ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

একাত্তরে বরিশালে প্রথম যুদ্ধ হয় ২৫ এপ্রিল

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৫ এপ্রিল ২০১৫

একাত্তরে বরিশালে প্রথম  যুদ্ধ হয় ২৫ এপ্রিল

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেও আর চাকরিতে ফিরে যাওয়া হয়নি। দেশমাতৃকার টানে সেদিন যোগ দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। জীবনবাঁজি রেখে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলাম সবুজে রক্তে লাল বিজয় পতাকা। জীবনের প্রথম সম্মুখযুদ্ধেই হারিয়েছি সহযোদ্ধা চার বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। সেদিনের স্মৃতি আজও পীড়া দেয়। আবেগাাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অব) আব্দুর রাজ্জাক চোকদার। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের উত্তাল মুহূর্তে সড়কপথে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে সম্মুখযুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিল পাক সেনারা। সেদিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে পাক সেনারা দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার গৌরনদী উপজেলার সাউদের খালপাড়ে (কটকস্থল) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ওই দিন সম্মুখযুদ্ধে সাতজন পাক সেনা নিহত ও মুক্তিবাহিনীর চারজন বীর সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। যে কারণে ২৫ এপ্রিল গৌরনদী প্রতিরোধ দিবস। সেদিনের রণাঙ্গন কাঁপানো বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সার্জেন্ট (অব) আব্দুর রাজ্জাক চোকদার পাক সেনাদের সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। একান্ত আলাপনে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সহকারী কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক চোকদার বলেন, জীবনে এমন একটি সুযোগ তৈরি হবে ভাবতেই পারিনি। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে যোগদান করে চাকরির সুবাদে পাকিস্তানেই বসবাস শুরু করেছিলাম। ১৯৭১ সালে ছুটিতে দেশে আসার কিছুদিন পরই শুরু হয় স্বাধীনতার মুক্তি সংগ্রাম। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এলাকার যুবসমাজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আর চাকরিতে ফিরে যাওয়া হয়নি। তখন আমাদের এলাকায় ছুটিতে থাকা তৎকালীন সেনা সদস্যরা একত্রিত হয়ে সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আমিসহ বন্ধু সুবেদার গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আবুল হাসেম, সৈয়দ অলিউল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স, আব্দুল হাকিম, মোসলেম উদ্দিন, মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলামসহ অনেকেই স্থানীয় এমপি (চাঁদশী গ্রামের) এ্যাডভোকেট করিম সরদারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখন তিনি (এমপি) তৎকালীন সেনা সার্জেন্ট সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নিয়ে প্লাটুন তৈরি করে বেসামরিক লোকদের সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করার জন্য। তখন তিনি (এমপি করিম সরদার) আমাদের ছয়টি থ্রিনটথ্রি রাইফেল, দুটি দোনলা বন্দুক ও কিছু গুলি দিয়েছিলেন। এরপর আমরা গৌরনদী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হরলাল গাঙ্গুলির বাড়ির পূর্বপাশের কলেজ ছাত্রাবাসে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে বেসামরিক যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে আকস্মিকভাবে তৎকালীন এমপি এ্যাডভোকেট আব্দুর করিম সরদার আমাদের ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে পুরো প্লাটুন নিয়ে জরুরীভিত্তিতে ভুরঘাটার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। তাৎক্ষণিক বেসামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্লাটুনে অন্তর্ভুক্ত করে তিনটি সেকশনে ভাগ হয়ে ভুরঘাটার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথিমধ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সাউদের খালপাড় (কটকস্থল) নামক স্থানে পৌঁছলে আমরা দেখতে পাই পাক হানাদার বাহিনী কনভয় নিয়ে বরিশালে প্রবেশ করছে। এটা দেখামাত্রই আমরা মুক্তিযোদ্ধারা মহাসড়কের দু’পাশে এ্যামবুশ (যুদ্ধ প্রস্তুতি) নেই। পাকিদের কনভয়ের গাড়ির চাকার ওপর গুলিবর্ষণ করার পর পাক সেনারা আমাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। ওই দিন সাতজন পাক সেনা আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) হাতে নিহত হওয়ার পর পাকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ফলশ্রুতিতে ভাগ্যক্রমে আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই শহীদ হন আমাদের সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাঠৈর সৈয়দ আবুল হাসেম, বাটাজোরের মোক্তার হোসেন, গৈলার আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও চাঁদশীর পরিমল ম-ল। এটাই ছিল সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চলে পাক সেনাদের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ ও এরাই হচ্ছেন সম্মুখযুদ্ধের প্রথম চার শহীদ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু বলেন, সেদিন পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত চারজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ তিন দিন পর আমিসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করি। পরবর্তীতে শহীদ সৈয়দ আবুল হাসেম, আলাউদ্দিন সরদার ওরফে আলা বক্স ও পরিমল ম-লের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেও শহীদ মোক্তার হোসেনের লাশটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড দিয়ে শহীদ মোক্তারের বাটাজোরের গ্রামের বাড়িতে যেতে হতো। বাসস্ট্যান্ডের সরকারী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল পাক সেনারা, যে কারণে শহীদ মোক্তার হোসেনকে উত্তর ধানডোবা গ্রামের ফকিরবাড়িতে দাফন করা হয়। বর্তমানে শহীদ সিপাহী মোক্তার হোসেনের ছেলে আক্তার হোসেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আক্ষেপ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু, আব্দুল মজিদ সরদার, আব্দুর রাজ্জাক চোকদারসহ অনেকেই বলেন, প্রতিবছর ২৫ এপ্রিল আমরা ছুটে যাই সেদিনের ঘটনাস্থল সাউদের খালপাড়ে। কিন্তু আজও ঘটনাস্থলে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাথিত হতে হয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও দক্ষিণাঞ্চলের সর্বপ্রথম সম্মুখযুদ্ধের ঘটনাস্থল (সাউদের খালপাড়ে) আজও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এখনও দু’জন শহীদের সমাধি রয়ে গেছে অরক্ষিত। দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধ দিবসে সরকারীভাবে এখানে পালন করা হয় না কোন কর্মসূচী, যে কারণে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সাউদের খালপাড়ের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের ইতিহাস সর্ম্পকে কোন ধারণাই নেই। গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের উদ্যোগে দিবসটি উপলক্ষে সাউদের খালপাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সাউদের খালপাড়ে শহীদ চার মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিরক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, চার শহীদ পরিবারকে স্বীকৃতিসহ চার শহীদের নামে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নামকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
×