির্বিঘেœ ভোটারদের হাতে হাতে লিফলেট বিতরণ করে ভোট চাইতে পারলেও দ্বিতীয় দিন উত্তরায় বাধার মুখে পড়েন তিনি। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়াকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। সেই সঙ্গে তাঁরা ওই এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে খালেদা জিয়া ওখান থেকে ফিরে বাড্ডা এলাকায় এসে ভোট প্রার্থনা করেন। একপর্যায়ে তিনি তাঁকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে সরকার বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তৃতীয় দিন কাওরানবাজার এলাকায় ভোট চাইতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা করে। ওই দিনও খালেদা জিয়া এ হামলার জন্য সরকারকে দায়ী বলে অভিযোগ করেন। চতুর্থ দিন ফকিরাপুলে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাও সরকারী দলের লোকেরা ঘটিয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। পঞ্চম দিন বাংলামোটর মোড়ে আবারও খালেদা জিয়ার গাড়িসহ তাঁর বহরের বেশ ক’টি গাড়ি ভাংচুর করে হামলাকারীরা। এ ঘটনার পর বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় খালেদা জিয়াকে হত্যা করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালানো হয়েছে। সরকারকে চাপে রাখতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অভিযোগ অব্যাহত রাখলেও বিএনপির হাইকমান্ড ধরেই নিয়েছে বর্তমান সরকার তাদের খুব একটা ছাড় দেবে না। তাই দলীয় মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীদের বিজয়ী করতে ভেতরে ভেতরে নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, সমর্থক ও প্রার্থীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা অনুসারে নিজ নিজ এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী ও সমর্থকরা কৌশলে প্রচার জোরদার করছেন। যেসব প্রার্থী এখনও আত্মগোপনে আছেন তারা আত্মীয়-স্বজন ও মহল্লাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে ৩ সিটি কর্পোরেশনের দলীয় মেয়র প্রার্থীদের নামে একটি খোলা চিঠি ছেড়েছে বিএনপি। দলীয় কর্মীদের দিয়ে এ খোলা চিঠি ভোটারদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এতে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করে ভোটারদের সহানুভূতি পাওয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের নামে পাঠানো খোলা চিটিতে দেখা যায় শুরুতেই বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রথমেই অভিযোগ করা হয়Ñ দেশে এখন রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। অভিযোগের মধ্যে এছাড়াও রয়েছেÑ সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, অপহরণ, নাশকতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের কারণে কেউ স্বস্তিতে নেই। খোলা চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয় সরকারী দল বীরদর্পে নির্বাচনী এলাকায় প্রচার চালাতে পারলেও বিএনপি প্রার্থীরা তা পারছে না। এ ছাড়া বিএনপি দলীয় কর্মীরা প্রচার চালাতে গেলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। আর গ্রেফতারের ভয়ে অনেকেই নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরপাকড় করছে বলেও এতে অভিযোগ করা হয়। এভাবে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগসংবলিত খোলা চিঠি পাঠিয়ে বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনা করে বাড়তি সুবিধা নেয়ার কৌশল অবলম্বন করছেন। জানা যায়, তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী এলাকাতেই সরকারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগসংবলিত খোলা চিটি স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা বাসায় বাসায় গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছেন। তবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে অবস্থান নেয়া দলীয় নেতাকর্মীরাও এ কাজে সহযোগিতা করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রকাশ্যে হাঁকডাক দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে তেমন প্রচার না থাকলেও স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা গোপনে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করছেন। বিশেষ করে তারা ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এবং পারিবারিক গ-িতে ঘরোয়া বৈঠকের মধ্য দিয়ে কোন্ পদে দলীয় প্রার্থী কে এবং কোন্ পদে কাকে ভোট দিতে হবেÑ সে ব্যাপারে জোরালো প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে এখনও এ ধরনের প্রচার শুরু না হওয়ায় এলাকাভিত্তিক প্রচারে বিএনপি-জামায়াত এ কৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হতে সবাই নিজ নিজ কৌশলে কাজ করে থাকেন। তাই বিএনপি যদি কোন কৌশল গ্রহণ করে থাকে তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি বলেন, অভিযোগ করার মতো যেসব ঘটনা ঘটছে তাই আমরা তুলে ধরছি। আমরা চাই সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। তাহলেই ভোটাররা তাদের সঠিক রায়ের প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন।
×